প্রযুক্তির যাঁতাকলে পিষ্ট লাঙ্গল-গরুর হাল চাষ

, ফিচার

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, রাজশাহী | 2023-11-04 04:11:59

অতীতে জমিতে আবাদে হালচাষের জন্য গাঁয়ের মেটোপথে-প্রান্তরে দেখা যেত গরু ও মহিষ। বর্তমান যুগে পশু দিয়ে হালচাষের পরিবর্তে এসেছে আধুনিক বিভিন্ন সব প্রযুক্তি। তাই নতুন প্রজন্মের অনেকেই জমিতে গরু দিয়ে লাঙল কিংবা মই টানা দৃশ্য তাদের কাছে অপরিচিত। আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিলুপ্তির পথে চিরচেনা এই পদ্ধতি। প্রযুক্তির যাঁতাকলে পিষ্ট লাঙ্গল-গরুর সেই হালচাষ!

সে সময় কৃষকরা ভোরবেলা মাঠে গিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত এভাবে হাল চাষ করতেন। গরু-মহিষ দিয়ে লাঙল ও মই টানার মাধ্যমে হাল চাষের বিকল্প ছিল না। কিন্তু এখন সেই অবস্থা নেই। জমিতে চাষাবাদ পুরোপুরিভাবে আধুনিক হয়ে যাওয়ায় কম সময়ে লাভ বেশি হলেও মাঠ থেকে যেন হারিয়ে প্রায় এই কৃষকদের ঐতিহ্য। কৃষির উন্নয়নের গতিতে তাল মেলাতে না পারা হালচাষ এখন বিলুপ্তির পথে।  ঐতিহ্য হয়ে জাদুঘরেও ঠায় পাচ্ছে এই চালচাষের যন্ত্র।

রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে এক সময় গরু-লাঙল দিয়ে জমি চাষ আর মই দেয়ার দৃশ্য সবার নজর কাড়ত। বাড়ি থেকে বের হয়ে মাঠের দিকে নজর পড়তেই দেখা যেতো শত শত কৃষক বাঁশের ফালা দিয়ে তৈরি করা ধারালো লাঙল কাঠের হাতল আর জোয়ালের মাধ্যমে গরুর কাঁধে বেঁধে দিয়ে জমি চাষ করছে। অথচ গরু-লাঙলের সঙ্গে কৃষকের সেই মিতালীর দৃশ্য এখন বিরল। কালের পরিবর্তন আর বিজ্ঞানের ছোঁয়ায় গরু-লাঙলের স্থান দখল করে নিয়েছে ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলারসহ বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্রপাতি। এখন কৃষক তার সুবিধামতো যেকোনো সময় প্রয়োজনীয় জমি চাষ এবং মই দিয়ে ফসল আবাদ করতে পারছে। আধুনিক এই যন্ত্রপাতি দিয়ে জমি চাষে পরিশ্রম এবং সময় কমেছে।

রাজশাহী পবা উপজেলার প্রবীণ কৃষক শাজাহান আলী বলেন, একসময় প্রতিটি গ্রামে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে ছিল গরুর লালন-পালন। এই গরুগুলো যেন পরিবারের এক একটা সদস্যের মতো। তাদের দিয়ে আমরা একরের পর একর ভূমি চাষ করতাম। যাদের গরু কিংবা হাল ছিল না তাদের জমি চাষের জন্য ‘কামলা দিতাম’। অনেকে শুধু হাল চাষ করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। এছাড়াও হাল মালিকেরা সময়মতো জমি চাষ করে দিত। এতে করে চাষের মৌসুমে তাদের উপরি আয়ের ব্যবস্থা হতো। এ কৃষক একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, এখন আর কেউ গরু দিয়ে হাল চাষ করে না। আমাদের বাপ-দাদাদের ঐতিহ্য গ্রাম অঞ্চল থেকে একদম বিলীন হওয়ার পথে যাচ্ছে।

আরেক প্রবীণ কৃষক আব্দুস সাত্তার জানান, তিনি নিজেও কয়েক বছর আগে হালচাষ করে আবাদ করতেন। তার নিজেরই হালচাষের যাবতীয় যন্ত্রপাতি এখনো আছে। তবে সময়ের সঙ্গে এগুলো এখন অকেজো। গরুর লাঙ্গল দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৪০ শতাংশ জমি চাষ করা সম্ভব। কষ্ট হলেও আমাদের গরু দিয়ে হাল চাষ করতে খুব ভালো লাগত। বর্তমান সময়ে তথ্যপ্রযুক্তির আবির্ভাবের কারণে এভাবেই ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য। আগামী প্রজন্ম হয়তো বই পড়ে জানতে পারবে এক সময় গ্রাম অঞ্চলে গরু দিয়ে হাল চাষের বিষয়টি।

গোদাগাড়ী উপজেলার প্রবীন কৃষক করিম মন্ডল জানান, ১৫ থেকে ২০ বছর আগে নিজের সামান্য জমির পাশাপাশি অন্যের জমিতে হাল চাষ করে তাদের সংসারের ব্যয়ভার বহন করতেন। হালের গরু দিয়ে জমি চাষ করে ফিরে পেত তাদের পরিবারের সচ্ছলতা। তিনি বলেন, আগে কাকডাকা ভোরে কৃষক গরু, মহিষ, লাঙল, জোয়াল নিয়ে মাঠে বেড়িয়ে পড়তাম। এখন আর চোখে পড়ে না সে দৃশ্য। জমি চাষের প্রয়োজন হলেই অল্প সময়ের মধ্যেই পাওয়ার টিলারসহ আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে চালাচ্ছে জমি চাষাবাদ। তাই কৃষকরা এখন পেশা বদলি করে অন্য পেশায় ঝুঁকছেন। ফলে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে গরু, মহিষ, লাঙল, জোয়াল দিয়ে জমিতে হাল চাষ। এটা কৃষকদের জন্য অনেক সুবিধা করে দিয়েছে। তাড়াতাড়ি কাজ করার সুযোগ হচ্ছে।

রাজশাহী আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক শামসুল ওয়াদুদ জানান, গরু দিয়ে হাল চাষ করালে অধিক সময় ব্যয় করতে হয় কৃষকদের। বর্তমান সময়ে হাল চাষের জন্য আধুনিক ট্রাক্টরের আবিষ্কার হওয়ায় অল্প সময়ে কৃষকরা তাদের জমিন চাষ করতে পারে। যার কারনে পুরনো পদ্ধতিতে গরু দিয়ে হাল চাষ এখন আর তেমন একটা দেখা যায় না। হাল চাষ এখন শুধুই ঐতিহ্য।

এ সম্পর্কিত আরও খবর