প্যারিসের দেওয়ালে উৎকীর্ণ ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’!

, ফিচার

মায়াবতী মৃন্ময়ী, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2024-02-26 19:36:51

বসন্তের সাথে ভালোবাসার আছে এক মধুর সম্পর্ক, আর ভালোবাসার সাথে প্যারিসের। সে কারণে প্যারিসকে বলা হয় 'ভালোবাসার শহর', যার পরতে পরতে মিশে আছে সীমাহীন সৌন্দর্য! দিগন্তময় ভালোবাসা! অযুত হৃদয়ের অনুভূতি আর নিযুত স্বপ্ন! তিন শতাধিক ভাষায় লেখা- ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ উৎকীর্ণ করে ভালোবাসার শহর প্যারিসের এক নান্দনিক প্রাচীর জানাচ্ছে ভালোবাসার অন্তহীন বার্তা।

প্রকাণ্ড দেওয়ালের ওপর হস্তাক্ষরে লেখা অজস্র বাক্য- 'আমি তোমাকে ভালবাসি'! অবশ্য সেগুলো বিভিন্ন ভাষায় লেখা। বর্ণমালা কিংবা হরফের ব্যবহার করা হয়েছে, শৈল্পিক বিন্যাসে। অজানা অজস্র ভাষার ভিড়ে নজর কাড়ে একটি বাংলা বাক্যও- ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’!


ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস শিল্পের পাশাপাশি রোমান্সেরও কেন্দ্রবিন্দু। সেই রোমান্সের শহরের মন্টমার্ত্রে আবেসেস উদ্যানেই রয়েছে এই আশ্চর্য দেওয়াল, যা পরিচিত ‘লে মুর দেস জে টা’ইমে’ নামে; যার অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘দ্য ওয়াল অব আই লাভ ইউ’স’ (The Wall Of I Love You's) বা ‘ভালোবাসার প্রাচীর’।

মন্টমার্ত্রে আবেসেসের কেন্দ্রে অবস্থিত এই প্রাচীরে লিখিত রয়েছে কেবলমাত্র একটি বাক্যই লেখা- ‘আই লাভ ইউ’ বা ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’! ৪০ বর্গ মিটারের এই দেওয়ালে সবমিলিয়ে এই বাক্যটিই লেখা তিন শতাধিক ভাষায়। এছাড়াও বহু উপভাষায় এই বাক্যের বিবরণ লিপিবদ্ধ করা আছে। সব মিলিয়ে সেখানে ‘আই লাভ ইউ’ খোদাই করা হয়েছে সহস্রাধিকবার।


কেন এমন অদ্ভুত নামকরণ, সে কারণটিও বেশ চমকপ্রদ। একজন ফরাসি শিল্পী এর উদ্যোক্তা। নাম- ফ্রেডরিক ব্যারন। পরবর্তীতে এই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন আরেক ফরাসি শিল্পী ক্লেয়ার কিটো। প্রাথমিকভাবে উদ্যোক্তাদের এমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না। কারণ, ফ্রেডরিক আদ্যোপান্ত আমুদে মানুষ ও সংগ্রাহক। একদিন স্কুলের দেওয়ালে বা টেবিলে পেন বা কম্পাস দিয়ে ভালোবাসার চিহ্ন খোদাই করার আদলে শুরু করেন ফ্রেডরিক। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় ‘আই লাভ ইউ’ বাক্যটি সংগ্রহ করা এক প্রকার নেশা হয়ে দাঁড়ায় তাঁর কাছে।


প্রাথমিকভাবে পাড়া-প্রতিবেশীদের থেকেই বিভিন্ন ভাষায় লেখা ‘আই লাভ ইউ’ বাক্যটি সংগ্রহ করতেন ফ্রেডরিক। পরবর্তীতে প্যারিস নগরীতে ঘুরতে আসা ভিন দেশের পর্যটকদের দ্বারস্থ হন তিনি। শুধু বিভিন্ন ভাষাতে এই বাক্যটি বলতেই শেখেননি ফ্রেডরিক বরং নিজের নোটবুকে স্বহস্তে তা লিপিবদ্ধও করে রাখেন তিনি। এমনকী নিজের এই সংগ্রহকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে যেতে ফরাসি ক্যালিগ্রাফার ক্লেয়ার কিটোর কাছেও যান তিনি।


এভাবেই ক্লিটো জড়িয়ে পড়েছিলেন ‘ভালোবাসার প্রাচীর’-এর সঙ্গে। এই দেওয়াল তৈরির পরিকল্পনা মূলত তাঁরই। ফ্রেডরিকের এই কর্মযজ্ঞে মুগ্ধ হয়েই মন্টমার্ত্রে আবেসেসে এই দেওয়াল তৈরির প্রস্তাব দেন তিনি। এই কর্মকাণ্ডে শামিল হন আরো এক ফরাসি শিল্পী ড্যানিয়েল বেলোগ। প্যারিসের উদ্যানে গড়ে তোলা হয় ৪০ বর্গ মিটারের প্রকাণ্ড প্রাচীরটি। ২১ x ২৯.৭ সেন্টিমিটারের এনামেল লাভার টাইলস দিয়ে তৈরি এই প্রকাণ্ড প্রাচীর। উল্লেখ্য, ফ্রেডরিকের ‘আই লাভ ইউ’ সংগ্রহের নোটবুকের পাতার আকারকে মাথায় রেখেই নির্ধারিত করা হয়েছিল এই আয়তনটি।


তবে মজার বিষয় হলো, নিজে ক্যালিগ্রাফার হয়েও ভালোবাসার প্রাচীরে এ বাক্যটি লেখার সময় তিনি বিভিন্ন ভাষায় শুধু ক্যালিগ্রাফিই করেননি ক্লিটো বরং ঠিক যেভাবে নিজের ডায়েরিতে বিভিন্ন ভাষায় ‘আই লাভ ইউ’ লিপিবদ্ধ করেছিলেন ফ্রেডরিক, হুবহু সেটাই খোদাই করেন পাথরের দেওয়ালেও।

২০০০ সালে যখন এই প্রাচীর তৈরি হয়েছিল তখন সেখানে সবমিলিয়ে প্রদর্শিত হতো ২৫০টি ভাষায় লেখা ভালোবাসার বার্তা। বর্তমানে সেই সংখ্যাটা ছাড়িয়েছে ৩০০-এর গণ্ডি। বলার অপেক্ষা থাকে না, আজও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের অবলুপ্ত ভাষাগুলি তুলে আনার অক্লান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ফ্রেডরিক। তাঁর বিশ্বাস, একমাত্র ভালোবাসাই জুড়ে রাখতে পারে সমস্ত পৃথিবীকে। সরিয়ে রাখতে পারে বিভেদ, বিচ্ছিন্নতা, হিংসাকে। তারই অন্যতম প্রতীক হিসেবে প্যারিসের বুকে দাঁড়িয়ে রয়েছে ‘ভালোবাসার প্রাচীর’।

উত্তর ফ্রান্সের 'ইল দ্য ফ্রস' অঞ্চলের প্রাণকেন্দ্রে 'সেন' নদীর তীরে অবস্থিত প্যারিসের আয়তন ১০৫ বর্গ কিলোমিটার। ফ্রান্সের জনসংখ্যার প্রায় ১৮ শতাংশ (২২ লাখ) বাস করেন এই শহরে। প্যারিসকে কেন্দ্র করে অবিচ্ছিন্নভাবে গড়ে উঠেছে সুবৃহৎ প্যারিসের 'নগর এলাকা', যার জনসংখ্যা ১ কোটি। এই নগর এলাকা এবং প্যারিস কেন্দ্রিক উপ-শহরগুলো মিলে গঠিত হয় 'প্যারিস মেট্রোপলিটন' এলাকা, যার জনসংখ্যা ১ কোটি ২০ লাখ।

প্যারিসের এই মেট্রোপলিটান এলাকা ইউরোপের মেট্রোপলিটান এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিশ্বের অন্যতম বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে এই নগর এলাকাটি অবস্থিত, যা এটিকে বিশ্বনগরীর মর্যাদা দিয়েছে। 'ইল দ্য ফ্রস' বা প্যারিস অঞ্চল ফ্রান্সের অর্থনীতির কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র। প্যারিসের 'লা দেফস' ইউরোপের বৃহত্তম পরিকল্পিত বাণিজ্যিক এলাকা। এখানে ফ্রান্সের প্রধান প্রধান কোম্পানিগুলোর প্রায় অর্ধেক সংখ্যকের সদর দপ্তর অবস্থিত।

বিশ্বের বৃহত্তম ১০০টি কোম্পানির ১৫টির সদর দপ্তরের অবস্থান এই প্যারিসেই। এছাড়াও প্যারিসেই অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থার সদর দপ্তর রয়েছে। এদের মধ্যে আছে: ইউনেস্কো, ওইসিডি, ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সমসহ আরোও অনেক সংস্থা। ফ্রান্স একটি উন্নত দেশ, আর প্যারিস এই উন্নতির ওপর অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। শহরটির অনেক উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে: আইফেল টাওয়ার, শজেলিকে সড়ক, নোত্র দাম গির্জা, লেজাভালিদ, পন্তেও, পালে গার্নিয়ে, লুভ্যর জাদুঘর ইত্যাদি। এই সব এলাকা প্যারিসকে করে তুলেছে অত্যন্ত মোহনীয় ও ভালোবাসাময়!

প্যারিসে বৈশ্বিক কৃষ্টি ও সংস্কৃতির মিশ্র পরিবেশ বিরাজমান, যে নগরীর প্রেমে সিক্ত বিশ্ববাসী। পর্যটকদের কাছে এই ভালোবাসার শহরটি সবচেয়ে প্রিয়। বিশ্বের সবচেয়ে বেশিসংখ্যক পর্যটকদের গন্তব্যস্থল প্যারিস। প্রতি বছর প্রায় ৮৪ মিলিয়ন বিদেশি পর্যটক বেড়াতে আসেন প্যারিসে। প্যারিসের প্রতীক 'আইফেল টাওয়ার' থেকে চোখ সরালেই চোখ পড়ে রূপকথার মোনালিসার ল্যুভর মিউজিয়ামের ওপর। ফ্রেঞ্চ স্থাপত্যকলার অনন্য নিদর্শন 'নটর ডেম ক্যাথেড্রাল'। নেপোলিয়নের বিজয়োল্লাস খচিত তোরণ 'আর্ক ডে ট্রেম্ফে'সহ আরো ঐতিহাসিক গুরুত্ববাহী এলাকা দেখতে পাওয়া যায় ভালোবাসার এই শহরেই।

প্যারিসকে ভালোবাসার শহর বলার আরেক অনন্য কারণ হলো: 'সিন নদীর উপর স্থাপিত ৩৭টি সেতুর মধ্যে পায়ে হাঁটার জন্য নির্ধারিত কিছু সুন্দর সেতুর রেলিংয়ে 'লাভ প্যাডলক' নামে বিশেষ তালা দেখা যায়। প্রেমিক বা প্রেমিকা তাদের একে অপরের নামের প্রথম বর্ণ খচিত করে এই তালাগুলো রেলিংয়ে ঝুলিয়ে চাবিটি সিন নদীতে ফেলে দেয়। প্রেমিক-প্রেমিকার ভালোবাসা প্রকাশের এই অনন্য রীতি প্যারিসকে ভালোবাসার শহর হিসেবে খ্যাতি দিয়েছে।

প্যারিসের আইকন আইফেল টাওয়ার তৈরি হয়েছে ১৮ হাজার ৩৮টি লোহার টুকরো দিয়ে। নবদম্পতিরা বিয়ের প্রথম যুগল ছবি তোলেন টাওয়ারের সামনে। গড়ে প্রতি ১২ মিনিটে একটি সিনেমার শুটিং চলতেই থাকে প্যারিসের এই স্থানটিকে ঘিরে। প্রতি বছর ৭ মিলিয়ন পর্যটক আসেন আইফেল টাওয়ার এলাকায়। পাশেই অবস্থিত ১৩০ মিটার লম্বা, ৪৮ মিটার চওড়া, ৩৫ মিটার উঁচু নটরডেম ক্যাথেড্রাল।

প্যারিসকে মিউজিয়ামের শহরও বলা হয়। প্যারিসে মোট ১৭৩টি মিউজিয়াম অবস্থিত। সবচেয়ে বিখ্যাত ল্যুভর মিউজিয়াম, যেখানে সংরক্ষিত আছে, 'লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির অমর কীর্তি','মোনালিসা'। আরো আছে বিশ্ববিখ্যাত অমর ৩ লাখ ৮০ হাজারটি কীর্তি। ল্যুভর প্রতিটি শিল্পকর্মে যদি ৫ সেকেন্ড করেও সময় দেওয়া হয়, তবে সব দেখতে একজন সাধারণ মানুষের প্রয়োজন হবে ১০০ দিন।

ফ্যাশনেও প্যারিস বিশ্বসেরা। ১৮০০ সাল থেকেই সৌন্দর্যসচেতন মানুষের মিলনমেলা প্যারিস বা বিশ্বের 'ফ্যাশন রাজধানী'। পৃথিবীর সব নামিদামি পারফিউম আর ব্র্যান্ড প্যারিসেই লভ্য। বিশ্বখ্যাত রেস্টুরেন্টগুলোও প্যারিসেই অবস্থিত। ভূমি থেকে ৪০০ ফুট উপরে, আইফেল টাওয়ারে বসে প্যারিসের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য আছে 'লা জুন ভার্ন' রেস্টুরেন্ট।

প্যারিস-ই সেই জায়গা, যেখানে রচিত হয়েছে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তিসূচক শান্তিচুক্তি, যা 'প্যারিস পিস কনফারেন্স' নামে পরিচিত। এই কনফারেন্সেই সই করেছিল পরাজিত জার্মানির জন্য অবমাননাকর চুক্তি, যাকে বলা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ। আজকের জাতিসংঘ বা তৎকালীন 'লিগ অব নেশনস'-এর ধারণাও প্যারিস থেকে উদ্ভূত। শান্তি, সম্প্রীত ও ভালোবাসার দ্যোতনাময় অতীত ও বর্তমান এই প্যারিসকে ঘিরেই!

এ সম্পর্কিত আরও খবর