‘সুখী’ দেশের ‘অসুখী’ চেহারা!

, ফিচার

মায়াবতী মৃন্ময়ী, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-30 03:26:51

ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড বা প্রথম বিশ্বের ঝা-চকচকে উন্নত দেশগুলোর কথা ভাবলেই সাধারণ মানুষ উদ্বেলিত হন। গল্পে, ছবিতে, নানা বিবরণে মনে হয় দেশগুলো যেন স্বর্গের প্রতিরূপ। বিশ্বের সবচেয়ে সুখী ও শান্তির দেশসমূহের তালিকায় শীর্ষে থাকে তারা। ইউরোপ, উত্তর আমেরিকার সেসব দেশ বাকি পৃথিবীর কাছে সোনার হরিণের মতো।

কিন্তু বাস্তবে ‘সুখী’ দেশগুলোর রয়েছে ‘অসুখী’ চেহারা। সন্ত্রাস, মাদক, যৌন নিপীড়নের গোপন প্রবাহ সেখানেও প্রবল। স্কুলের শিক্ষক, চার্চের পুরোহিত, সমাজের মানুষ আচ্ছন্ন বিভিন্ন বিকৃতি ও অপরাধে। সেখানে সবচেয়ে মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে সাম্প্রতিককালে চিহ্নিত হয়েছে মানুষে মানুষে বিশ্বাসহীনতা। বিশ্বাসের পতনের মতো বিষয়গুলো পরিবার ভেঙে দিচ্ছে, স্বামী-স্ত্রী’র মধ্যে অবিশ্বাস ও বিচ্ছেদ ঘটাচ্ছে, পরকীয়ায় ঠেলে দিচ্ছে ব্যাপকহারে।

জেনে আশ্চর্য হবেন, পরকীয়া প্রেমে সবচেয়ে বেশি জড়িয়ে পড়েন প্রথম বিশ্বের সুখী দেশের অসুখী নাগরিকরা। করোনার দহনকালেও পরকীয়ায় সেরার শিরোপা ছিনিয়ে নিয়েছে আয়ারল্যান্ড। এই তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে জার্মানি। একটি অনলাইন ডেটিং সাইটের সদ্য-করা একটি সমীক্ষায় উঠে এসেছে এমনই তথ্য।

অনলাইন ডেটিং সাইটের করা সেই সমীক্ষা বলছে, আয়ারল্যান্ডের প্রতি পাঁচজন বাসিন্দাদের মধ্যে একজন পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে পড়েন। বিবাহে প্রতারণার হার এই দেশে প্রায় ২০ শতাংশ।

দ্বিতীয় স্থানে থাকা জার্মানির প্রায় ১৩ শতাংশ নাগরিক কখনও না কখনও পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন।

সমীক্ষায় তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে কলোম্বিয়ার নাম। এই দেশের পরকীয়ার হার ৮ শতাংশের কাছাকাছি।

শুধু পরকীয়া বা বৈবাহিক সম্পর্কের ভেতর প্রতারণা নয়, সেখানে মানুষের মধ্যে বাড়ছে অবিশ্বাস, বিষাদ ও নিঃসঙ্গতা। সেখানকার অতি-আধুনিক জীবনের গতিবেগ যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে একাকিত্ব। আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এই মানসিক সমস্যাকে হেলাফেলা করে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা। অনেকেই উপলব্ধি করেন না যে, কোনও ধরনের মানসিক সমস্যা মনের অসুবিধাতেই সীমাবদ্ধ থাকে না। ক্রমেই শরীর-মন সব কিছুকেই গ্রাস করে। পাশাপাশি, নেতিবাচক প্রভাব ফেলে আক্রান্তের সামগ্রিক জীবনযাপনে। ফলে নিজের পাশাপাশি, ক্ষতি হয় পরিবার-পরিজনেরও। তৈরি হয় নানা বিকৃতি ও অপরাধ।

ইংল্যান্ডের জাতীয় পরিসংখ্যান মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা বলছে, ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সিদের মধ্যে ৬০ শতাংশই কোনও না কোনও ভাবে একাকিত্বের শিকার। আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিকতম গবেষণা জানাচ্ছে, কোভিড চলাকালীন ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সিদের মধ্যে কার্যত মহামারির রূপ নিয়েছে একাকিত্ব।

বিশেষজ্ঞদের মতে, পার্থিব সাফল্যকেই জীবনের একমাত্র মোক্ষ ভাবা যে ঠিক নয়, তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে উন্নত দেশে। সেখানে পেশাগত জীবনের ইঁদুর দৌড়ের মাঝে পড়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষজন এমন কিছু জিনিস অবহেলা করেন, যেগুলো হয়তো তাদের জীবনের মূল উপজীব্য ছিল। এর ফলে সাফল্য এলেও তাকে উপভোগ করার মতো মানসিক শান্তি অধরা থেকে যায় অনেক ক্ষেত্রেই। তৈরি হয় অতৃপ্তি, বিষাদ ও অবিশ্বাস।

অনেকেই ভেবে থাকেন, উন্নত দেশের নানা আয়োজন ও চারপাশে বহু মানুষের ভিড় থাকলে কেউ একাকিত্ব বোধ করতে পারেন না। এটি একেবারেই ভ্রান্ত একটি ধারণা বলেও জানাচ্ছে বিভিন্ন সমীক্ষা। বন্ধুদের সংখ্যা বা অফিসের জনপ্রিয়তা, কোনও কিছুই একাকিত্বের পথ্য নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, যে নেটমাধ্যমে মানুষ বন্ধু খোঁজে, সেই নেটমাধ্যমই আরও হতাশা ও নিঃসঙ্গতার গহ্বরে ঠেলে দেয় বাস্তব থেকে।

কঠোর যান্ত্রিক ও উগ্র প্রতিযোগিতামূলক উন্নত সমাজের ইট, কাঠ, পাথরের জঙ্গলে নিজের জায়গা ধরে রাখতে অনেকেই চাপিয়ে নেন সাইবার জগতের ছদ্মবেশ। নিজের আসল ব্যক্তি পরিচয় নিয়ে তৈরি হয় হীনমন্যতা। নিজের থেকে আলাদা কাল্পনিক কোনও এক আদর্শ মানুষ হয়ে ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে সহজ স্বভাবিকত্ব নষ্ট হয়। কিংবা নিজের স্বামী, পরিবার, পরিজনকে বাদ দিয়ে কাল্পনিক জগতের বাসিন্দা হন তারা। জড়িয়ে পড়েন পরকীয়া, মাদকাসক্তি, অবসাদগ্রস্ততা, বিকৃতি ও অপরাধের দুষ্টচক্রে।

মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞরা দারুণভাবে চিন্তিত এসব সমস্যা নিয়ে। তাদের সামনে বড় প্রশ্ন, কী ভাবে মিলতে পারে মুক্তি? মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, এসব সমস্যায় সবার আগে বুঝতে হবে নিজের মনকে। চিনতে হবে নিজের ভাল লাগা-ভাল থাকার ক্ষেত্র। মানসিক ভাবে বিচ্ছিন্ন বোধ করলে, পরিবার ও সঙ্গীর কাছ থেকে দূরে সরে গেলে জীবনের সাফল্য উপভোগ্য হয় না। কাজেই নিজের পেশাগত স্বার্থ ও সাফল্যের থেকেও দিন শেষে বেশি গুরুত্বপূর্ণ শান্তি, সুখ ও বিশ্বাস। এসবই এখন খুঁজছে ‘সুখী’ দেশগুলোর ‘অসুখী’ মানুষেরা।

এ সম্পর্কিত আরও খবর