এরশাদের নয় বছরের উন্নয়ন

রংপুর, জাতীয়

ফরহাদুজ্জামান ফারুক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, রংপুর | 2023-09-01 06:56:17

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ প্রত্যুষে বাংলাদেশে সামরিক আইন জারি করে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একটি রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে সরিয়ে দেশের কর্তৃত্ব হাতে নেন।

সামরিক ফরমান জারি করার পর জাতীয় সংসদ ও প্রেসিডেন্টসহ মন্ত্রিপরিষদ বাতিল করে সংবিধানের কার্যকারিতা স্থগিত ঘোষণা করেন জেনারেল এরশাদ।

রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে ক্ষমতায় আসেন জেনারেল এরশাদ। বাংলাদেশের ইতিহাসে শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়ের। ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তার দেশ পরিচালনাকে অনেকেই সামরিক একনায়কতন্ত্রের সাথে তুলনা করেন।

আরও পড়ুন: যেভাবে রাষ্ট্রপতি হন এরশাদ

দীর্ঘ নয় বছর দেশ শাসন করা এরশাদ ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি। যা পরবর্তীতে বেশ কিছু উপদলে বিভক্ত হয়। সবশেষ ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অসুস্থ থাকার কারণে প্রচার প্রচারণায় অংশ না নিয়েও রংপুর-৩ আসন হতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এরশাদ।

দীর্ঘদিন ধরে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুতে রাজনৈতিক অঙ্গনে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। ‘আটষট্টি হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে’ বাক্যের প্রবক্তার নয় বছরের শাসনে উন্নয়ন কেমন হয়েছিল আসুন জেনে নেই।

এরশাদের শাসনামলের ফিরিস্তির কিছু অংশ তুলে ধরা হলো:

দেশের সর্ব প্রথম বিরতিহীন আন্তঃনগর ট্রেন চালু করেন এরশাদ। শিশুদের সাংস্কৃতিক মেধার বিকাশে পথকলি ও নতুন কুঁড়ি তার অবদান। দেশে ৬৪ জেলা ও ৪৬০টি উপজেলা প্রতিষ্ঠিত হয় এরশাদের শাসনকালে। ঘূর্ণিঝড় প্রবণ এলাকায় প্রথম শেলটার বাড়ি নির্মাণ করেন তিনি। গুচ্ছ গ্রামের (বর্তমানের আশ্রয়ণ) ধারণা তিনি প্রথম প্রবর্তন করেন। পুরনো বিমান বন্দরে প্যারেড স্কয়ার নির্মাণ হয় তার সময়ে।

আরও পড়ুন: এরশাদ-এক রাজনৈতিক অধ্যায়

তিস্তা বাঁধ তৈরি করেন। ত্রিমোহনি সেতু নির্মাণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিকাশ ঘটাতে তিনি জাতীয় স্মৃতি সৌধের নকশা অনুযায়ী নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন। বর্তমানের পোশাক শিল্প তার সময় বিকশিত হয়। ঢাকায় প্রথম বেবি হোম তার অনুপ্রেরণায় তৈরি হয়।

এরশাদের আমন্ত্রণে রানী এলিজাবেথ ও চীনের প্রেসিডেন্ট প্রথম এদেশে আসেন। তার শাসনকালে বিশ্বের প্রভাবশালী প্রেসিডেন্টরা এদেশে আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। তিনি আমেরিকার হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করে সেখানে বাংলাদেশের পক্ষে ভাষণের সুযোগ পেয়েছিলেন। এছাড়া তিনি জাতিসংঘের শান্তি মিশনে প্রথম সেনা প্রেরণ করেন।

আরও পড়ুন: জাতীয় ফ্রন্ট থেকে এরশাদের জাপা

বাংলাদেশে প্রথম আইএসডি টেলিফোন প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। তার শাসনামলে দেশে প্রথম সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২টি ছাত্রাবাস নির্মাণ করেন। শিল্পকলা একাডেমির বর্তমান আধুনিক ডিজাইনের রূপকার তিনি। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহানগর প্রভাতি সরাসরি ট্রেন সার্ভিস চালু করেন। রাজশাহী বিমান বন্দর চালু হয় তার সময়ে। ওয়ারীতে সুইপারদের জন্য বহুতল ভবন নির্মাণ করেন তিনি। তার সময়ে নির্মিত হয় মতিঝিল সেনা কল্যাণ ভবন। সন্তোষে বেগম ও ভাসানি-কে বাড়ি তৈরি করে দেন তিনি।

গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম তার সময় বিস্তৃতি লাভ করে। সারাদেশে উপজেলা ভবন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণ ও উপজেলার ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ হয় তার সময়ে। প্রত্যেক উপজেলায় ১৭ জন অফিসার নিয়োগ ও ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করেন তিনি। বারডেম হাসপাতাল তার সময় প্রতিষ্ঠা পায়। রাজশাহীর বরেন্দ্র গবেষণা তার হাতে নির্মিত। ফার্মগেট খামার বাড়ি নির্মিত হয় তার আমলে। গাজীপুরে ধান ও চাল গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।

আরও পড়ুন: শোকে স্তব্ধ এরশাদের আতুর ঘর

সিলেটের ওসমানী মেডিকেল হাসপাতাল, ওসমানী বিমানবন্দরসহ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় তার হাতে তৈরি। যমুনা নদীর ওপর নির্মিত বর্তমান বঙ্গবন্ধু সেতুর মাষ্টার মাইন্ড ছিলেন তিনি। বুড়িগঙ্গা, কাঞ্চন, হালদা, মেঘনা- গোমতি, কর্ণফুলী, রূপসা, ২য় বুড়িগঙ্গা, টঙ্গি ব্রিজসহ মোট ৪৩ টি বড় বড় ব্রিজ এবং উত্তরবঙ্গসহ সারাদেশে উন্নতমানের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা হয় তার শাসনকালে।

মুজিব নগর স্বাধীনতা সৌধ নির্মাণ, ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বর্তমান আদলে ফিরে আসার সূচনা তার সময়ে। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকারম মসজিদের সংস্কারেও তার অবদান রয়েছে। জাতীয় সংসদ ভবনের স্থাপত্য প্রকৌশলী লুই ক্যানের নকশা অনুযায়ী সংসদ ভবনের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তিন নেতার স্মৃতি সৌধ তৈরি করেন তিনি।

আরও পড়ুন: এরশাদের প্রথম জানাজা সম্পন্ন

আমেরিকান দূতাবাসকে জায়গা দিয়ে বিদেশি দূতাবাসগুলোকে প্লট বরাদ্দের পদ্ধতি চালু করেন এরশাদ। তিনি আহসান মঞ্জিলকে নতুন রূপে সাজিয়েছেন। ‘ডাক্কা’ কে ‘ঢাকা’ নামকরণ করেন এরশাদ। ঢাকা বিমানবন্দরে ভিভিআইপি টার্মিনাল তার হাতে তৈরি। ঢাকা শহর রক্ষা বাঁধ (বেড়িবাঁধ) নির্মাণ করেন তিনি। সুপ্রিম কোর্ট মাঠে ঈদের জামাত তিনিই প্রথম শুরু করেন।

ওসমানী মিলনায়তন এরশাদের আমলে তৈরি। উত্তরা ও বারিধারা হাউজিং উন্নয়ন ও প্লট বরাদ্দ করেন তিনি। যাত্রাবাড়ী, গাবতলি ও তেজগাঁওয়ে বাস টার্মিনাল তৈরি করেন এরশাদ। ঢাকায় এক ডজনেরও বেশি শিশু পার্ক নির্মাণ করেন। ঢাকায় আধুনিক রোড ও ট্রাফিক সিগনাল তিনি প্রথম স্থাপন করেন। ঢাকায় গরুর গাড়ি দিয়ে ময়লা ফেলার পরিবর্তে ময়লার জন্য ট্রাক প্রবর্তন করেন তিনি। বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সরবরাহের সময়োপযোগী উন্নয়ন তিনি করেছিলেন। তার সময়ে মসজিদ মাদরাসা বিদ্যুৎ বিল মওকুফ ছিল।

চট্টগ্রাম বন্দরে প্রথম ৯ মিটার ড্রাফটের জাহাজের জন্য জেটি ও ৫টি নতুন শেড বানিয়েছিলেন তিনি। বিআইডব্লিউটিএ এবং বিআইডব্লিউটিসি এর মাধ্যমে দেশের নদীপথ ও ষ্টীমার সার্ভিসের আধুনিকায়ন করেছেন এরশাদ। সারাদেশের গ্রামগঞ্জে পাকা রাস্তা করার জন্য এলজিইডি নিজে সৃষ্টি করেছেন। অফিস আদালতসহ সকল ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন তিনি করেছেন। শুক্রবারকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করেন তিনি।

আরও পড়ুন: এরশাদের কার্যালয়ে শোকাহত নেতাকর্মীদের ভিড়

বাংলাদেশের বাণিজ্য জাহাজ গুলোতে দেশের পতাকা প্রথম উড়িয়েছিলেন। রাজশাহী বিমান বন্দর তার হাতে পুনরায় আধুনিকীকরণ হয় । সিলেট ও চট্টগ্রাম বিমান বন্দরকে বর্তমান রূপ তিনি দিয়েছেন। রেলওয়েকে ২ টি বিভাগে তিনি ভাগ করেছেন। তাঁর সময়ে ৩০ টি ইঞ্জিন, ১০৬ টা যাত্রী বগী ও ১২৫৫ টা মালবাহী বগী রেলওয়েতে যোগ হয়েছিল। সারাদেশে ২৭৭টি রেলস্টেশন আধুনিকায়ন করা হয় তার আমলে।

৩য় শ্রেণি অবধি ফ্রি বই তিনি শুরু করেছিলেন। তাঁর শাসনামলের প্রথম ২ বছরে দেশে প্রায় ১২ হাজার শিক্ষক নিয়োগ হয়।

এরকম ৩৭৭টি বড় বড় কাজ তার নামে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। এছাড়া আরও হাজারো স্থাপনা, ব্রিজ, ছোট ছোট সেতু, কালবার্ড তৈরি হয়েছে এরশাদের নয় বছরের শাসনামলে। এতকিছুর মধ্য দিয়ে এরশাদ এদেশে উন্নয়নের অগ্রযাত্রার সূচনা করেছিলেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর