চলছে ‘খুনের বদলা খুন’!

বিবিধ, ফিচার

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-30 21:07:26

পাকিস্তানের ক্ষেত্রে একই ধর্মের অনুসারী হয়েও পারত পক্ষে, শিয়ারা সুন্নিদের এবং সুন্নিরা শিয়াদের মসজিদে প্রার্থনার্থে গমন করে না। কিছু কিছু স্পর্শকাতর ও উত্তেজক পরিস্থিতিতে শিয়া-সুন্নি সম্প্রদায়ের লোকজন একে অপরের পাড়া, মহল্লা, এলাকা এড়িয়ে চলাচল করে। নিরাপত্তার খাতিরে এমন আচরণ করা হয় উভয় সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকেই।

বৈবাহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও শিয়া-সুন্নিদের মধ্যে পার্থক্য আছে। উভয় সম্প্রদায়ের আলেম ও নেতৃবৃন্দ শিয়া-সুন্নি বিয়ের বিরোধিতা করেন। হারাম বা নিষিদ্ধ না বলা হলেও পাকিস্তানে শিয়া-সুন্নি বিয়েকে উভয় সম্প্রদায়ই নিরুৎসাহিত করে।

পরিচিতি ও ব্যক্তির নামকরণের ক্ষেত্রেও শিয়া-সুন্নি পার্থক্য রয়েছে। সুন্নিদের নাম সাধারণ মুসলিম নামের আদলে রাখা হলেও শিয়ারা এক্ষেত্রে বিশেষ বিশিষ্টপূর্ণ। শিয়াদের মধ্যে আলী, হাসান, হোসাইন, জাফর, আব্বাস, জাফরি, রেজা, রিজভি, নকভি, আলাভি, জায়েদ ইত্যাদি নাম ব্যাপকভাবে রাখার প্রচলন আছে।

তবে নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যে এবং চেহারা ও আকৃতিগত কাঠামোতে একমাত্র 'হাজারা' জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরা ছাড়া অন্য শিয়াদেরকে সুন্নি সম্প্রদায়ের মানুষ থেকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায় না। হাজারাদের মধ্যে মঙ্গোলিয়-তুর্কিস্থানি চেহারা ও গড়ন দৃশ্যমান হওয়ায় কেবল তাদেরকেই অপরাপর পাকিস্তানিদের চেয়ে আলাদা করা যায়।

ইসলামাবাদ রাজধানী হলেও পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় শহর করাচি, যেখানে ২০ মিলিয়ন মানুষ বসবাস করে। সেখানে শিয়া ও সুন্নি জনগোষ্ঠীর আলাদা অবস্থান স্পষ্টভাবেই চোখে দেখা যায়। করাচির স্থানীয় সিন্ধি-মুহাজির (ভারত প্রত্যাগত বিহারি) দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মতো শিয়া-সুন্নি সমস্যাও একটি প্রকট সমস্যা।

করাচির শিয়ারা মূলত ‘হাজারা শিয়া’ সম্প্রদায়ভুক্ত, যারা মহানগরের বিশেষ বিশেষ কিছু এলাকায় বসবাস করে। করাচির আব্বাস টাউন, হোসেইন হাজারা ঘাট, মুঘল হাজারা ঘাট, রিজভিয়া, আনকোলি, ডিএইচএ গিজরি, পাক কলোনি ও মাঙ্গোপির এলাকাগুলো শিয়া বসতি রূপে চিহ্নিত। করাচির জনসংখ্যার সিংহভাগ মুহাজিরদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শিয়া রয়েছে।

আন্তঃমুসলমান বিবাদের বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের শিয়া-সুন্নি সংঘাতটি বেশ পুরনো সমস্যা। যদিও বর্তমানে পাকিস্তান থেকে সিরিয়া, ইয়েমেন পর্যন্ত শিয়া-সুন্নি লড়াই বিস্তৃতি লাভ করেছে, যার কারণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র এবং ইরানের ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হয়।

পাকিস্তানের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, কয়েকটি ধাপে শিয়া-সুন্নি বৈরিতা বাড়তে বাড়তে চরম আত্মঘাতী ও মারাত্মক রক্তাক্ত আকার ধারণ করেছে।

পাকিস্তানে শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে প্রথম বড় ধরনের উত্তেজনা সৃষ্টি হয় ১৯৭৯ সালে, যখন ইরানের শিয়াপন্থীরা আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে বিপ্লবের মাধ্যমে দেশটির ক্ষমতা দখল করে। পাকিস্তানের সঙ্গে ইরানের ৯০৯ কিলোমিটারের সীমান্ত এবং পাকিস্তানের প্রচুর শিয়ার বসবাস থাকায় ইরান বিপ্লবের প্রভাব বেশ স্পষ্টভাবেই দেখা যায়। ইরানের বৈপ্লবিক মতাদর্শে শিয়ারা নানা ক্ষেত্রে সংগঠিত হতে থাকে, যা সংখ্যাগুরু সুন্নিরা ভালোভাবে গ্রহণ করেনি।

শিয়া উত্থানের এমন সময় পাকিস্তানের ক্ষমতা দখলকারী, কট্টর সুন্নি মতাবলম্বী সামরিক জান্তা জেনারেল জিয়াউল হক সুন্নিদের পৃষ্ঠপোষকতা দিতে থাকেন। সৌদি আরবও পাকিস্তানে শিয়া উত্থান ঠেকাতে সুন্নিদের সাহায্য করে।

উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সে সময় প্রচুর অর্থ বিদেশ থেকে আসে। যা দিয়ে প্রচার-প্রচারণা, সংগঠন গড়ে তোলা ও বই-পুস্তক প্রকাশ করা হয়। পাকিস্তানের রাজনীতিতে 'পেট্রোডলার' শব্দটি তখন জোরেশোরে শোনা যায়। তখন ইসলাম ধর্মকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের জন্য নানা দল, গ্রুপ ও ব্যক্তিকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে মাঠে নামানো হয়।

এ সময় শিয়া ও সুন্নিদের অনেকগুলো সংগঠন গড়ে উঠে এবং এগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে প্রচারণা ও কার্যক্রম গ্রহণ করে। কোনও কোনও সংগঠন স্বাভাবিক কাজের বদলে উগ্র ও জঙ্গি ভাবাপন্ন মনোভাব নিয়ে মাঠে নামে। ফলে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিচ্ছিন্ন আকারে উত্তেজনা ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

প্রায় একই সময়ে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান দখল করলে পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ায় মুসলিম প্রতিরোধ গড়ে ওঠে, যার নেতৃত্বে ছিল সুন্নি মুজাহিদরা। লড়াইয়ের এক পর্যায়ে মুজাহিদদের শিয়া গোষ্ঠী ‘নর্দান অ্যালায়েন্স’কে ইরান সমর্থন করে এবং সোভিয়েত বিরোধী মুজাহিদদের মধ্যে শিয়া-সুন্নি মেরুকরণ হয়।

আফগানিস্তানকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা মুজাহিদ গ্রুপগুলোর নিরাপদ আশ্রয়স্থল ছিল পাকিস্তান। প্রশিক্ষণ ও লোক সংগ্রহের ক্ষেত্রেও মুজাহিদরা পাকিস্তানের ওপর নির্ভরশীল ছিল। শিয়া ও সুন্নি মুজাহিদ গ্রুপগুলো নিজ নিজ সম্প্রদায়ের লোকদের রিক্রুট করে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে অস্ত্র ধরিয়ে দেয়। তারা যুদ্ধ শেষে নিজ নিজ সম্প্রদায়কে মতাদর্শিক দিক দিয়ে প্রভাবিত করে। ফলে পাকিস্তানেও শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়ে।

পরবর্তীতে ইরাক ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধের সময়ও বিশ্বব্যাপী শিয়া-সুন্নি মেরুকরণের প্রভাব পাকিস্তানে দেখা যায়। আরো পরে, পাকিস্তানে শিয়া-সুন্নি সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করে আফগানিস্তানে তালেবান প্রাধান্য বৃদ্ধির সময়কালে।

তখন পাকিস্তান থেকে আফগানিস্তানে যেতে সুন্নি তালেবানরা সীমান্তবর্তী শিয়া গ্রামগুলোকে কৌশলগত কারণে দখল করে। শিয়ারাও নিজেদের আত্মরক্ষার্থে সশস্ত্র হয়। পরিণতিতে আন্তঃলড়াই হতাহতের রক্তাক্ত পথে তীব্র বিবাদে রূপ নেয়। এমনকি, প্রত্যন্ত অঞ্চলের সেক্টারিয়ান ক্ল্যাশ বা গোত্রীয় সংঘাত শহর-বন্দরে বসবাসকারী শিয়া-সুন্নিদের নাগরিক সমাজের মধ্যেও ছড়িয়ে যায়।

আরও পড়ুন: জন্ম থেকে সংঘাতের চারণভূমি

এ সম্পর্কিত আরও খবর