তৈমুর লঙ : ঘোড়ার পিঠে বিশ্ববিজয় (পর্ব-২)

, ফিচার

আহমেদ দীন রুমি, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 20:15:50

 ● পর্ব-১ পড়তে ক্লিক করুন

১৩৮৬ সাল। ক্ষমতায় আরোহণের দেড় দশক পেরিয়ে গেছে তৈমুরের। একসময়ের সর্বস্বহারা যাযাবর ব্যক্তিটি নিজের যোগ্যতা দিয়ে পরিণত হয়েছেন ছোটখাটো এক রাজ্যের অধিপতিতে। কিন্তু অল্পে তুষ্ট হওয়া তৈমুরের স্বভাবে ছিল না। তাই পুনরায় অভিযানে বের হলেন। রক্তাক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলো আজারবাইজান এবং জর্জিয়ার ওপর। হাতে এলো গিলান, শিরওয়ান এবং লেসজিওয়ানের মতো পার্শ্ববর্তী বহু অঞ্চল।

কারা কুয়ুনলু বংশের ক্ষমতা তখন কারা ইউসুফের হাতে; রাজধানী ভ্যান। অপরিণামদর্শী এই শাসক তৈমুরের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়লে তৈমুর তাকে পরাজিত করে রাজধানী দখল করেন। কারা ইউসুফ পলায়ন করে আশ্রয় নেয় অটোম্যান সুলতান প্রথম বায়েজিদের দরবারে। তৈমুর কিন্তু থেমে থাকলেন না। তৎকালীন মুজাফফারীয় বংশ শাসন করছিল ফারস্- অঞ্চলকে কেন্দ্র করে। শাসনকর্তা জয়নুল আবেদিনকে বশ্যতা স্বীকার করার আহবান জানিয়ে পত্র প্রেরণ করলেন তৈমুর।

নিষ্ঠুরতার অবতার

জয়নুল আবেদিন তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটি মনে হয় এবার করলেন। তিনি তৈমুরের দূতকে বন্দী করে রাখলেন। অপমান মনে করে তৈমুর আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিলেন মূল নগরী ইসপাহান। একরকম বিনাযুদ্ধে দখল করে নিলেন তা। বাড়িয়ে দিলেন করের পরিমাণ; কিন্তু শীঘ্রই বিদ্রোহী হয়ে উঠল জনগণ। অতর্কিত আক্রমণে হত্যা করা হলো তৈমুরের তিন হাজার সৈন্যকে। নিহতদের মাঝে তৈমুরের প্রিয় আমীরও ছিলেন।

যুদ্ধের মাঠে তৈমুরের নিষ্ঠুরতা প্রবাদকেও হার মানায়


ক্ষোভে উন্মত্ত হয়ে উঠলেন তৈমুর। বের করলেন তার সবচেয়ে নৃশংস রূপ; যা ইতিহাসে ভীতি তৈরি করে রেখেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। প্রত্যেকটি সৈন্যকে নির্দেশ দেয়া হলো, খণ্ডিত মাথা নিয়ে ফিরে আসতে। অনুগত সৈন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়ল ইসপাহানবাসীর ওপর। চলল নির্বিচার গণহত্যা। এই হত্যাকাণ্ডে প্রায় সত্তর হাজার ইসপাহানবাসী নিহত হন। মৃতের মাথা দিয়ে তৈরি করা হলো সুউচ্চ মিনার। প্রতিশোধ নিয়ে তৈমুর উদাহরণ সৃষ্টি করলেন—তার সাথে টক্কর দেবার পরিণাম কেমন হতে পারে।

হাফিজ ও তৈমুর: কবি বনাম সম্রাট

নৃশংসতা দেখে ভয়ে মাজাফফারীয় বংশের সকল যুবরাজ আত্মসমর্পণ করল। কেবল শাহ মানসুর পালিয়ে আত্মগোপন করতে সমর্থ হয়। তৈমুর সেখান থেকেই রওনা হলেন সিরাজ দখল করার প্রত্যাশায়। একরকম বিনা বাধায় নিয়ন্ত্রণে এলো সিরাজ। মসজিদে মসজিদে শুক্রবারে তার নামে পঠিত হতে থাকল খোৎবা। ঠিক এই সময়েই দেখা মেলে বিখ্যাত কবি হাফিজের। প্রচলিত আছে, হাফিজের একটি কবিতার প্রতি তৈমুর আকৃষ্ট হয়ে তাকে দরবারে আহবান করেন। কবিতাটি ছিল—
“আগার আঁতুরকে সিরাজী বাদসত্ আরাদ্ দেলে মারা,
বাখালে হিন্দুয়াশ বো বোখশাস্ সমরকন্দ ও বুখারা রা;”
বা,
“সিরাজবাসিনী প্রিয়ার গালের ছোট্ট এক তিলের তরে
বোখরা-সমরকন্দ রাজ্য নির্দ্বিধাতে আসব ছেড়ে।”

ফারসি সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা কবি হাফিজ


তৈমুর হাফিজের প্রতি কটাক্ষের চাহনিতে বলেছিলেন—“আমি এত যুদ্ধ আর এত রক্ত ঝরিয়ে বোখরা আর সমরকন্দকে প্রতিষ্ঠিত করেছি অপার সৌন্দর্য দিয়ে। আর তুমি কিনা কোথাকার কোন মেয়ের জন্য এই সবকে অপমান করো কবিতায়!” হাফিজ পরিস্থিতি টের পেয়ে অসংকোচে বললেন, “দূরদৃষ্টিহীনতার জন্যই তো আজ আমার এই দুর্দশা। এজন্যই আপনি রাজা আর আমি কবি।” বুদ্ধিদীপ্ত জবাবে তৈমুর চমৎকৃত হয়ে তাকে পুরস্কৃত করলেন।

চোখ এবার রাশিয়ায়

পারস্য বিজয় সম্পন্ন হলে তৈমুরের নজর পড়ল গোল্ডেন হোর্ড সাম্রাজ্যের দিকে। ঠিক এই সময়টাতে গোল্ডেন হোর্ডের শাসক ছিলেন মামাই। অন্যদিকে হোয়াইট হোর্ডের শাসনকর্তা ছিলেন উরুস খান। তৈমুর একটা সুযোগ খুঁজছিলেন মাত্র। সেই সুযোগটাই এনে দিল ক্রিমিয়ার মোঙ্গল সামন্তরাজ তকতামিস। গোল্ডেন হোর্ড থেকে পালিয়ে এসে তিনি তৈমুরের আশ্রয় আর সহযোগিতা চাইলেন।

চেঙ্গিস খানের এই বংশধরকে তৈমুর প্রথমে আশ্রয় দিলেন; অতঃপর উরুস খানের দখল থেকে উদ্ধার করতে সাহায্য করলেন। পরপর দুইবার সংঘর্ষ চালিয়েও তকতামিস তার কাছে পরাজিত হয়েছিল। তবে ইতোমধ্যে উরুস খানের মৃত্যু ঘটলে তকতামিসই গোল্ডেন হোর্ডের উত্তরাধিকারীতে পরিণত হলেন। অভিযান চালিয়ে মামাইকে পরাজিত করে রাজধানী সরাই দখল করলেন তিনি।

তকতামিরে অপরিণামদর্শী আচরণই তার পতন ডেকে আনে


তকতামিস ক্ষমতায় এসেছিল তৈমুরের সহযোগিতায়। তথাপি সিংহাসনে বসার পর স্বেচ্ছাচার শুরু করে দিল। প্রকাশ পেতে থাকল চারিত্রিক অন্ধকার দিকগুলো। যাদের সহযোগিতায় তকতামিস রাজ্য পেয়েছে, সেইসব সামন্ত রাজাদের কাছেই কর দাবি করে বসলেন তিনি। অনেকেই দাবি মেনে নিতে অস্বীকার করায় দগ্ধ এবং বিধ্বস্ত করে ফেললেন মস্কো। এই ঘটনার পর তকতামিসের দম্ভ বেড়ে গেল আরো কয়েকগুণ। তৈমুরের অবদানের কথা ভুলে গিয়ে আক্রমণ করে বসলেন তাব্রিজ।

পীপিলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে। তকতামিসও বেড়ে গিয়েছিল অনেক বেশি। তাব্রিজ আক্রমণের পর দশদিন ধরে লুটপাট ও হত্যাকাণ্ড চালানো হলো। বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি হস্তগত করে ফিরে গেল মোঙ্গল নেতা। সংবাদ শুনে মর্মাহত তৈমুর তাকে একটা শিক্ষা দেবার স্থির সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রায় দুই লাখ সৈন্যসমেত আক্রমণ করলেন গোল্ডেন হোর্ড সাম্রাজ্যে। তকতামিসের হাড়ে কাঁপুনি লাগল এবার। তৈমুরের কাছে পাঠালেন সন্ধির প্রস্তাব।

কিন্তু তৈমুর ভালোমতোই বুঝতে পেরেছিলেন তকতামিসের দুরভিসন্ধি। তাই শত্রুর শেষ রাখতে নেই-মন্ত্রেই স্থির থাকলেন। ভল্গা নদীর সন্নিকটে তেরেক নামক স্থানে তুমুল যুদ্ধ হলো দুই বাহিনীর মধ্যে। পরাজিত হয়ে পলায়ন করলেন তকতামিস। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, এই যুদ্ধে প্রায় এক লাখ সৈন্য হতাহতের ঘটনা ঘটে। একজন মোঙ্গল নেতাকে শাসনকর্তা নিযুক্ত করে বিজয়ী তৈমুর ফিরে আসেন। কিন্তু বছর তিনেক পরেই তকতামিস আবার সৈন্য সংগঠিত করে আক্রমণ করে বসে। এবার আর তৈমুর থামলেন না। নেহায়েত অপ্রস্তুত থাকার পরেও রণনিপুণতার মধ্য দিয়ে পরাজিত করলেন তকতামিসকে। আর এর মধ্য দিয়ে দেড়শত বছরের গোল্ডেন হোর্ড সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটল। তকতামিসের বাহিনীর অর্ধেক যোগ দিল তৈমুরের সাথে, আর অর্ধেক পালিয়ে গেল ক্রিমিয়া, আদ্রিয়ানোপল ও হাঙ্গেরির বিভিন্ন স্থানে।

আরো একবার পারস্য

১৩৯২ সাল। পারস্যের রাজনৈতিক অবস্থায় তখন সংকট চলছে। তৈমুর বিষয়টা লক্ষ্য করেই অস্ত্রাবাদ ও আমুলের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করে খুররামাবাদ, শুসতার এবং কালাসফিদ দখল করে নিলেন। গত অভিযানে পালিয়ে বেঁচে যাওয়া মুজাফফারীয় যুবরাজ শাহ মনসুর চার হাজার সৈন্যসহ তার গতিপথ রোধ করে দাঁড়াল। তৈমুরের ত্রিশ হাজার সৈন্যের সামনে প্রবল সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেও পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হলেন। শাহ মনসুরকে বন্দী এবং হত্যা করা হয় পরের বছর ১২৯৩ সালে। সিরাজের ওপর প্রতিষ্ঠিত হলো তার একচ্ছত্র আধিপত্য।

এই দফায় সিরাজ আর বাগদাদ তার নিয়ন্ত্রণে এলো


সিরাজের পর বাগদাদকে পদানত করাটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। বিশেষ করে তাকরিত দুর্গে হাসান নামের এক দস্যু সর্দার বেশ উপদ্রব করছিল। তৈমুর তাকরিত দখল করে তার সমস্ত অধিবাসীকে হত্যার আদেশ দিলেন। আর সেই সাথে অধিকারে আনলেন কালাত নামের আরো একটি দুর্গ।

বিচ্ছিন্ন অভিযাত্রা

১৩৯৪ সালে তৈমুর নিজের অভিযাত্রার গতিমুখ ঘোরান মস্কোর দিকে। সীমাহীন ধ্বংস আর হত্যার মধ্য দিয়ে দখল করেন ককেশাস অঞ্চলের অস্ত্রাখান। তারপর একে একে অধিকারে এলো সমুদ্র তীরবর্তী ভেনিস, জেনোয়া, বাস্ক, কাটান প্রভৃতি নগরগুলিও। হাজির হলেন বিস্তৃত সাইবেরিয়া পেরিয়ে আলবুর্জ পর্বতমালার কাছে। এই বিজয়ের পর তার কাছে পদানত হলো উত্তরাঞ্চল, উরাল, কাস্পিয়ান সাগর, পারস্য ও ককেশাস।

তৈমুর পরিণত হলেন পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যের অধিকর্তা হিসাবে


এই মুহূর্তে তৈমুর কোনো নামমাত্র রাজা নয়; ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে থাকা এক পরিণত সম্রাট। যিনি বাকি পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে আছেন নিজের হাতের মুঠোতে আনার জন্য। তখনও ভারত এবং অটোম্যান সাম্রাজ্যের সাথে সংঘর্ষ বাকি। তখনও বাকি তার রূপকথাতে পরিণত হওয়ার আখ্যান। সেই গল্প হবে পরবর্তী পর্বে।

● পর্ব-৩ পড়তে ক্লিক করুন

এ সম্পর্কিত আরও খবর