সম্রাট অশোক ও তার শাসনব্যবস্থা

, ফিচার

শরীফুল ইসলাম, নিউজরুম এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-11-25 22:56:10

ইতিহাস খুললে আমরা দেখতে পাই, বহু রাজার গৌরবময় গল্প বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে আছে। তেমনি এক গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে ভারত বর্ষের মৌর্য সম্রাজ্যের রাজা সম্রাট অশোকের। যিনি মৌর্য সাম্রাজ্যকে এশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী রাজ্য হিসেবে গড়েছিলেন।

সম্রাট অশোক এবং তার শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে জানা যায় কৌটিল্যের “অর্থশাস্ত্র” থেকে। অশোকের জীবনে এমন কিছু ঘটনা রয়েছে যা গোটা বিশ্বের রাজতন্ত্রকে আশ্চর্য করে দেয়। অশোকের জীবনী থেকে জানা যায়, শুরুর দিকে অশোক খুবই নির্দয় এবং হিংস্র ছিলেন। চীনা লেখক ফা হিয়ান এ সম্পর্কে বলেছেন, ‘অশোককে প্রথম জীবনে এমন মনে হয়, যেন সে নরক থেকে মানুষকে যন্ত্রণা দেওয়ার পন্থা শিখে এসেছে।‘ প্রকৃত অর্থেই অশোক শুরুর দিকে নৃশংস একজন যোদ্ধা এবং রাজা ছিলেন।

মৌর্য বংশের প্রথম রাজা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের ছেলে বিন্দুসার। পাটালিপুত্র ছিল মৌর্য বংশের রাজধানী। বাবা বিন্দুসার এবং মা সুবোধরাঙ্গীর ছেলে ছিলেন অশোক। তার আসল নাম ছিল দেবাঙ্গপ্রিয় প্রিয়দর্শী আশোক।

অশোকসহ বিন্দুসারের মোট ১০১ জন পুত্র ছিল। কুৎসিত চেহারার জন্য অশোক বাবার অপ্রিয় হলেও যোদ্ধা হিসেবে ছিলেন সবার শ্রেষ্ঠ। অশোকের এই বীরত্ব বাবা বিন্দুসারের ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ তিনি চাইতেন না অশোক তার পরবর্তী সম্রাট হোক। বিন্দুসারের শাসনামলে ভারতের বহু অংশ মৌর্য বংশের অধীনে চলে আসে। এই মৌর্য বংশের অধীনে থাকা তক্ষশীলা এক সময় বিদ্রোহ করে। সুযোগে বিন্দুসার অপ্রিয় পুত্র অশোককে পাঠান বিদ্রোহীদের দমন করতে। কিন্তু সেই যুদ্ধে পুত্রকে সেনা দিলেও দেননি কোনো অস্ত্র। অশোক বাবার ষড়যন্ত্র বুঝতে পারেন। কৌশলে পৌঁছান তক্ষশীলায় এবং কথার মাধ্যমে বিদ্রোহীদের দমন করতে সক্ষম হন। 

প্রাচীন তক্ষশীলা নগরী 

বিন্দুসার চেয়েছেন বড় ছেলে সুশীমা হবে তার পরবর্তী সম্রাট। কিন্তু সুশীমাকে অনেক সভাসদরা পছন্দ করতে পারতেন না। কারণ তার আচরণ ছিল অনেক রুক্ষ্ম। সভাসদদের অমতে সুশীমাকে রাজা করতে গেলে চানক্যের পরামর্শে অশোক তাতে বিদ্রোহ করে। সিংহলী বই ‘মহাবংশ’ থেকে জানা যায় অশোক তার ১০০ ভাইয়ের মধ্যে ৯৯ জনকেই হত্যা করেছিলেন। যে কারণে তাকে চণ্ডাশোক বলা হতো। 

২৬৮ খ্রিষ্টপূর্বে মৌর্য বংশের ২য় সম্রাট এবং ৩য় শাসক হিসেবে অশোকের রাজ্যাভিষেক হয়। ধীরে ধীরে তিনি বহু রাজ্য দখল করেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য যখন মগদে তার শাসনামল শুরু করেন তখন ভারত ১৬টি জনপদে বিভক্ত ছিল। চাণক্য চেয়েছিলেন এই ১৬টি জনপদকে মৌর্য বংশের অধীনে আনার। কিন্তু মৌর্য গুপ্ত তার সাম্রাজ্যকে বেশি বিস্তার করতে পারেননি। তার ছেলে বিন্দুসার মৌর্য বংশকে অনেক বিস্তৃত করেন এবং তার পরে সম্রাট অশোক সেই সাম্রাজ্য সমগ্র ভারতবর্ষের পরিণত করেন। আফগানিস্তান, ইরান থেকে আসাম সমগ্র ভারতবর্ষই তার দখলে চলে আসে। অশোকের সেনাবাহিনীতে প্রায় ৬ লাখ পদাতিক সেনা ছিল। এছাড়া ৩০ হাজার অশ্বারোহী, ৯ হাজার হাতি এবং কয়েক হাজার জাহাজও ছিল। 

মৌর্য সাম্রাজ্য 

২৬১ খ্রিষ্টপূর্বে কলিঙ্গের সাথে মগদের বিধ্বংসী যুদ্ধ হয়। এই সাম্রাজ্যটি অনেক শক্তিশালী ছিল বলে তার পূর্বসূরিরা এটি দখল করতে পারেনি। অশোক প্রথমে রাজনৈতিকভাবে চেষ্টা করেন। তাতে ব্যর্থ হয়ে তিনি যুদ্ধের পথ বেছে নেন। এই যুদ্ধে প্রায় ১ লাখ সৈনিক নিহত এবং প্রায় ২ লাখ সাধারণ মানুষ প্রাণ হারায়। যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে অশোক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। তখন থেকেই অশোক বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার শুরু করেন এবং যুদ্ধ করা ছেড়ে দেন। এজন্য অশোককে বৌদ্ধ ধর্মের কনস্ট্যানটাইন বলা হয়।

সম্রাট আশোক নতুন রাজতন্ত্রের সূচনা করেন। প্রজাদের কল্যাণে গাছ লাগান, হাসপাতাল নির্মাণ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। তার বানানো শাসনব্যবস্থা বর্তমানে প্রায় সব দেশে দেখা যায়। তার অধীনে থাকা ছোট ছোট রাজ্যগুলোতে একজন করে দায়িত্ব দেন। তাদের উপরে মন্ত্রী এবং সম্রাট থাকতেন। অশোকের বিচার ব্যবস্থা দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। তিনি বিভিন্ন ধরনের সৈনিক ব্যবস্থা এবং তাদের জন্য আলাদা আলাদা প্রধান নির্ধারণ করেন। যা বর্তমান শাসন ব্যবস্থায় দেখা যায়। ভারতের সংবিধানে বহু অধ্যায় সম্রাট অশোকের শাসন ব্যবস্থা থেকেই গৃহীত। দুর্নীতি কমানোর জন্য অশোক গুপ্তচর বৃত্তি নিষিদ্ধ করেন।

অশোকের শাসনকাল ভারতে ইতিহাসে এক স্বর্ণযুগ ছিল। বৌদ্ধধর্মের প্রচারের জন্য তিনি নিজের সন্তানদের দেশ-বিদেশে পাঠান। তার শাসনামলে বৌদ্ধধর্ম অনেক বিস্তৃতি লাভ করে। ইতিহাসে অশোকই প্রথম সম্রাট ছিলেন, যিনি বিশ্বব্যাপী অহিংসার বাণী ছড়ান।

ন্যায়পরায়ণ এই সম্রাটের শেষ জীবন সুখের ছিল না। যুদ্ধ না করার ফলে তার সেনারা দুর্বল হয়ে পড়ে। বিভিন্ন রাজ্যে বিদ্রোহ দেখা দেয়। অশোকের অতিরিক্ত দান তার উত্তারাধিকারদের পছন্দ ছিল না। ফলে এক সময় তারা অশোককে বন্দী করেন। তখন অশোক নিজের সোনার থালাও দান করে দেন

২৩২ খ্রিষ্টপূর্বে সম্রাট অশোক বিভিন্ন রোগে জর্জরিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পরে মৌর্য বংশের সূর্য অস্তমিত হতে শুরু করে।

সম্রাট অশোক একজন অহিংস রাজা হিসেবে স্বীকৃত। তার চক্র যাকে ধর্ম চক্র বলা হয় তা ভারতের পতাকার মধ্যখানে রয়েছে। অশোক স্তম্ভ ভারতের জাতীয় প্রতীক। যাতে সিংহ, হাতি, ঘোড়া ও গরুর মূর্তি দেখা যায়।

অশোক স্তম্ভ সম্বলিত ভারতের জাতীয় প্রতীক 

এ সম্পর্কিত আরও খবর