প্রাকৃতিক দুর্যোগের নামকরণ কিভাবে হয়

, ফিচার

তানিম কায়সার, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 09:23:47

জানেন কি, স্ত্রীবাচক শব্দে নাম রাখা ঝড়গুলো পুরুষবাচক শব্দে নাম রাখা ঝড়গুলোর চেয়ে পরিমাণে বেশি ভয়াবহ এবং প্রাণঘাতী হয়ে থাকে? যেমন চার্লি নামের ঝড়ের চেয়ে আয়লা নামের ঝড় ছিল বেশি ভয়াবহ। এমনকি স্ত্রীবাচক নামের ঝড়গুলোর জন্য যে পরিমাণ সতর্কতা গ্রহণ করা হয়, পুরুষবাচক নামের ঝড়ের জন্য তেমন প্রস্তুতি নেওয়া হয় না।

হারিকেন বা ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে জানলেও এর নামকরণের কারণ নিয়ে আমরা বেশ বিভ্রান্তিতে পড়ে যাই। কখনো সিডর, কখনো আয়লা, আবার কখনো ক্যাটরিনা নামের ঝড়ের সতর্ক সংকেত দেওয়া হয়। আমরা অনেকেই অবাক হই ঝড়ের এমনসব নাম শুনে। ঝড়ের নামকরণ নিয়ে তৈরি হওয়া সাম্প্রতিক কৌতূহল মেটাতেই আমাদের আজকের এই নিবেদন।

হারিকেনের নামকরণ শুরু হয় ১৯৫০ সাল থেকে। আমেরিকার একদল বিজ্ঞানী ঝড় এবং এর প্রভাব নিয়ে গবেষণার সুবিধার্তে ঝড়ের নামকরণ শুরু করেন। যেহেতু নাম থাকলে কোন ঝড়ে কেমন ক্ষয়-ক্ষতি হলো, কতজন লোকের মৃত্যু হলো, কতজন ঘরহারা হলো এসব হিসেব রাখা সহজ হয়। পাশাপাশি দেখা যায় কোনো একটি এলাকায় কখনো একই সাথে দুটি ঝড় আঘাত হানে। এক্ষেত্রেও কোন ঝড়ের প্রভাবে কী ঘটেছে তা আলাদা করার জন্যেও নামকরণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এজন্যেই আর এভাবেই শুরু হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগসমূহের এমন নামকরণ প্রক্রিয়া।

প্রথমে যে কোনো একটি অক্ষর যেমন A,B,C দিয়ে নামকরণ করা শুরু হয়। কিন্তু একটা সময় গিয়ে এধরনের নামকরণের জটিলতা দেখা দেয়। কেননা সামরিক বাহিনী তাদের নিজস্ব যোগাযোগের জন্যেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করছিল। আর সে কারণেই বিজ্ঞানীরা একটি অক্ষরের বদলে একটি শব্দে ঝড়ের নামকরণ করতে শুরু করে।

মজার ব্যাপার হলো, নামকরণের শুরুর সময় থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত তিন দশকে যতগুলো ঝড় হয়েছে সবগুলোরই নামকরণ করা হয়েছিল স্ত্রীবাচক শব্দে।

এই ধারায় পরিবর্তন আসে ১৯৭৯ সালে। এরপর থেকে মাঝে মাঝে কিছু পুরুষবাচক শব্দেও ঝড়ের নামকরণ শুরু হয়। ২০১৪ সালের একটি গবেষণা থেকে উঠে এসেছে এমনই কিছু চমকপ্রদ তথ্য। সেই গবেষণা থেকে জানা যায়, পুরুষবাচক শব্দে নামকরণকৃত হারিকেন বা ঝড়ের চাইতে স্ত্রীবাচক শব্দে নামকরণ করা হারিকেনগুলো বেশি প্রাণঘাতী ও ভয়াবহ হয়ে থাকে। এমনকি যে সময়টাতে শুধু স্ত্রীবাচক শব্দে ঝড়ের নামকরণ করা হতো তখন ঝড়ের পরিমাণও বেশি ছিল।

ঝড়ের নাম স্ত্রীবাচক শব্দে কেন রাখা হয় এনিয়ে একটি আলাদা গবেষণা পরিচালিত হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। যেখানে প্রায় ৩০ বছরের ঝড়ের বিবরণ থেকে জানা যায়, স্ত্রীবাচক শব্দে নামকরণের সময় থেকেই এসব ঝড় খুব প্রাণনাশক ছিল যেটা পুরুষবাচক নাম রাখার পর অনেকটা কমে গেছে। ব্যাপারটা কাকতালীয়।

গবেষণায় স্ত্রীবাচক নামকরণের ব্যাপারে সে সময়ের গবেষকদের কাছ থেকে জানতে চাওয়া হয়। এবং তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত মন্তব্য থেকে একটি উল্লেখ করা হয়। যেখানে বলা হয়—“যেহেতু ঝড় ‘আনপ্রেডিক্টেবল’, একে নিয়ে খুব বেশি অনুমান করা যায় না। একইভাবে মেয়েরাও ‘আনপ্রেডিক্টেবল’, সেহেতু শুরুর দিকে ঝড়ের নামকরণ করা হতো মেয়েদের নামে।”

এটি কয়েকজন গবেষকের ব্যক্তিগত মতামত। কিন্তু এর বাইরেও আরো কিছু উল্লেখযোগ্য বিষয় উঠে আসে গবেষণায়। বলা হয়, স্ত্রীবাচক শব্দে রাখা ঝড়গুলোকে মানুষ খুব সিরিয়াসলি নেয়। এগুলো নিয়ে আলোচনা হয় বেশি। অপরদিকে পুরুষবাচক শব্দে নাম রাখা ঝড়কে মানুষ খুব একটা গুরুত্ব দেয় না। এটা নিয়ে খুব বেশি একটা আলোচনাও হয় না।

প্রমাণ হিসেবে বলা যায় যায়, আয়লা কিংবা ক্যাটরিনা নামের ঝড়গুলো নিয়ে যতটা আলোচনা হয়েছে, স্যান্ডি কিংবা এলোয়েজ নামের ঝড়গুলো নিয়ে সেই পরিমাণ কোনো আলোচনা হতে দেখা যায়নি। এছাড়াও ঠিক সেই সময়টাতেই নারীর ক্ষমতায়ন এবং বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্যের প্রচার ও প্রসারের জন্য স্ত্রীবাচক শব্দ ব্যবহার করা শুরু করেছিল। প্রাকৃতিক দুর্যোগের স্ত্রীবাচক নামকরণের পেছনে এই বিষয়টিকেও অন্যতম একটি বৃহৎ কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

বলা বাহুল্য, গবেষণার প্রতিবেদন করা সাংবাদিকদের পক্ষে সত্যিই জটিল ছিল কোন বিষয়টি সত্য তা নির্ণয় করা। কেননা গবেষণার প্রতিটি অংশেই এমন কিছু বিষয় আছে যাকে মিথ্যা বলার কোনো অবকাশ নেই। উদাহরণ স্বরূপ ঐতিহাসিক এসব তথ্য বিশ্লেষণের পরে, গবেষকরা একটি নিয়ন্ত্রিত ল্যাব সেটিংয়ে চলে গিয়েছিলেন এবং বেশ কয়েকজন অংশগ্রহণকারীদের কিছু নাম দিয়েছিলেন। তাদেরকে বলা হয়েছিল কেবলমাত্র প্রদত্ত নামের ওপর ভিত্তি করে ঝড়ের তীব্রতা অনুমান করে নির্ধারণ করার জন্য। এখানে, তাদের অনুমানের বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছিল। লোকেরা স্ত্রীবাচক নামের ঝড়গুলোকে পুরষবাচক ঝড়গুলোর চেয়ে বেশি বিপজ্জনক হিসাবেই মতামত প্রকাশ করেছে।

কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের “Risk Communication” বিভাগ এই গবেষণাটি প্রকাশের পর ওয়াশিংটন পোস্ট এই ব্যাপারে আরো গবেষণা করতে উৎসাহিত হয়। তারাও উল্লেখ করেছে, যদিও এখানে কিছু চমকপ্রদ তথ্য এসেছে তবে এটাই শেষ কথা নয়। বরং এ ব্যাপারটি আরো বৃহৎ গবেষণার দাবি রাখে।

তবে পুরো রিপোর্টে সবশেষ যে কথাটি উল্লেখ করা হয় তা-ই আসলে সবচেয়ে জরুরি। সেখানে বলা হয় ঝড়ের নাম দেখে গুরুত্ব বা অবজ্ঞা নয়, বরং সতর্ক সংকেত ও পূর্বাভাস অনুযায়ীই ঝড়কে গুরুত্ব দিতে হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর