ভারতীয় ধনকুবেরদের উত্তরাধিকার পরিকল্পনা!

, ফিচার

ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম | 2024-04-04 17:23:52

পারিবারিক ব্যবসা ভারতীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড। দেশটির জিডিপির প্রায় ৭৫ শতাংশেরও বেশি অবদান রাখে এসব ব্যক্তি মালিকানাধীন তথা পারিবারিক ব্যবসায়গুলো। আম্বানি, আদানি, বিরলাসহ এমন বড় বড় ব্যবসায় সাম্রাজ্যের উদাহরণ রয়েছে ভারতে।

সম্প্রতি ব্লুমবার্গ বিলিয়নেয়ার্স ইনডেএক্সের এক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতে এমন ১০টি পারিবারিক ব্যবসায় রয়েছে যাদের সমষ্টিগতভাবে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ৩৮২ বিলিয়ন ডলার। আর ইতিমধ্যেই এসব পরিবারের ৪০ বছর বা তার কম বয়সী উত্তরাধিকাররা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অবস্থান করছেন।

যদিও ভারতের পারিবারিক ব্যবসার জন্য বিরাট সুযোগ সামনে রয়েছে। আর এ ব্যবসায়ের পরিমাণ অভূতপূর্ব হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে পারিবারিক ব্যবসায় টিকে থাকার ক্ষেত্রেও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। পারিবারিক ব্যবসায় টিকে থাকার পেছনে কিছু কারণ রয়েছে এগুলো হল আর্থিক অব্যবস্থাপনা, পারিবারিক দ্বন্দ্ব এবং মতবিরোধ, বাহ্যিক কারণ যেমনঃ সরকারী নীতি বা প্রতিযোগিতা, নেতৃত্বের সমস্যা ইত্যাদি। অনেক পারিবারিক ব্যবসায় টিকে থাকতে না পারার একটি বড় কারণ হল উত্তরাধিকার পরিকল্পনা।

উত্তরাধিকার পরিকল্পনা হল বর্তমান মালিকদের কাছ থেকে ব্যবসার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য একটি ব্যবসার মূল অবস্থানের উত্তরসূরিদের শনাক্তকরণ এবং বিকাশ করার প্রক্রিয়া। এটি ব্যবসার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করে, পরিবারের মধ্যে দ্বন্দ্ব এড়াতে সাহায্য করে এবং পরিবারের উত্তরাধিকার সংরক্ষণে সহায়তা করে। আম্বানি, আদানিরা পারিবারিক দ্বন্দ্ব এড়াতে সম্পদের উত্তরাধিকার নকশা অনুযায়ী সম্পদ বণ্টনের পরিকল্পনা করে থাকেন।

আর ঠিক এ কারণেই চীনের ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যবসায়ের উত্তরসূরী থেকে ভারতীয় উত্তরাধিকার পরিকল্পনা অনেকটাই সফল।

এই উত্তরাধিকার পরিকল্পনা ও সম্পদের ব্যবধান দুই দেশের ভিন্ন ভিন্ন অর্থনৈতিক গতিপথকে প্রতিফলিত করে। যদিও দুর্বল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে চীনা স্টকগুলো হ্রাস পেয়েছে। এতে দেশটির বিলিয়নেয়ারদের ভাগ্যেও অন্ধকার নেমেছে। কিন্তু ভারতের পারিবারিক ব্যবসায়ের সফলতার দীর্ঘমেয়াদী সম্ভাবনায় আশা বাড়ছে এবং এর ইক্যুইটি বর্তমানে সর্বকালের আর্থিক উচ্চতায় লেনদেন করছে।

এতে করে ভারতীয় অর্থনীতির প্রসারিত হওয়ার পাশাপাশি ই-কমার্সের মতো নতুন নতুন ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য এসেছে।

বিশ্বের জনবহুল দেশেগুলোর বেশিরভাগই তাদের ব্যবসায়ে অল্প বয়স্ক ভোক্তাদেরকে টার্গেট করে পরিচালনা করে থাকেন। এছাড়া এসব ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের পিতৃপুরুষরা তাদের সন্তানদের যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে গড়ে তুলতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠান।

উদাহরণ হিসেবে বিরলাদের কথাই বলা যায়। বিরলা গ্রুপ অব ইন্ডাষ্ট্রিজ ভারতের প্রাচীনতম ব্যবসাগুলোর মধ্যে একটি। এটি ভারতের প্রাক-স্বাধীনতার যুগে ১৬৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে পরিচালিত হয়ে আসছে। সম্প্রতি বিরলা পরিবারের বর্তমান পিতৃপুরুষ কুমার মঙ্গলম বিরলা তার উত্তরাধিকারী গায়িকা অনন্যা এবং প্রাক্তন ক্রিকেটার আর্যমান বিক্রমকে তাদের ব্যবসায়ের তিনটি বোর্ডের দায়িত্ব দিয়েছেন। সে সময় কুমার মঙ্গলম বিরলা বলেছিলেন, নতুন-যুগের ব্যবসায়িক মডেল সম্পর্কে জানতে এবং ভোক্তাদের আচরণ পরিবর্তনে এই বোর্ড নতুন শক্তি জোগাবে।

এখানে একটা বিষয় উল্লেখ্য, ভারতে পারিবারিক ব্যবসায়ের প্রতিষ্ঠাতারা ৫০ শতাংশের বা তারও বেশি মালিকানা নিজের নামে রাখে। আর পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্যদের প্রতিষ্ঠানের বোর্ড অব মেম্বার হিসেবে নিয়োগ দিয়ে পরবর্তী উত্তরসূরী হিসেবে গড়ে তোলে। এটা এখানে খুব স্বাভাবিক একটি অগ্রগতি হিসাবে দেখা হয়। কিন্তু পাবলিক প্রতিষ্ঠানের বোর্ডে এমন কম বয়সীদের নিয়োগ দেয়াকে কর্পোরেট শাসনের লঙ্ঘন বলে বিবেচনা করা হয়।

উত্তরাধিকার পরিকল্পনার বিষয়ে আরেক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ ভারতের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি মুকেশ আম্বানি। উত্তরাধিকার পরিকল্পনার গুরুত্ব আম্বানিরা সবচেয়ে ভালো জানেন।

সম্পদের উত্তরাধিকার নকশা অনুযায়ী, মুকেশ আম্বানির দুই সন্তান সামলাবেন রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের টেলিকমিউনিকেশন ও রিটেইল ব্যবসা। আর ছোট সন্তান সামলাবেন জ্বালানি ব্যবসা। তারা ইতিমধ্যে ব্যবসা সামলানোর কাজ শিখছেন।

অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা এড়াতেই আগেভাগে মুকেশ তার সম্পদের উত্তরাধিকার নকশা করে সম্পদ বণ্টনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কারণ, রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের প্রতিষ্ঠাতা ধীরুভাই আম্বানির মৃত্যুর আগে সম্পত্তির কোনো উইল করে যাননি। এ কারণে তার দুই ছেলে মুকেশ ও অনিল আম্বানির মধ্যে পৈতৃক ব্যবসা নিয়ে বিরোধ শুরু হয়। এ নিয়ে আইনি লড়াইয়ে নামেন দুই ভাই। পরে অবশ্য দুই ভাইয়ের সম্পর্কের উন্নতি হয়। এসব ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়েছেন মুকেশ। নিজের সন্তানদের মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে যেন কোনো বিরোধ না বাধে, এই ভাবনায় তিনি উত্তরাধিকার নকশা করার সিদ্ধান্ত নেন।

রিলায়েন্স গ্রুপে ইশা আম্বানিকে নেতৃত্বের পর্যায়ে নিয়ে আসাকে অনেকেই ইতিবাচকভাবে দেখছেন। দেশটিতে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে নেতৃত্বের পর্যায়ে নারীদের যাওয়ার খুব একটা নজির নেই। দুই দশক ধরে তা কেবল শুরু হয়েছে। ভাইদের সঙ্গে ইশার সমঅধিকারের বিষয়টি তাই একটা নজির হয়ে থাকবে। তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, মেয়েদের এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে আরও অনেক দূর যেতে হবে।

হায়দ্রাবাদের ইন্ডিয়ান স্কুল অফ বিজনেসের টমাস শ্মিডিনি সেন্টার ফর ফ্যামিলি এন্টারপ্রাইজের একজন অধ্যাপক কাভিল রামচন্দ্রন এটিকে মেক-অর-ব্রেক পরিস্থিতি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তার মতে, অনেক উত্তরাধিকারীরই বড় কোন চাকরি কিংবা পেশাদার ট্র্যাক রেকর্ড থাকে না। তারা কেবল পারিবারিক সফলতার মই বেয়ে উপরে উঠে যায়। কিন্তু তার এ মন্তব্যের দ্বিমতও রয়েছে। অনেকেই এটাকে পারিবারিক উত্তরাধিকার পরিকল্পনার সফল প্রয়োগ হিসেবে বিবেচনা করেন।

এমনকি অতীতেও দেখা যায় সমস্ত রাজবংশই তাদের পরবর্তী প্রজন্মের সদস্যরা কীভাবে তাদের পরম্পরাকে ধরে রাখবে, কি ধরনের ভূমিকা পালন করে তা ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করে। তারা তাদের সিনিয়রদের উদ্যোক্তা নেতৃত্ব এবং সাফল্য ধরে রাখতে পারে কিনা তা দেখার জন্য তাদেরকে সুযোগ দেয়া হয় এবং যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে গড়ে তোলা হয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর