‘আমার আব্বু কেন মারা গেলেন’

, ফিচার

তাসনীম হাসান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো | 2024-02-13 19:25:11

শীতের কুয়াশা ভেদ করে মিষ্টি রোদ উঁকি দিতে শুরু করেছে সবে। ঘড়ির কাঁটা সকাল সাড়ে নয়টা পেরিয়ে ১০টার ঘরে ছুঁটছে। মামার কোলে চড়ে ভিড়ের মাঝখানে এসে দাঁড়াল আওসাফ বিন আশরাফ। একেবারেই নীরব-নিষ্পলক। ছয় বছরের শিশুটির ছোট্ট বুকটা যেন ভারী হয়ে আছে। মনের মধ্যে যেন খাঁ-খাঁ শূন্যতা। কেননা তার শূন্য দৃষ্টি যে সাদা কাপড়ের দিকে, সেটির নিচেই যে শুয়ে আছেন তারই প্রিয় বাবা মো. আশরাফ উদ্দিনের দেহ। যে দেহে একদিন আগেও ছিল ভীষণ প্রাণ, সেই বাবা এখন তা নিথর। এমন বাস্তবতা কীভাবেই বা মানবে একরত্তি শিশুটি।

আওসাফের বহুক্ষণ ধরে চেপে রাখা কান্নাটা বাধ মানল না অন্য এক কান্নার শব্দ শুনেই। বাবার কবরে মাটি দেওয়ার শেষ পর্ব চলছিল তখন। চোখ মুছতে মুছতে ছোট্ট শিশুটি মামাকে উদ্দেশ করে বলে উঠল, ‘আমার আব্বু কেন মারা গেলেন? আমাকে কে স্কুলে নিয়ে যাবে? কেইবা করবে আদর?’ ভাগ্নের প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারেননি মামা মহিবুল ইসলাম জাসেম! কি বলেই বা সান্ত্বনা দেবেন? একদিন আগেও সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষটাকে মুহূর্তেই এমনভাবে নাই হয়ে যেতে দেখে জাসেম নিজেই যে ডুবে আছেন যন্ত্রণার সাগরে। সেই যন্ত্রণা কমাতে ভাগ্নেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করেন তিনিও।

আশরাফ উদ্দিনের মৃত্যুতে শুধু তার স্বজনদের চোখে নয়, হাজারো মানুষের চোখ ভিজে উঠছে। যে মানুষটা পাড়াপড়শির দুঃখে-দুর্দশায় এগিয়ে আসতেন সবার আগে, তিনিই কিনা মারা গেলেন বেশ আগেভাগেই! মাত্র ৪০ বছরের আশপাশের একটা বয়সে।

আশরাফ উদ্দিনের বাড়ি মিরসরাইয়ের ধুম ইউনিয়নের শান্তিরহাট এলাকায়। সোমবার (১২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে বারইয়ার হাটের নিজের কর্মস্থলে কাজ করার সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হন তিনি। এরপর দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও বাঁচানো যায়নি তাকে। তার আগেই তিনি পাড়ি জমান অন্তিমপথে।

এভাবে আর কোনোদিন বাবার হাত ধরে হাঁটা হবে না আওসাফ বিন আশরাফ ও আলিজা জাহানের।

কোনো রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না। ছিলেন না কোনো বড় কর্মকর্তাও। তবু আশরাফকে মিরসরাইয়ের মানুষ এক নামে চিনতেন। কেননা তিনি যে উপজেলার সব মানবিক আর সামাজিক কাজে নিজেকে জড়িয়ে রাখতেন। বিশেষ করে আশরাফ আলোচনায় আসেন করোনার সময়ে। এই মহামারির প্রারম্ভে যখন করোনা আক্রান্ত শুনলেই স্বজনেরাও ফেলে চলে যাচ্ছিলেন, লাশ দাফন-সৎকার করছিলেন না তখন সাংবাদিক নুরুল আলম কয়েকজন তরুণকে নিয়ে শুরু করেন ‘শেষ বিদায়ের বন্ধু’ নামের একটি সংগঠন। সেই সংগঠনের অন্যতম সমন্বয়ক (অর্থ ও হিসাব) ছিলেন আশরাফ। ২০২০ সালের ৮ এপ্রিল চালু হওয়া সংগঠনটি প্রায় ৩০০ করোনা আক্রান্ত মৃত রোগীকে গোসল করিয়েছে, দাফন দিয়েছে। আর সব কাজেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন আশরাফ। শুধু তাই নয় মীরসরাইয়ে নিবন্ধিত ২৩০টি সামাজিক ও মানবিক সংগঠনের যৌথ প্রচেষ্টা-‘সম্মিলিত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা’রও সভাপতি ছিলেন তিনি। মিষ্টান্ন, এজেন্ট ব্যাংকিংসহ নানা ব্যবসা ছিল আশরাফের। সেই ব্যবসা থেকে আসা মুনাফার একটা বড় অংশ তিনি খরচ করতেন মানবসেবায়।

সোমবার সকালে নিজের প্রতিষ্ঠান আল হেরা স্কুল অ্যান্ড কলেজের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন আশরাফ। সেখানে দীর্ঘ বক্তব্যে শিক্ষার্থীদের দিয়েছিলেন মানবিক কাজের অনুপ্রেরণা। সেটি শেষে যান কর্মস্থলে। শিক্ষার্থীদের বিদায় দিয়ে ফিরে নিজেই কিনা দুপুর গড়াতেই চিরবিদায় নিয়ে চলে নিলেন পৃথিবী থেকে।

আশরাফের এমন মৃত্যু তাই কোনোভাবেই মানতে পারছেন না শেষ বিদায়ের বন্ধুর প্রতিষ্ঠাতা প্রধান সমন্বয়ক নুরুল আলম। আশরাফকে কবর দেওয়ার সাত ঘণ্টা পরও মঙ্গলবার সন্ধ্যা পাঁচটায় শোকের মনস্তাপ করে যাচ্ছিলেন এই সাংবাদিক। বললেন, এখনো মনে হচ্ছে না আশরাফ আর নেই। মনে হচ্ছে কেউ বিপদে পড়েছেন শুনে এখনি দৌঁড়ে আসবেন। আসলে ও (আশরাফ) ছিল মিরসরাইয়ের জন্য ধ্রুবতারা। তার মধ্যে সব মানবিক গুণই ছিল। আরেকটা আশরাফ পাব না আমরা। আশরাফের মৃত্যুতে তাই আমাদের বড় ক্ষতি হয়ে গেল।

মামার কোলে চড়ে বাবাকে বিদায় দিতে এসেছে আওসাফ বিন আশরাফ।

আশরাফ চিকিৎসার সুযোগটুকু পর্যন্ত দিলেন না, সেই আফসোসে পুড়ছেন বন্ধু নিজাম উদ্দিন। বললেন, ’৪০ বছরের জীবনে আশরাফ কত-শত মানুষকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছেন, সেবা করেছেন। আমার সেই বন্ধুটিই কিনা আমাদের চিকিৎসার সুযোগটুকু পর্যন্ত দিল না। দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গেলেও বাঁচাতে পারলাম না বন্ধুকে। তার দুই বাচ্চাকে কি বলে সান্ত্বনা দেব। স্বামী হারা স্ত্রীকে কি বলব? বা দুই বৃদ্ধ বাবা-মাকে ছেলের শোক কীভাবে ভুলাবো-বুঝতে পারছি না। নিজেই যে বন্ধুবিয়োগের কষ্টে শেষ হচ্ছি।’

আশরাফের দুই সন্তান। আওসাফের কথা তো আগেই বলা হলো। আরেকজন দুই বছরের আলিজা জাহান। ছেলে-মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে কদিন আগেই আশরাফ ঘুরে এসেছেন সেন্টমার্টিন থেকে। ঘোরাঘুরির ফাঁকে তুলেছেন অজস্র ছবি। তারই কিছু হাস্যোজ্জ্বল ছবি নিজের ফেসবুকে তুলে ধরেছিলেন আশরাফ। সেই হাসিমুখ এত দ্রুতই যে মুছে যাবে কেইবা জানত। সেই ছবিগুলোর নিচে মন্তব্যের ঘরে এখন অনেকেই লিখছেন, মানুষ এভাবেও চলে যায়!

প্রতিদিন সকালে নার্সারি শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে আওসাফকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে কর্মস্থলে যেতেন আশরাফ। বাবার শূন্যতা এখনো বুঝে উঠতে পারেনি মেয়ে আলিজা। তবে সারাঘর দৌড়াদৌড়ি করে মাতিয়ে রাখা আওসাফ বাবাকে কবর দিয়ে ফেরার পর থেকেই হয়ে পড়েছে চুপচাপ, কারও সঙ্গে বলছে না কোনো কথাও।

ছোট্ট শিশুটিও বুঝে গেছে কাল থেকে তার স্কুল থাকবে, থাকবে বাকি সবও। শুধু থাকবে না স্কুলে ফেরার সময় বাবার হাতের স্পর্শ, আদরের চুম্বন…

এ সম্পর্কিত আরও খবর