ঈদ মানে আনন্দ, তবে সবার জন্য না!

ঢাকা, জাতীয়

আপেল মাহমুদ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 06:12:06

ঈদ মানেই আনন্দ— ঈদ বিষয়ক ধারণায় আমাদের কাছে এমনটাই স্বতঃসিদ্ধ। সাধারণত ঈদ মানুষের জীবনে আনন্দ বয়ে আনলেও সবার ক্ষেত্রে তা হয় না। সুবিধাবঞ্চিত অনেক মানুষের কাছে অন্য আর দশটি দিনের মতোই ধরা দেয় ঈদের দিনটিও।

এবারের ঈদুল ফিতরের আনন্দ কিছুটা মলিন হয়ে ছিলো বৃষ্টির বাধায়। সকাল থেকেই বৃষ্টির কারণে ঈদের নামাজ মসজিদেই পড়তে হয়েছে অনেককে। ঘর থেকে বেরও হতে পারেননি অনেকে। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির পরিমাণ কমতে থামলে মানুষজন বের হতে শুরু করেন। নতুন কাপড় পরে ঘুরে বেড়ান বন্ধুবান্ধব পরিবার-পরিজন নিয়ে। কেউবা বেড়াতে গিয়েছেন আত্বীয়-স্বজনদের বাসায়। কিন্তু সবার জন্য ঈদ এমন আনন্দমুখর হয়ে আসে না। কারো কারো কাছে ঈদ প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ার বেদনায় ঠাসা।

ঈদের দিনে অনাকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টিতে আনন্দ তো দূরে থাক মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতেই বিপাকে পড়েছেন ঘরহীন মানুষেরা। ফুটপাতই যাদের আবাসস্থল ঈদের দিনে আনন্দের বদলে তাদের চোখে-মুখে ছিলো অসহায়ত্বের ছাপ। বৃষ্টির অনাচারে পড়ে হয়তো কোনো এক ছোট্ট খুপড়ি বা ফুটওভারব্রিজের নিচে মাথা গুঁজেছেন আশ্রয়হীন মানুষেরা।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায় নিদারুণ অসহায় অবস্থায় অনেকেই দিন কাটাচ্ছেন। অনেকে নতুন কাপড় পাওয়ার আশায় সকাল থেকে বৃষ্টির মধ্যেই বসে অপেক্ষা করেছেন। এসব সুবিধাবঞ্চিত মানুষেরা আশায় ছিলেন— হয়তো কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে।

রাজধানীর ভাসমান এসব মানুষদের নির্দিষ্ট কোনো আশ্রয় থাকে না। আজ এখানে তো কাল ওখানে। বৃষ্টি হলে বাড়ে যন্ত্রণা। ফুটপাতে মাথার উপর কিছু প্লাস্টিক ও পলিথিন দিয়ে সামিয়ানা টাঙিয়ে কোনোরকমে আবাসের বন্দোবস্ত করে এমন পরিবারও এই শহরেই রয়েছে। একজন মানুষের থাকার জায়গা যেখানে হয় না সেখানে পুরো পরিবারকেই কষ্ট করে দিন পার করতে হচ্ছে।

এমনই এক পরিবারের দেখা মিললো হাইকোর্টের সামনে। সামান্য একটা প্লাস্টিক উপরে টাঙিয়ে দিয়ে সেখানে অবস্থান করছেন পরিবারের সদস্যরা। ফুটপাতের উপরে একটি কাথা বিছিয়ে কোনরকম সেখানেই ঘুমাচ্ছেন কয়েকজন।

দুই সন্তারের মা মুন্নি। নানান প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে বড় করছেন বাচ্চা দুটোকে। বাবার সন্ধান নেই। বাবাকে চেনেও না দুই সন্তানের কেউই। মা টুকটাক কাজ করে দুই সন্তানের আহার যোগাড় করেন। কোনো কোনো দিন অনাহারেও থাকতে হয়ে তাদের।

অসহায় অবস্থায় ভিক্ষাবৃত্তির পথই বেছে নিতে হয়েছে মুন্নিকে। হাইকোর্টের সামনে প্রতিদিন দুই সন্তানকে নিয়ে ভিক্ষা করেন তিনি। সারাদিন যা আয় করেন তাতে তিনজনের খাওয়া-পড়া চলে না। তাই ঈদ তাদের জন্য খুব একটা খুশি নিয়ে আসে না। ঈদ এলেই তাদের চেয়ে থাকতে হয় কারো সাহায্যের আশায়। সাহায্য মিললে হয়তো বছরে একদিন নতুন কাপড় পড়ার সৌভাগ্য হয় আর ভাগ্য খারাপ হলে সেটিও জোটে না।

রেণু বেগম থাকেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে। মেডিকেলের পার্শ্ববর্তী ফুটপাতেই তার সংসার। দীর্ঘ ১২ বছর যাবত এই ফুটপাতে বসবাস করে আসছেন ষাটোর্ধ্ব রেণু বেগম। স্বামী মারা যাওয়ার পর ছেলেরা আর মায়ের খোঁজ করে না। কথিত এক নাতনিকে নিয়েই কোনোভাবে দিন কাটাচ্ছেন তিনি। মানুষের কাছে সাহায্য চেয়ে বেড়ান দিনভর। সেই সাহায্যের টাকা দিয়েই চলে তার সংসার।

এবারের ঈদ কেমন কাটলো জানতে চাইলে রেণু বেগম বলেন, ‘এই বয়সে আবার ঈদ? বাঁইচা আছি সেইটাই বড় ব্যাপার!’

‘ঈদ বড়লোকদের ব্যাপার’ মন্তব্য করে রেনু বলেন, ‘দিনের খাবারই জোগাড় করতে পারি না, ঈদ কেমনে করবো! মাঝে মাঝে কেউ নতুন-পুরাতন কাপড় দেয় সেইগুলাই পরি। এইবার সেইগুলাও জোটে নাই! আমাগো জীবনডাই কষ্টের, আমাগো জীবনে ঈদ আসে না।’

ফুটপাতে থাকেন এমন আরেক পরিবারের দেখা মিললো কাঁঠালবাগানে। বেগম শুকুরজান, দুই সন্তানের জননী। জমজ দুই ছেলে, ঈদে নতুন প্যান্ট পেয়েছে দুজনই। স্বেচ্ছাসেবী এক প্রতিষ্ঠান দুই ভাইকে দিয়েছে প্যান্ট দুটি। প্যান্ট পেলেও শার্ট বা পাঞ্জাবি কেনা হয়নি। নতুন প্যান্ট পরে খালি গায়েই ঘুরে বেড়াচ্ছে দুই ভাই।

শুকুরজান বাসায় ছিলেন সারাদিন। নতুন কাপড় কপালে জোটেনি তার তাই পুরাতন কাপড় পরেই ঈদের দিন পার করেছেন। বৃষ্টির জন্য সন্তানদের নিয়ে কোথাও যেতেও পারেননি। ছোট্ট একটা ভ্যানের উপর দুই সন্তানকে নিয়ে বসবাস করেন তিনি। কষ্ট করে ঘুমানো গেলেও বৃষ্টি এলে আর রক্ষা নেই। সারারাত জেগেই কাটাতে হয়। বৃষ্টির পরিমাণ বেশি হলে মাথার উপরে দেওয়া প্লাস্টিকের ছাদের ফুটো দিয়ে পড়ে পানি। তাই ঘুম আর হয় না তাদের।

এ সম্পর্কিত আরও খবর