ব্রেক্সিটের ফাঁদে বন্ধ হয়ে পড়ছে বৃটেনে বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট

ইউরোপ, আন্তর্জাতিক

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-25 22:20:59

সেপ্টেম্বরের এক সকালে সৈয়দ জয়নুল লন্ডনের বাইরে তার রেস্টুরেন্ট ইন্দোসে পৌছে স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। সকাল সাড়ে ১০টা বেজে গেলেও তখন পর্যন্ত কোন কর্মচারী এসে পৌছাননি।

খেঁপে গিয়ে তিন তার ৪ জন রোমানিয়ান কর্মচারীদের ডাকেন। কিন্তু কেউ সাড়া দেননি। একই দিনে রেস্টুরেন্টের আরো দুজন কর্মচারী বিনা নোটিশে চাকরি ছেড়েছেন। পরে জানা যায়, রোমানিয়ানরাও ইংল্যান্ড ছেড়ে চলে গেছেন। ধীরে ধীরে ৬২ বছর বয়সী জয়নুল বাধ্য হয় তার রেস্টুরেন্টটি বন্ধ করে দিতে। অথচ এই রেস্টুরেন্ট থেকে তিনি বছরে প্রায় ৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা আয় করতেন।

তবে তিনি যখন ব্রেক্সিট ক্যাম্পেইনকে সমর্থন করছিলেন, এ ধরনের কিছুর আশঙ্কাও করেননি। জয়নুলকে বলা হয়েছিল, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চল থেকে প্রচুর সংখ্যক শ্রমিক থাকবে। বৃটেনে এই বাঙালি রন্ধন শিল্প ভাল থাকবে যদি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে নাগরিকদের অবাধ চলাচলের নিয়ম থেকে বৃটেন বেরিয়ে আসে।

অথচ অভিবাসন আরো বেশি কঠোরতম হয়েছে, ব্যবসাগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এবং পূর্ব ইউরোপের শ্রমিকরাও চলে যাচ্ছে।

বর্তমান অভিবাসন নীতির কারণে বৃটেনে স্বনামধন্য ভারতীয় এবং বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টে রাঁধুনি পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে । এমনকি রানীও বাকিংহাম প্রাসাদের বাবুর্চিকে বিদেশি শ্রমিকের বেতন কাঠামোর কারণে বেশি বেতন দিতে পারছেন না।

জয়নুল বলেন, আমরা ভাবতেও পারিনি ব্রেক্সিটের পর এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। আমরা ভেবেছিলাম ভাল থাকবো। এখন যদি আবার ভোট হয়, আমি ইইউতে থাকার পক্ষে ভোট দিবো।

সম্প্রতি যে বৃটিশ রেস্টুরেন্টগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছে তার মধ্যে ইন্দোস একটি। দক্ষ বাবুর্চি এবং রন্ধন শ্রমিকের অভাবে প্রতিনিয়তই রেস্টুরেন্টগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

যারা ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোট দিয়েছিল তারা এখন কিভাবে ভুগছেন এটা তারই একটি উদাহরণ। ২০১৬ সালে ব্রেক্সিট থেকে বেরিয়ে আসার মূল কারণ ছিল অভিবাসন। সরকারি তথ্যে ব্রেক্সিটের নেতিবাচক ফল পরিষ্কার। ইংল্যান্ডে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশের শ্রমিক কমে গিয়েছে এবং এদের কোন প্রতিস্থাপনও হয়নি।

প্রধানমন্ত্রী থেরেসা বছরে ২ লাখ অভিবাসী থেকে কমিয়ে ১ লাখের মধ্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন।

ব্রেক্সিটের পর তার সরকার এমন একটি পদ্ধতির পরিকল্পনা করেছে যেখানে চুক্তিবদ্ধ দেশ থেকে দক্ষ শ্রমিকের অভিবাসন দেয়া হবে এবং অদক্ষ শ্রমিকের অভিবাসন কমিয়ে আনা হবে।

রেস্টুরেন্টগুলোর মালিকরা এই পদ্ধতি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন যখন ইংল্যান্ড ইইউ থেকে বেরিয়ে আসছিল। প্রায় দুই দশক ধরে চিকেন টিক্কা বৃটেনের জাতীয় খাবার হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। এই স্বীকৃতি দেয়ার সময়ও বলা হয়েছিল, দক্ষিণ এশিয়া থেকে আরো বেশি অভিবাসী আনা হবে। তখন ইউরোপের অন্য দেশের অভিবাসী সংখ্যা কমিয়ে এনে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ বাড়ানো হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। এছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার অবৈধ অভিবাসীদের বৈধতা দেয়ার কথাও বলা হয়েছিল।

এখন ইংল্যান্ডে ভাল বাবুর্চির অভাব। বৃটিশ অর্থনীতিতে এই রন্ধন শিল্প বছরে ৫.৫ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার যোগ করে। বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিকের অভাব রয়েছে এই খাতে।

ইউকে বাংলাদেশ ক্যাটালিস্ট অব কমার্স এন্ড ইন্ড্রাস্টিজের প্রেসিডেন্ট বজলুর খান বলেন, বর্তমান নিয়মে দক্ষিণ এশিয়া থেকে আনা বাবুর্চিদের ৩৫ হাজার পাউন্ড বেতন দিতে হবে। যেটা ছোট রেস্টুরেন্টগুলোর জন্যে অসম্ভব। এমনকি বাকিংহাম প্রাসাদও বছরে মাত্র ২১ হাজার পাউন্ডে বাবুর্চির বিজ্ঞাপন দিয়েছে।

অন্য কারণ হচ্ছে একজন শ্রমিকের নিজেকে দক্ষ প্রমাণের সার্টিফিকেট জোগাড় করা। একাডেমিক কাগজপত্র না থাকায় বাংলাদেশ বা পাকিস্তান থেকে পূর্ণ বেতন দিয়েও শ্রমিক আনা সম্ভব নয়।

কনজারভেটিভ দলের সংসদ সদস্য পল স্কালি বলেছেন, বাবুর্চিদের আনতে বর্তমান পদ্ধতির পরিবর্তন আনার জন্যে তিনি পরামর্শ চালিয়ে যাবেন। তবে বৃটেন থেকেই মানসম্মত বাবুর্চি বের করে আনাই দীর্ঘমেয়াদি সমাধান বলে মনে করেন তিনি।

অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী বাবুর্চি ওলি খান বলেন, এই ধরনের পরিস্থিতিতে রেস্টুরেন্টের কথা কল্পনাও করেননি। তিন বছর আগে ১২ হাজার রেস্টুরেন্টের প্রায় দেড় লক্ষ শ্রমিক নিয়ে তিনি ব্রেক্সিটের পক্ষে প্রচারণা চালান, 'সেভ আওয়ার কারি হাউজ' নামে। ব্রেক্সিটারস বরিস জনসন এবং প্রিতি পাতেলদের ওপর ভরসা করেই তিনি এবং তার গ্রুপ এই ক্যাম্পেইনে অংশ নেন বলে জানান।

বাংলাদেশ ক্যাটারাস অ্যাসোসিয়েশনের এই সাধারণ সম্পাদক বলেন, আমি গত ৩০ বছর ধরে এই দেশে রয়েছি এবং এর আগে কখনো এই ধরনের পরিস্থিতি দেখিনি। আমাদের অনেক মিথ্যা আশ্বাস দেয়া হয়েছিল এবং আমরা ব্যবহৃত হয়েছি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর