তুরাগ পাড়ের কান্না: আজন্ম জেলের কামলা জীবন

, ফিচার

জাকারিয়া মন্ডল | 2023-08-31 22:12:38

ভরদুপুরে সুনশান কাশিমপুর জেলেপাড়া। নদীর পাড় জুড়ে লম্বাটে গ্রাম। ৭০ ঘর জেলে আছে গ্রামটায়। নদীর পাড় জুড়ে নির্মিত বাঁধরাস্তাটাতেও নতুন ঘর উঠছে। কিন্তু, প্রাণের স্পন্দন টের পাওয়া মুশকিল। মাছের অভাবে নদী থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেওয়া জেলেরা বাজারের দিকে গেছে কাজের খোঁজে। আর পানি দূষিত হয়ে পড়ায় তাদের বউ-ঝিয়েরা নদীতে আসা বাদ দিয়েছেন। যে গাঁয়ের ঘর-গৃহস্থালির সবটাই নদীতে, সেখানেই এখন নামতে ভয় তাদের!  

তুরাগের তিরতিরে স্রোত এদিকটাতে আরও কালো। মাছ না থাকায় জেলেশূন্য নদীর পাড়ে কয়েকটা নৌকা তুলে রাখা। বর্ষার আগে আর কাজে আসবে না এগুলো। অনেক খোঁজাখুঁজি করে দশরথ বর্মন আর বাবু বর্মনকে নিয়ে এলেন তাহের মাঝি।

আর দশ জেলের চেয়ে দশরথ বর্মনের গল্পটা একটু আলাদা। ৬৫ বছর বয়স তার। তিন সন্তানের জনক। পড়েছেন ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত। টুকটাক ব্যবসা আছে। জেলে কার্ডও পেয়েছেন। জেলেপাড়ার মধ্যে তাকে মোটামোটি অবস্থাসম্পন্ন বলা চলে।

নৌকায় এসে বসে দশরথ বর্মন বললেন, ‘নিজের জাল, নিজের নৌকা। নিজেই মাছ ধরি। ভাড়াও দেই।’


আর সব জেলের মতো তুরাগ নদীটাকে খুব ভালোই চেনা দশরথের। তবে অন্যদের মতো ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে বসে থাকেননি তিনি। বিকল্প আয়ের উৎস্য গড়েছেন। তাই তুরাগের দুর্দিনে হা-পিত্তেশ করতে হয় না তাঁকে। কিন্তু, তার মতো জেলের সংখ্যা হাতে গোনা।

অধিকাংশেরই অনিশ্চিত জীবন। বর্ষা মৌসুমে নদীর পানি যখন স্বচ্ছ হয়ে ওঠে, আর সেই পানিতে যখন মাছ আসে, তখন নদীতেই সারা দিন কাটে তাদের। অন্যসময় কখনও হয়তো ভাড়ায় মাছ ধরতে যান কোনো পুকুর বা ঘেরে, অথবা কামলা খাটেন। দুই সন্তানের জনক ৪০ বছর বয়সি বাবু বর্মন তাদেরই দলে। যদিও জেলে কার্ড পেয়েছেন তিনিও। কিন্তু নিজের জাল নেই তার। নৌকাও না। অন্যের সঙ্গে ভাগে মাছ ধরার সুযোগ পাওয়ার আশায় বসে থাকতে হয় তাকে। মৌসুম শেষে শুরু হয় কামলার জীবন।

উদাস স্বরে বাবু বর্মন বলেন, ‘মৌসুম আইলে এই গাঙে মাছ ধরি। ভাটির চাইতে উজান দিকটাকে মাছের রকম বেশি। গুড়া, চিংড়ি, চান্দা, পুটি, বাইন, ঘাউড়া, বাছা, টাটকিনি, কাজরি, বাটা, চাপিলা, আইড়, বাইন, ইচা, শোল, গজার, বেয়াল, রুই, কাতলা পাই। কখনও বেড় জাল পাতি, কখনও ঝাঁকি জাল। যখন যেটা দরকার হয়। কিন্তু কার্তিক গেলেই সব শ্যাষ। কালো পানিতে মাছ থাকে না। নামলে গা চুলকায়।’

বাবু আর দশরথ বর্মনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাধারণত রাজবংশী আর বর্মন পদবিই হয় তুরাগ পাড়ের জেলেদের। কারো টাকা হলে নেয় সরকার, চৌধুরী পদবী।

 


এখান থেকে একটু উজানে কাশিমপুর বাজার। ডায়িং কারখানার সাবান পানি এসে মিশছে নদীতে। নদীতে অনবরত ঝরছে মোটা মোটা পাইপের পানি। কোনো রাখ রাখ ঢাক ঢাকের বালাই নেই।

বড় একটা বাঁক ঘুরে আর একটু উজানে এগুতেই নদীর পাড়ে সামিট পাওয়ার প্ল্যান্ট। আরও উজানে কড্ডা সেতু। সেতুর নিচে যে পাড়াটা, সেখনকার শহীদা বেগম আর ছানাউল্লাহরা এখন আর নদীর ওপর নির্ভরশীল নন। একসময়কার জেলে ছানাউল্লাহ এখন পুরুদস্তুর মাছের ব্যবসায়ী। সেতুর নিচের পাড়াটা তুলে দেওয়া হয় কি না তা নিয়েই চিন্তিত তারা।

এখান থেকে আরও উজানে মজলিশপুর। নদীর পূর্বপাড়ে। আজ হাটবার বলে নৌকাঘাটটা সরগরম। এখানকার ৭১ বছর বয়সি রবীন্দ্র চন্দ্র দাস, ৫৫ বছর বয়সি মনীন্দ্র বর্মন ও ৫১ বছর বয়সি নিরঞ্জন চন্দ্র বর্মনেরও একই গল্প। মৌসুমের জেলে মৌসুম শেষে কামলা।

কার্ড পাননি কেউই। একেক জন দুতিন জন করে সন্তানের জনক। কোনোরকমে নিজের নামটা লিখতে পারেন। এখনও নদীই তাদের জীবিকার প্রধান উৎস্য। কোষা নৌকায় ভেসে কচাল পাতেন, মাইজাল ফেলেন। ভাগে মাছ ধরে হাজার দেড়েক টাকার মাছ পান দিনে। কার্তিকের পর পানি পচে গেলে সে সুযোগও চলে যায়। আজন্ম জেলে তখন হয়ে পড়েন পরনির্ভরশীল কামলা।

জাকারিয়া মন্ডল: প্রধান বার্তা সম্পাদক, দৈনিক আমাদের বার্তা ও ফেলো, রিভার এন্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি)

এ সম্পর্কিত আরও খবর