আমিরাতে অগ্নিকাণ্ড থেকে শিশুর জীবন বাঁচালেন যে বাংলাদেশি

মধ্যপ্রাচ্য, আন্তর্জাতিক

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | 2023-08-22 16:28:16

আমিরাতের আল নুয়ামিয়া এলাকায় একটি ফ্ল্যাটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে গত রোববার। তৃতীয় তলায় নিজের তিন বছরের শিশু সহ বন্দী হয়ে পড়েন একজন নারী বাসিন্দা। দরজার পথে আগুন লেগে যায়। কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে ফ্ল্যাটের ভেতর। শিশুটি প্রশ্বাস নিতে পারছিল না।

অসহায় মা তৃতীয় তলা থেকে জানালা দিয়ে লাফিয়ে নামার সিদ্ধান্ত নেন। শিশুর পক্ষে তো আর লাফ দেয়া সম্ভব নয়। এদিকে ঘরের ভেতর ধোঁয়া বেড়ে যাচ্ছিল। বাইরে এরই মধ্যে মানুষ এসে ভিড় করেছেন। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি তখনো এসে পৌছায়নি। জানালার বাইরে সন্তানকে হাত দিয়ে ধরে রেখে উৎসুক জনতার কাছে সাহায্য চেয়ে চিৎকার করতে থাকেন মা। তবে তৃতীয় তলা থেকে একটি শিশুকে ছুড়ে দিলে নিশ্চিত পাবে লুফে নিতে পারবেন কিনা, এই আশঙ্কায় কেউই এগিয়ে যাননি।

পথযাত্রী ৫৭ বছর বয়সী বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিক ফারুক ইসলাম নূর আল হক দূর থেকে এই অবস্থা দেখে বিন্দুমাত্র দেরি করেননি। ওই ফ্ল্যাটের জানালার নিচে যেয়ে দাঁড়ান এবং হাত বাড়িয়ে ধরেন। যেহেতু ভবন থেকে বের হওয়ার একটিই মাত্র উপায় আছে, তাই মাও শিশুটিকে ছেড়ে দেন। সফলভাবে শিশুকে লুফে নেন ফারুক। এরপর ওই নারীও তৃতীয় তলা থেকে নিচে লাফ দেন বাঁচতে। বাংলাদেশি শ্রমিকের সাহসিকতায় জীবন ফিরে পায় পরিবারটি।

এই সাহসিকতার জন্যে আমিরাতের আজমান সিভিল ডিফেন্স গত মঙ্গলবার (জানুয়ারি ১৫, ২০১৯) ফারুক ইসলামে সন্মাননা জানিয়েছে।

স্থানীয় দৈনিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ফারুক বলেন, ‘যখন আমি ওই মায়ের চিৎকার শুনতে পাই, আমার মনের মধ্যে এমন কিছু একটা ঘটে যা আমার শরীরকে টেনে নিয়ে যায় ওই ফ্ল্যাটের জানালার নিচে। সেখানে অনেক মানুষ ভিড় করেছিল, তবে কেউই সাহস করে সাহায্যের জন্যে এগিয়ে আসেননি। আমার মনে হয়েছিল যে কোনো ভাবেই এই মা ও তার সন্তানকে বাঁচাতে হবে।’

ফারুক ওই পথ ধরে তার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন। ওই মা হিন্দী ভাষায় তার সন্তানকে বাঁচানোর জন্যে সাহায্য চেয়ে চিৎকার করছিলেন। চিৎকার শুনে ফারুন সেখানে গিয়ে দেখেন অগ্নিকাণ্ডের ভবনের তৃতীয় তলায় বড় একটি জানালা দিয়ে একটি শিশুকে বের করে ধরে রেখেছেন একজন নারী।’

ফারুক বলেন, ‘জানালার নিচে সুবিধামত স্থানে গিয়ে আমি ওই মায়ের চোখের দিকে তাকাই। তিনিও আমার দিকে তাকালে ভরসা পান এবং নিজের ৩ বছর বয়সী শিশুকে ছেড়ে দেন। নিরাপদেই শিশুটি আমার হাতে এসে পড়ে। আমি প্রথমে যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মানুষ যখন সাধুবাদ জানাতে থাকে এবং হাত তালি দিয়ে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানাতে থাকেন, তখন বুঝতে পারি শিশুটিকে নিরাপদেই ধরতে সক্ষম হয়েছি। আমি যেন মুক্ত হলাম এবং আত্মতৃপ্তি অনুধাবন করলাম। মনে হলো, আমি জীবনে একটি সঠিক কাজ করতে পেরেছি।’
শিশুর বাবা মোহাম্মদ সাকিব বলেন, আমার স্ত্রী রুবিনা খুবই দুঃচিন্তায় পড়ে যান। কারণ সন্তানের প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। আমি ওই সময়টায় অফিসে ছিলাম। স্ত্রীর জরুরি ফোন পেয়ে হাতের সব কাজ রেখে চলে আসি। আমার স্ত্রী জানাচ্ছিলেন, তিনি দরজার কাছে যেতে পারছিলেন না। এছাড়াও প্রচণ্ড ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল মা ও সন্তানের। আমি বলেছিলাম, এই অবস্থাতেও মাথা ঠান্ডা রেখে চিন্তা করতে এবং নিজেকে ও সন্তানকে বাঁচানোর পথ খুঁজে বের করতে।’

সন্তানের জীবন নিশ্চিত করে রুবিনা নিজেও জানালা দিয়ে লাফ দেন। পার্ক করা একটি গাড়ির ওপর পড়লে গুরুতর আহত হন তিনি। বর্তমানে খলিফা হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসারত অবস্থায় রয়েছেন তিনি।

সাকিব বলেন, আমি যখন বাসার কাছে পৌছালাম আমার স্ত্রী ততক্ষণে হাসপাতালে এবং আমার সন্তান মানুষের সঙ্গে ছিল। আমার সন্তানকে জীবিত দেখে আমি নিজেও যেন জীবন ফিরে পেলাম। আমি খোদাকে এবং ফারুককে ধন্যবাদ জানাই আমার সন্তানকে বাঁচানোর জন্যে।

ওই ভবনের করিডরে ইলেকট্রিক শর্ট সার্কিট থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। দ্রুতই ভবনটি ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। আরো একটি পরিবারের স্বামী ও স্ত্রী দুজন ভবনটি থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেদের রক্ষা করেন। তারাও হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর