একুশের অতন্দ্র চেতনা

, ফিচার

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 01:51:20

একুশে মানে মাথা নত না করা। একুশে মানে ভাষিক, সাংস্কৃতিক, আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার অনির্বাণ চেতনা। ঢাকার রাজপথে বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তস্মৃতিময় পথ বেয়ে বাঙালি জাতি আত্মপরিচিতি প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে প্রাণিত ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সোপান নির্মাণ করেছে। অতন্দ্র চেতনায় একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির বীরোচিত আত্মপরিচিতি ও অধিকারের সৌধ নির্মাণ করেছে।

একুশের দীপ্ত চৈতন্য বীজমন্ত্র রূপে বিশ্বব্যাপী বাঙালিকে জাগ্রত ও অধিকার সচেতন করেছে। আসামের বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষার জন্য রক্তাক্ত আন্দোলন হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়া ও বৈশ্বিক বাঙালির আত্মপরিচয় ও সাংস্কৃতিক মর্যাদা রক্ষায় একুশের মহান চেতনা প্রজ্জ্বলিত লেলিহান শিখায় নিত্য প্রণোদনা জাগাচ্ছে।

একুশের ঐতিহাসিক অর্জন বিশ্বের দরবারে বাঙালিকে আর্থ, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে মহীয়ান করে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস'-এর গৌরবেও ভূষিত এবং পৃথিবীব্যাপী লক্ষ-কোটি মানুষের অধিকারের প্রতিধ্বনি। ফলে ভাষিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক আধিপত্যের কবলে রাহুগ্রহ হলে একুশের প্রতিবাদী ভাবণায় ও চেতনায় প্রতিবাদমুখর হচ্ছে বিশ্বের প্রতিটি বাঙালি এবং ভাষিক-সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামরত প্রতিটি মানুষ।

কেন মানুষ মাতৃভাষা হারিয়ে গেলে বা আক্রান্ত হলে জীবনবাজি রেখে প্রতিবাদমুখর হয়? কেন মানুষ মুখের ভাষা, মায়ের ভাষার সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় অকাতরে রক্ত ঢেলে দেয়? কেন ভাষার সঙ্গে সঙ্গে সামনে এসে দাঁড়ায় আর্থ, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের প্রসঙ্গগুলো?

কারণ, ভাষা কেবলমাত্র স্বর আর ব্যঞ্জন বর্ণের সমষ্টিতে নিছক একটি বর্ণমালা নয়। ভাষা হলো মানুষের চেতনা, বিশ্বাস, সংস্কৃতি, দর্শন, জীবনাচার ও চর্চার ফলিত মাধ্যম। মাতৃভাষা হলো মানুষ আর জগতের সেতুবন্ধ। তার কর্মের, সৃষ্টির, চিন্তার, প্রকাশের, তৎপরতার বাহন। এই ভাষাতেই মানুষ নিজের ঐতিহ্য পরম্পরার মূলসূত্রের সঙ্গে নিবিড়ে জড়িয়ে থাকে।

ফলে ভাষা কেড়ে নেওয়ার অর্থ হলো, ইতিহাস, ঐতিহ্য, অস্তিত্ব ও আত্মপরিচিতি ছিনিয়ে নেওয়া। তাকে অচল, অথর্ব ও গতিহীন করা। তার জীবন ও জীবিকার অবলম্বন নস্যাৎ করে দেওয়া। অবনত ও পদদলিত করার আগ্রাসী পদক্ষেপের প্রথমটিই হলো মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়া।

এজন্যই বাংলার ভাষাকে যখন কেড়ে নিতে চেয়েছিল পাকিস্তানি শাসকবর্গ, তখন তীব্র প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছিল তাবৎ বাঙালি জাতি। কেননা, ভাষা ছিনিয়ে নেওয়ার পরই সংস্কৃতি, পরিচিতি ও অধিকার ছিনিয়ে নিতে উদ্যত হয়েছিল পাকিস্তানি জান্তা। চাকরিবাকরি, ব্যবসা, রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতিতে বাঙালিকে কোণঠাসা ও বিপদাপন্ন করার সেই চক্রান্ত বাঙালিরা রুখে দিয়েছিল বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে।

শুধু তাই নয়, ভাষা আন্দোলনের সোপান পেরিয়ে বাঙালি আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে বেগবান করেছিল এবং শেষ পর্যন্ত রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জন করেছিল স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ।

তন্দ্রাহীন, অক্লান্ত একুশের চেতনা বাংলাদেশ ও বাঙালিকে যেমন দিয়েছে মুক্তির দিশা, তেমনই প্রতিনিয়ত উন্নয়ন ও অগ্রগতি পথে চলার দীপ্ত সাহস দিচ্ছে। আত্মপরিচিতি ও আত্মমর্যাদার সঙ্গে সামনে চলার প্রেরণা নিহিত রয়েছে একুশের অতন্দ্র চেতনায়। অমর একুশের মাহেন্দ্রক্ষণে ভাষাশহিদ এবং ভাষাসৈনিকদের প্রতি সমগ্র জাতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের পাশাপাশি দুর্নিবার এগিয়ে চলার উজ্জীবিত শপথে ঘোষণা করছে বাংলাদেশ ও বাঙালির বিজয়বার্তা।

এ সম্পর্কিত আরও খবর