ওরা অভ্যর্থনা জানাবে আপনাকে!

, ফিচার

সুলতান মাহমুদ আরিফ | 2023-09-01 15:05:46

ওরা ডানা মেলে আপনাকে অভ্যর্থনা জানাবে। আপনি যেই হোন না কেন, ওদের কাছে আপনি তখন বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আপনাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে ওরা ক্ষান্ত হবে না, আপনাকে গন্তব্যেও পৌঁছে দেবে! শুধু তাই নয়, আপনি যখন ফিরে আসবেন তখনও ওরা আপনাকে সঙ্গ দেবে। এ যেন আথিথেয়তার এক দারুণ দৃষ্টান্ত! এরা আপনার মনকে নিমিষেই ভালো করে দেবে; এদের রয়েছে নানান বাচনভঙ্গি, যা আপনাকে মোহিত না করে পারবে না।

বলছিলাম, সেন্টমার্টিনে আসা-যাওয়ার পথে সঙ্গ দেওয়া গাঙচিলের সাথে গড়ে উঠা সখ্যর কথা। টেকনাফ হয়ে প্রবাহিত নাফ নদীতে দেখা মিলবে ঝাঁকে ঝাঁকে এই গাঙচিলের। যারা ঠিক নাফ নদী থেকেই বঙ্গোপসাগর হয়ে আপনাকে ডানা মেলে স্বাগত জানানোর মাধ্যমে পৌঁছাবে দক্ষিণের স্বর্গ সেন্টমার্টিন।

আকাশে উড়ে-বেড়ানো আর সমুদ্রের পানিতে মিশে যাওয়া ধূসর পালকে সাজানো এই পাখিগুলো খুব সহজেই আপনার কাছে এসে অভ্যর্থনা জানাবে। টেকনাফ থেকে নীলজলঘেরা নারিকেল আর সুপারি গাছে ঘেরা দ্বীপ সেন্টমার্টিনে যেতে সময় লাগে দুই থেকে তিন ঘণ্টা, এই পুরো সময়টাতে আপনার সাথে থাকবে।

আপনি যেই হোন না কেন, ওদের কাছে আপনি তখন বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

নীল আকাশের সাথে সাদা রং মিশে গিয়ে পরিবেশকে আরও সুন্দর করে তোলে গাঙচিল। অপরুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কোনো জো খুঁজে পাবেন না আপনি। চোখের দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরানোর সুযোগ দিবে না তারা। কিছুক্ষণ পরপর তারা তাদের বাসায় আপনার মনোযোগ আকর্ষণ করে ডাক দিবে। এই যেন ভিন্নরকম এক ভালো লাগা অনুভব করবেন আপনি।

এরা আপনার জাহাজ বা নৌকা ধরেই ঠিক এপাশ-ওপাশ করে আপনাকে সঙ্গ দেবে। এদের বিশ্রাম খুব সামান্য সময়। উড়তে উড়তে ক্লান্ত হলে এরা পানিতেই বসে পড়ে, আবার উড়ে এসে আপনাকে বিনোদন দেবে,সখ্য দিবে, স্বাগত জানাবে। আপনার হাতে থাকা চিপস, বিস্কুট ওরা ওদের মনে করেই খেতে আসবে, আর নিয়েই দিবে ছুট। এই যেন স্রষ্টার অপার সৌন্দর্যের লীলা। দক্ষিণের স্বর্গ বলে পরিচিত সেন্টমার্টিন যাবেন আর এমন অভ্যর্থনা হবে না এটাকি ভাবা যায়! সেই অভ্যর্থনার ষোলকলা পূর্ণ করেছে এই গাঙচিল।

এরা দেখতে ধূসর বা সাদা, শরীরে ছাই ছাই ছোপ।

এই পাখির বর্ণনা বলে কয়েও কাউকে অনুধাবন করানো সম্ভব না। এরা দেখতে ধূসর বা সাদা, শরীরে ছাই ছাই ছোপ। এদের মাথা-বুক-পেট কালচে। পিঠ ও লেজ সাদা। পা দুটি লাল। হাঁসের মতো পায়ের পাতা জোড়া। এই কারণে জলে সহজেই সাঁতার কাটতে পারে এরা। এদের পাগুলো বেশ লম্বা হয়ে থাকে। ডানা লম্বা ও শক্তিশালী। ঠোঁটের রং অনেকটাই পায়ের মত, তবে হলদেটে ভাব আছে কিছুটা। লেজ অনেকটা ফিঙে পাখির মতো বিভক্ত। ডানার লম্বা পালকগুলো কালচে ধূসর। আকৃতিতে মাঝারি থেকে বড় হয়ে থাকে।

এই পাখির বর্ণনা বলে কয়েও কাউকে অনুধাবন করানো সম্ভব না। 

গৃহপালিত পাখি কবুতর বা পায়রা থেকে আকারে ছোট হয় এই গাল পাখি বা গাঙচিল। এদের ডাক খুব কর্কশ বলা চলে। শীতে সচরাচর এরা নীরব থাকে, কিন্তু মাঝে মাঝে উচ্চকণ্ঠে ‘ক্রি-অ্যাব ক্রি-অ্যাব ক্রি-অ্যাব’ স্বরে ডাকে। ছেলে ও মেয়েপাখির চেহেরায় ভিন্নতা না থাকাই সহজেই পৃথক করা খুব কঠিন।

এরা অনায়াসে আকাশে দীর্ঘক্ষণ উড়তে পারে। হাওয়া থাকলে খুব কমই ডানা সঞ্চালন করে। দু' চারবার ডানা নেড়ে এরা স্বচ্ছন্দে আকাশে ঘুরে বেড়াতে পারে। উড়তে উড়তে ঠিক যেন আকাশ ধরে ফেলে এরা। দূর থেকে বুঝা যায় যেন আকাশের সাথে মিতালি খেলছে এরা।

এরা অনায়াসে আকাশে দীর্ঘক্ষণ উড়তে পারে। 

উপকূল, নদী, মিঠাপানির হ্রদ, জাহাজ বা লঞ্চঘাট, লবণাক্ত পানি ও জলাধারায় এদের বসবাস। প্রজনন মৌসুম ছাড়া অন্য সময় সচরাচর একাকী বা দু-তিনটি একসঙ্গে থকে। তবে মাছের আধিক্য থাকলে একসঙ্গে বহু পাখি দেখা যায়। ছোট ছোট মাছ, চিংড়ি জাতীয় অমেরুদণ্ডীয় প্রাণী ও পানির উপর ভাসমান পোকা এদের খাবার। সেন্টমার্টিনের স্থায়ী বাসিন্দাদের মত বলা যায়, এরাও কিছুটা পর্যটক নির্ভর।

পর্যটক দেখলেই এরা জাহাজ কিংবা নৌকার সাথে পাল্লা দিয়ে উড়ে বেড়ায় আর পর্যটকের দেয়া চিপস, বিস্কুট ইত্যাদি নেয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় নামে। তবে খুব চালাক এরা। এমনভাবে আপনার হাত থেকে খাদ্য নিয়ে নিবে আপনি এদের ধরার কোন সুযোগ পাবে না।

খাবার নিয়ে দেখবেন, এরা উড়ে উড়ে উড়ে খায় না, পানিতে ভাসমানভাবে এরা বসে আপনার দেয়া খাবার খেয়ে আবারও আপনার পিছু ছুটবে এরা। এই জন্য আপনাকে নিয়েই যত আয়োজন এদের।

গাঙচিলদের মাঝেও আছে গভীর প্রেম।

এদের অধিকাংশই পরিযায়ী পাখি। এরা বাসা বাঁধে পাথরের খাঁজে। শুকনো শেওলা দিয়ে বাসা তৈরি করে তাতে দুটি ও তিনটি ডিম পাড়ে। ডিম ফোটে ২৫ দিনে। সদ্য ফোটা বাচ্চার কোমল পালকের রং ঘিয়ে-হলুদ বা রুপালি-সাদা। বাচ্চারা প্রায় পাঁচ দিনে বাসা ছাড়ে এবং চার-পাঁচ বছর বয়সে প্রজননক্ষম হয় এরা। এছাড়া গাঙচিলের ডিম খাদ্য হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই সমাদৃত।

গাঙচিলদের মাঝেও আছে গভীর প্রেম। মেয়ে পাখিকে প্রেমের জালে আবদ্ধ করতে পুরুষ পাখীদের থাকে নানা চেষ্টা প্রচেষ্টা। জানা যায়, প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখিরা মেয়ে পাখিকে আয়ত্বে আনার জন্য সকল চেষ্টা করে যায়। নিজেরা না খেয়ে মেয়ে পাখিকে খাওয়াই। এভাবে আট-দশটা ছেলে গাঙচিল একটা মেয়ে পাখির পিছু লাগে। নিজেদের মাঝে এ নিয়ে লেগে যায় ঝগড়া। অবশেষে যে অন্যদের তাড়িয়ে দিয়ে মেয়ে পাখির মন জয় করতে পারে তার সাথে হয় সংসার, সখ্য আর ভালোবাসা।

এ সম্পর্কিত আরও খবর