মিশরে ‘নিখোঁজ’ রহস্য

, আন্তর্জাতিক

সেন্ট্রাল ডেস্ক ৪ | 2023-08-25 21:13:42

মিশরের একটি মানবাধিকার সংগঠন বলছে, মিশরে গত চার বছরে কমপক্ষে ১ হাজার ৫০০ লোক নিখোঁজ হয়েছে। সম্প্রতি দেশটির এক মানবাধিকার সংগঠন এমন তথ্য প্রকাশ করেছে। সংগঠনটির দাবি- এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের কাছে দলিলপত্র আছে। কিন্তু তাদের মতে আসল সংখ্যা আরো অনেক বেশি। মানবাধিকার কর্মী মোহাম্মদে লফতির ভাষায় - ''প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাত্তাহ আল সিসির শাসনের একটা বড় বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এসব রহস্যজনক অন্তর্ধান।" সরকারের বিরোধী, বা বিরোধী বলে সন্দেহ করা হয় - এমন যে কেউ এখন ঝুঁকির মুখে - সে সন্দেহ ঠিক হোক বা না হোক তাতে কিছু এসে যায় না। সন্দেহভাজনদের আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুরাও কখনো কখনো গ্রেফতার হতে পারেন। এসব আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু অনেকে ইসলামপন্থী। মানবাধিকার কর্মীরা বলেন, এইসব নিখোঁজরা যখন কয়েক সপ্তাহ বা মাস পরে আবার আবির্ভূত হন, তার আগে তাদের ওপর অত্যাচার করা হয়, তাদের বিরুদ্ধে আনা হয় সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ। বিবিসর এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় এরকই নিখোঁজ কিছু মানুষের সর্ম্পকে। কায়রোর হাসপাতালে মানসিক বিপর্যয়ের কারণে চিকিৎসাধীন ছিলেন ২৩ বছরের জুবেইদা।তার ছোট ভাই আকে হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যাবার জন্য জন্য রওনা হলেন। পথে একটা ওষুধের দোকান পড়লো, জুবেইদাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে তার জন্য ওষুধ কিনতে ঢুকলেন তার ভাই।কয়েক মিনিট পর তার ভাই বেরিয়ে এসে দেখলেন জুবেইদা নেই। সেদিন এপ্রিলের ৮ তারিখ, ২০১৭ সাল। জুবেইদাকে আর কখনো দেখা যায় নি। মিশরের অসংখ্য 'নিখোঁজ'-দের তালিকায় উঠে গেছেন তিনি। [caption id="attachment_11846" align="aligncenter" width="300"] নিখোঁজ ব্যক্তিদের মুখোশধারী পুলিশ নিয়ে যায় বলে অভিযোগ এসেছে[/caption] মুখোশ পরা পুলিশ জুবেইদাকে তুলে নিয়ে গেছে, অভিযোগ তার মায়ের। "আমরা জানি পুলিশই তাকে নিয়ে গেছে। আমাদের প্রতিবেশীরা বলেছে, মুখোশ পরা অস্ত্রধারী লোকেরা পুলিশের গাড়িতে করে এসে তাকে তুলে নিয়ে গেছে। তারা আমাদের পুরোনো বাড়িতেও গিয়েছিল, আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে।" জুবেইদার হাতে ছিল তার ভাইয়ের মোবাইল ফোনটি। তিনি আটক হবার পর একটা ফোন করতে পেরেছিলেন একজন আত্মীয়কে। "সে শুনতে পেয়েছে একজন অফিসার জুবেইদাকে গালাগালি করছে, তারপরই ফোনটা বন্ধ করে দেয়া হলো।" [caption id="attachment_11847" align="aligncenter" width="300"] মেয়ের স্মৃতিচিহ্ন হাতে নিয়ে কাঁদছেন জুবেইদার মা[/caption] আসলে ঘটনার শুরু তারও কয়েক বছর আগে। ২০১৪ সালে জুবেইদা এবং তার মা একটি নিষিদ্ধ সমাবেশে যোগ দেবার অপরাধে সাত মাসের জেল খেটেছিলেন, তবে পরে তাদের খালাস দেয়া হয়েছিল। জুবেইদার মা - তিনি তার নাম প্রকাশ করেন নি- বলছিলেন, পুলিশ আমাদের ধরে নিয়ে ১৪ ঘন্টা ধরে মারধর করে, গালাগালি করে।" "আমাদের কাপড় খুলে ফেলে , বিদ্যুতের শক দেয়। তারা আমাদের স্বীকার করতে বলে যে আমরা একটা হোটেলে বোমা ফাটাতে পরিকল্পনা করেছি, আমাদের কাছে অস্ত্র আছে - এই সব মিথ্যা অভিযোগ।" "আমি শুনতে পাচ্ছিলাম জুবেইদার চিৎকার, কিন্তু তাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না।" জুবেইদার মা বললেন, "ওরা হুমকি দিল, আমরা অভিযোগ স্বীকার না করলে আমরা সামনেই জুবেইদাকে ধর্ষণ করবে। তবুও আমরা স্বীকার করি নি।" জুবেইদার মা বলছিলেন, তারা কখনো মুসলিম ব্রাদারহুড বা অন্য কোন নিষিদ্ধ সংগঠন করেন নি। ব্রাদারহুডের নেতা মোহাম্মদ মোরসি প্রেসিডেন্ট হবার এক বছরের মধ্যেই ক্ষমতাচ্যুত হন। এর পর ২০১৩ সালে ব্রাদারহুডকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সাত মাস জেলে থাকার পরে তারা ছাড়া পেলেন। তার বছর দুয়েক পরই ২০১৬ সালের জুলাই মাসে প্রথম বারের মতো জুবেইদা নিখোঁজ হন। তার মায়ের কথা, সেবারও পুলিশই তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। এর ২৮ দিন পর জুবেইদাকে পাওয়া যায় শহরের উপকণ্ঠে - সেখানে পুলিশ তাকে হাত, পা এবং চোখ বাঁধা অবস্থায় রাস্তার পাশে ফেলে রেখে গিয়েছিল। "তার গায়ে ছিল কাটা দাগ, বিদ্যুতের শক দেবার দাগ। আল্লাহ যাতে ক্রুদ্ধ হন এরকম সব অত্যাচারই তার ওপর করেছে তারা। সব কিছু"- বললেন জুবেইদার মা। এর পর জুবেইদার মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। তাকে হাসপাতালে মানসিক চিকিৎসা দিতে হয়। কিন্তু হাসপাতাল থেকে বেরুনোর পরই আবার তাকে অপহরণ করা হয়, এবং তিনি আর ফেরেন নি। শুধু জুবেইদা নন, মিশরে এমন আরো বহু মানুষ এরক রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়েছেন বা হচ্ছেন। আরেকজন হলেন ইব্রাহিম মেতওয়ালি। [caption id="attachment_11848" align="aligncenter" width="300"] নিখোঁজ ইব্রাহিম মেতওয়ালি[/caption] গত বছর ১০ই সেপ্টেম্বর ৫২ বছর বয়স্ক আইনজীবী ইব্রাহিম মেতওয়ালি সুইজারল্যান্ডে যাবার উদ্দেশ্যে রওনা দিলে কায়রো বিমানবন্দরের দিকে। তিনি যাচ্ছিলেন জাতিসংঘের একটি ওয়ার্কিং গ্রুপের সামনে মিশরের এই সব রহস্যময় অন্তর্ধানগুলোর বিষয়ে জবানবন্দী দিতে। [caption id="attachment_11849" align="aligncenter" width="300"] ইব্রাহিম মেতওয়ালির বড় ছেলে আমর ৪ বছর ধরে নিখোঁজ[/caption] মেতওয়ালির বড় ছেলে আমর চার বছর ধরে নিখোঁজ। তার ছোট ছেলে আবদেল মোনিইম বলছিলেন, "আমার মা বাবাকে বলেছিলেন দেশের বাইরে না যেতে। কিন্তু তিনি শোনেননি।" ওই দিন মেতওয়ালির ফোন থেকে তার পরিবার একটি টেক্সট পেলেন - যে তিনি জেনেভার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন। সবাই স্বস্তির নি:শ্বাস ফেললেন। কিন্তু আসলে ইব্রাহিম সেই বার্তা পাঠাননি। তিনি ততক্ষণে নিখোঁজদের খাতায় নাম লিখিয়েছেন। ঘটনাটা বিদেশের সংবাদমাধ্যমে খবর হলো। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে দু'দিন পর তাকে আদালতে হাজির করা হলো। তাকে 'মিথ্যা খবর ছড়ানো এবং অবৈধ সংগঠন তৈরির' দায়ে অভিযুক্ত করা হলো। মেতওয়ালি জেনেভা যেতে পারলে যেসব ঘটনার কথা বলতেন তার মধ্যে হয়তো ইতালিয়ান ছাত্র গিউলিও রেগেনির ঘটনাটা থাকতো। [caption id="attachment_11850" align="aligncenter" width="300"] ইতালিয় ছাত্র রেগেনিকে হত্যা করা হয়[/caption] ২০১৬র জানুয়ারিতে রেগেনি কায়রো থেকে নিখোঁজ হন - এর পর তার ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ পাওয়া যায় শহরের উপকণ্ঠে - যেখানে জুবেইদাকে পাওয়া গিয়েছিল, তার কাছেই। মি. মেতওয়ালির ছেলে আমরকে এখনো মুক্তিও দেয়া হয় নি, তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগও আনা হয় নি। মানবাধিকার কর্মীদের অনেকে বলেন, আবদুল ফাত্তাহ আল সিসির শাসনের মতো এত রক্তাক্ত সময় তারা আগে কখনো দেখেন নি। [caption id="attachment_11851" align="aligncenter" width="300"] মানবাধিকার কর্মী মোনা সেইফ[/caption] তাদের একজন মোনা সইফের কথা, জীবনকে এত কম মূল্য দেয় - এমন প্রশাসন আমরা আর দেখিনি। [caption id="attachment_11852" align="aligncenter" width="300"] তাহরির স্কয়ার এখন[/caption] বিবিসির সংবাদদাতা অরলা গুয়েরিন লিখছেন, ২০১১ সালের তাহরির স্কোয়ার অভ্যুত্থানের পর অনেক তরুণ কর্মী অনেক সম্ভাবনা স্বপ্ন দেখতেন ।এখন তারা শুধু কোনমতে টিকে আছেন, দিনগুলো পার করে দিচ্ছেন। তাদের কথা, মিশরের মধ্যে এখন কোন লড়াই করার স্পৃহা নেই। তারা এখন ভীত। কায়রোতে ২০১১ সালের গণঅভ্যুত্থানের কেন্দ্রবিন্দু তাহরির স্কোয়ার এখন পর্যটকদের সেলফি তোলার জায়গায় পরিণত হয়েছে। মিশরে এখন মৃত্যুদন্ড, গুম, নির্যাতন প্রতিদিনের খবর হয়ে গেছে। যারা আগে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে যুক্ত থাকলেও এখন নিরব হয়ে গেছেন - তারাও এখনো আটক হচ্ছেন। [caption id="attachment_11853" align="aligncenter" width="300"] সিসির শাসনামলে মিশরে অনেক নতু নতুন কারাগার হয়েছে[/caption] সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এখন আক্রান্ত। মিশর হচ্ছে সাংবাদিকদের জেলে পাঠানোর ক্ষেত্রে পৃথিবীতে তৃতীয় স্থানে। [caption id="attachment_11854" align="aligncenter" width="300"] সিসির নির্বাচনী বিলবোর্ড[/caption] মার্চের ২৮ তারিখ মিশরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এতে যারা মি. আল সিসির বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিলেন তারা অযোগ্য ঘোষিত হয়েছেন, কেউ আটক হয়েছেন, কেউ প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। অবশ্য একজন 'প্রতিদ্বন্দ্বী' আছেন - তিনি মধ্যপন্থী মুসা মুস্তাফা মুসা - তাকে সাজানো প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করা হলেও তিনি তা অস্বীকার করেন। অনেকে বলেছেন, এ নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট সিসির সাথে তার ছায়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট সিসির সময় মিশরে ১৭টি নতুন কারাগার নির্মিত হয়েছে, রাজনৈতিক বন্দীর সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার - বলেন মানবাধিকার কর্মীরা। প্রেসিডেন্ট সিসি গত অক্টোবর মাসে বলেছেন, "মানবাধিকারের ব্যাপারে বলতে গেলে বলতে হয়, এটা ইউরোপ নয় - এটা অন্য জায়গা।" তার কথা, মানবাধিকার গ্রুপগুলোর তথ্য বিশ্বাসযোগ্য নয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনেকে মিশরের প্রেসিডেন্ট সিসির মানবাধিকার রেকর্ড দেখেও না দেখার ভান করে। কারণ তিনি উগ্রপন্থীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে একজন মূল্যবান মিত্র।  

এ সম্পর্কিত আরও খবর