পারস্যের আশ্চর্য গ্রাম ‘কান্দোভান’

, ফিচার

মায়াবতী মৃন্ময়ী, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 23:10:16

দেশের নাম তখনও ইরান হয়নি। পারস্যদেশ নামে সারা বিশ্বে মশহুর। সেসময় পত্তন হয় এক গ্রামের। দূর থেকে দেখলে মনে হয় অবিকল উইয়ের ঢিবির মতো। যদিও উই নয়, ঢিবিগুলো মানুষের আবাস। উত্তর-পশ্চিম ইরানের  পাহাড়ি কোলে এক ঐতিহাসিক প্রত্যন্ত গ্রাম কান্দোভান । আধুনিক যুগেও এখানকার বাসিন্দারা ঢিবির মতো গুহায় থাকেন সেই আশ্চর্য গ্রামে।

'কান্দোভান' নামটি ফার্সি শব্দ 'কান্দো' থেকে । এর অর্থ স্থানীয় তুর্কি উপভাষায় 'করণ'। যার অর্থ মৌচাক। বাড়িগুলোর ডাকনাম 'করণ'। হাজার হাজার বছর আগে এখানে এক আগ্নেয়গিরির ঘুম ভাঙে। নির্গত লাভা ঠান্ডা হওয়ার পর অঞ্চলটিতে উষ্ণ ঢিবির জন্ম।

প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, কান্দোভানের ইতিহাস ১০ হাজার বছরেরও বেশি পূর্বের। অঞ্চলটিতে প্রথম বসতি স্থাপন করে প্রাগৈতিহাসিক মানুষেরা। কান্দোভানের আশপাশের অঞ্চলে সহস্রাব্দ ধরে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষের বসবাস। এর মধ্যে মেডিস, অ্যাকেমেনিডস, পার্থিয়ান, সাসানিড অন্যতম। গোষ্ঠীগুলো তাদের ব্যবহার্য জিনিস, মৃৎপাত্র কিংবা অন্যান্য শিল্পকর্মের মধ্যে রেখে গেছে তাঁদের সভ্যতার চিহ্ন।

সময় ছুটে চলে। সময়ের সঙ্গে ছুটতে ছুটতে এই এলাকায় বাড়ে জনবসতি। প্রসারিত হয় গ্রাম। পরিবারদলোর প্রয়োজনেই আবশ্যিক হয় গুহাবাড়ির সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন। গ্রামবাসীরা পানীয় ও সেচের জন্য নিকটবর্তী ঝরনা থেকে জল গ্রামে আনার জন্য তৈরি করে জলের চ্যানেল। কিন্তু বাড়ির ঐতিহ্যবাহী আকার, আকৃতি ও কাঠামো বদল করেননি তাঁরা।

ইরানে যখন ইসলামি স্বর্ণযুগ, তখন কান্দোভানের আশপাশের অঞ্চলটি বৃত্তি ও শিক্ষার আদর্শ কেন্দ্রে পরিণত হয়। পণ্ডিত-দার্শনিকদের কাছেও প্রিয় ছিল এই এলাকা। 

১১ এবং ১২ শতকে সেলজুক তুর্কিরা এই অঞ্চলে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। কান্দোভান সুপ্রাচীন বাণিজ্যপথ সিল্ক রোডের নিকটবর্তী হওয়ায় বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ফলে কান্দোভান অনেক উল্লেখযোগ্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে, বিশেষ করে ২০ শতকে। এই সময় নগরায়ণের ফলে কান্দোভান অনেক বেশি আধুনিক হয়ে ওঠে।

স্থানীয়দের দাবি, প্রায় সাতশো বছর আগে কিছু মানুষ মঙ্গোল হানাদারদের হাত থেকে বাঁচতে এই টিলাগুলোতে বসতি স্থাপন শুরু করে। আর এখন? ইরানের তাবরিজ শহরের কাছে পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের প্রাচীন এই গ্রাম আয়তনে বেড়েছে। প্রায় সাড়ে ছ'শো মানুষের নিবাস কান্দোভানে। এখানকার মানুষের আয়ের উৎস কৃষি ও ভেড়া পালন। ভালো আয় আসে পর্যটন থেকেও। হস্তশিল্প তৈরি করে বিক্রিও করেন স্থানীয়রা। 

নিবাসীদের প্রচেষ্টায় একেকটা বাড়ি এখন হেরিটেজ হোটেল। ঘরগুলো শীতকালে উষ্ণ এবং গ্রীষ্মে শীতল। এমনটা কীভাবে সম্ভব? ঘরগুলোর দেওয়াল প্রায় দুই মিটার পুরু। মেদবহুল এই দেওয়ালই গ্রীষ্মে শীতল বাতাস প্রবাহিত করে এবং শীতকালে উষ্ণ বাতাস আটকে রাখে। বছরের যে-কোনো সময়েই ঘরগুলো থাকে আরামদায়ক।

কান্দোভানের ঢিবির মতো গুহাবাড়িগুলোর অনন্য নকশা এবং নির্মাণ গ্রামের প্রধান আকর্ষণ। ঘরগুলো আগ্নেয়গিরির ছাই ও শিলা কেটে এমনভাবে তৈরি, যা নিয়েছে শঙ্কু আকৃতি। বাসিন্দাদের নিবিড় শ্রম ও ধৈর্য না থাকলে এমন শৈলীর ঘর বানানো অসম্ভব। দরজা খুলে একচিলতে ঘরটায় ঢুকে বাইরেটা দেখলে মনে উঠবে খুশির তুফান। না, কেবল বাইরে নয়, ঘরের ভিতরটাও পাল্লা দিয়ে পরিপাটি। মেঝেতে পাতা কার্পেট, ঐতিহ্যশালী কম্বল, কুশন, কাঠ-পোড়া চুলা, রঙিন ট্যাপেস্ট্রি বা পর্দা দেখে মন ছুঁয়ে যাবে যেকারোই।

বাড়িগুলোর বেশিরভাগই দোতলা। যদিও সেগুলো কিছু ক্ষেত্রে তিন, এমনকী চার তলাও। ভিতর থেকে একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় ঘরগুলো। গ্রামীণ মানুষ এই পাহাড়ের মধ্যে কেবল আবাস নয়, তৈরি করেছে চারণভূমি, গুদামসহ নানান কর্মশালাও। মাল্টি-স্টোর হাউস এবং সিঁড়িগুলো সাধারণত প্রতিটি তলের সঙ্গে অন্য তলের সংযোগের জন্য তৈরি।

গ্রামটিতে রয়েছে গণশৌচালয়, জলের কল, মসজিদসহ সমস্ত সুবিধা। মসজিদটি কান্দোভানের বৃহত্তম করণগুলোর মধ্যে একটি। বাড়িগুলোর অনন্য স্থাপত্য, সুন্দর উপত্যকা, মনোরম আবহাওয়া, জৈব দুগ্ধ, বাদাম ও ঔষধি গাছ, মধু এবং কারুশিল্প অঞ্চলটিকে ইরানের অন্যতম পর্যটন অঞ্চলে পরিণত করেছে। কান্দোভানের বাড়িগুলো ভূমিকম্প-প্রতিরোধী। কারণ প্রাকৃতিক এই শিলা শক্তিশালী এবং নমনীয়। গ্রামে রয়েছে রোগা গলির গোলকধাঁধা। ইতিহাস, স্থাপত্য এবং প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে কান্দোভান এখনও এক বিস্ময়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর