রক্তদানে সেঞ্চুরি করা হলো না বদরুল টিপুর

ময়মনসিংহ, জাতীয়

উবায়দুল হক স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ময়মনসিংহ বার্তা২৪.কম | 2023-08-25 21:19:59

একযুগেরও বেশি সময় তার ডান হাত ছিল প্যারালাইজড। কিন্তু বাম হাত দিয়ে নিয়মিতই রক্তদান করতেন তিনি। অন্যের জীবন বাঁচাতে ভূমিকা রাখতে মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত রক্ত দিয়েছেন প্রায় ৫৫ বার। স্বপ্ন ছিল রক্তদানে সেঞ্চুরি করবেন। কিন্তু তার আগেই না ফেরার দেশে চলে গেলেন তিনি।

মানবতার এ যোদ্ধা নিজে রক্ত দেয়ার পাশাপাশি অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকসহ সাধারণ মানুষকে রক্তদানে উৎসাহিত করতেন। রোগীর জরুরি প্রয়োজনে ব্যবস্থা করে দিতেন রক্ত। তিনি ছিলেন মানবতার এক অনন্য ফেরিওয়ালা।

কিন্তু জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করে অবশেষে মৃত্যুকে হাসিমুখে আলিঙ্গন করলেন। তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। কাঁদিয়ে গেলেন হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবককে। তবুও তিনি হয়ে রইলেন স্বেচ্ছাসেবকদের আইকন। অনন্য দৃষ্টান্তের এক পথিকৃৎ।

বলা হচ্ছে মানবতার অগ্রদূত ময়মনসিংহের গফরগাঁও এলাকার বাসিন্দা বদরুল আহছান টিপুর কথা। মানবতার এ সেবক রোববার (২৮ এপ্রিল) রাত ১১টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বেশ কিছুদিন যাবৎ শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি।

সোমবার (২৯ এপ্রিল) সকালে ময়মনসিংহের গফরগাঁও রেলওয়ে স্টেশন জামে মসজিদে প্রথম জানাজা ও নিজ গ্রাম দৌলতপুরের তেতুলতলা জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে দ্বিতীয় জানাজা শেষে তাকে পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৪২ বছর।

মৃত্যু পথযাত্রী মানুষের জন্য আমৃত্যুর জয়গান করা এ মানুষটি ছিলেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘অভ্যুদয়’-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। তার মৃত্যুতে শোকাভিভূত তার জন্মস্থান গফরগাঁওয়ের বাসিন্দাসহ পুরো দেশের বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হাজারো সদস্য। বোবা কান্নার পাষাণ যন্ত্রণায় স্তব্ধ সকলেই। তাদের আবেগতাড়িত স্ট্যাটাসে শোকাচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের ওয়াল।

জানা গেছে, মানবতার ডাকে মুমূর্ষু রোগীর জীবন বাঁচানোর ব্রত নিয়ে ১৯৯৩ সালে রক্তদান শুরু করেন বদরুল টিপু। একটানা দীর্ঘ ৩৮ বার ময়মনসিংহের সন্ধানীতে রক্তদান করেছেন। বাংলাদেশে কোয়ান্টাম, মেডিসিন ক্লাবসহ ভারতেও রক্তদানের ইতিহাসের সাক্ষী হয়েছেন। দীর্ঘ রক্তদানের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল অনেক প্রতিকূলতা। ২০০৪ সালে ব্রেইন স্ট্রোক করে তার ডান পাশ প্যারালাইজড হয়ে যায়। দীর্ঘ এক বছর চিকিৎসা নেয়ার পর কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলেও চলাফেরায় অক্ষমই রয়ে যান বদরুল টিপু।

দীর্ঘদিন প্রতিবন্ধী হয়ে জীবনযাপন করলেও মানবতার প্রশ্নে কখনো হার মানেননি এ সৈনিক। তার হাত ধরেই তৈরি হয়েছে অসংখ্য রক্তদাতা ও সেবক। প্রতিবন্ধীদের নিয়েও কাজ করেছেন বদরুল টিপু, ছিলেন উপজেলা প্রতিবন্ধী সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক। রক্তদানের মতো মহৎ কাজকে ছড়িয়ে দিতে ও রক্তদানে উৎসাহিত করতে ২০১৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠা করেন রক্তদাতা ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘অভ্যুদয়’।

বদরুল টিপুর অকাল মৃত্যুতে স্বভাবতই শোকাহত নিজ হাতে গড়া সংগঠনটির সদস্যরা। সংগঠনটির সভাপতি আসাদুজ্জামান সুমন বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘বদরুল আহছান টিপু ভাই ছিলেন সকল স্বেচ্ছাসেবকদের প্রেরণা। নিজে অসুস্থ থেকেও কীভাবে আরেক অসুস্থ মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে সেবা করা যায়, সে দৃষ্টান্ত শতভাগ সফলতার সঙ্গে স্থাপন করে গিয়েছেন। দেশের সকল স্বেচ্ছাসেবকদের আদর্শ ও আইডল হিসেবে তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল।’

ময়মনসিংহের অন্যতম রক্তদাতাদের সংগঠন ব্রহ্মপুত্র ব্লাড সোসাইটির সভাপতি মমিনুর রহমান প্লাবন বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘শারীরিকভাবে এক প্রতিবন্ধী হলেও তিনি সব সময় নিঃস্বার্থভাবে ছুটে চলেছেন রক্তের সন্ধানে। মানব সেবামূলক কাজে গিয়েছেন দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। তৈরি করেছেন অসংখ্য রক্তদাতা। এতো আগেই তাকে হারাতে হবে এটা কখনো ভাবতে পারিনি। তার প্রস্থানে আমরা হারালাম আমাদের একজন অভিভাবককে।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর