শ্যাওড়াপাড়া ‘টু’বনশ্রী, পাবলিক বাসের জনতা

, ফিচার

মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 19:18:22

নভেম্বরের শেষে অন্ধকার নামার পর ৭টা ৪০ মিনিটকে এখন রাতই বললেই চলে। আমি শ্যাওড়াপাড়া বাস স্ট্যান্ড থেকে বনশ্রীর ‘এ’ ব্লকে নিজ বাসায় ফিরে যাব বলে অপেক্ষা করছি। এই সাড়ে এগারো কিলোমিটারের জন্য সিএনজি ভাড়া চাইল ৪০০ টাকা। তাই সামনে আসা ‘আলিফ’ পরিবহনটিকেই বেছে নিলাম।

এই শহরে পাবলিক বাসের যাত্রী নামানো বা উঠানোর কোনো নিয়মনীতি নেই। তাই ভিনদেশি কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘আপনাদের এখানে বাস স্টপেজ কোথায়?’ আমি এক কথায় জবাব দেই, এখানে কোনো বাস স্টপেজ নেই। এখানে লাফ দিয়ে বাসে উঠতে এবং নামতে হয়। আজ মিরপুর থেকে যাত্রীর চাপ একটু কম বোঝা যাচ্ছিল। বাসের সামনে সাদা কাগজে প্রিন্ট করে লেখা রয়েছে ‘ডিজেল চালিত’। আর পরিবহনটি যে বনশ্রী যাবে সেটিও গন্তব্য স্থানগুলোর মধ্যে উল্লেখ রয়েছে। হাত পাঁচেক দূরে থাকতেই বাসের হেলপারকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সিট আছে?’ উত্তরে  ‘হ্যাঁ’ শুনতে পেয়ে উঠে গেলাম। চলে গেলাম বাসের পেছনের দিকে।

আমার প্রায়ই মনে হয় ‘নির্মাণ কাজ’ হচ্ছে ঢাকা শহরের এক নির্মোহ সৌন্দর্য। সৌন্দর্য যেমন চারদিকে ছড়িয়ে দিতে হয়, তেমনি এই শহরের যেকোনো স্থানে নির্মান কাজ শুরু হলে সেটি পুরো শহরেই যেন ছড়িয়ে দেয়ার একটা তাগিদ থাকে কর্তৃপক্ষের। হয়তো কোথাও কম, কোথাও বেশি। তাই মিরপুর এবং শহরের যতটুকু পথে মেট্রোরেলের কাজ চলছে, সেখানে হয়তো ধুলো প্রতি এক কিলোমিটারে ১ মণ করে উড়ছে, অন্য স্থানে হয়তো ২০ কেজি করে উড়ছে। পার্থক্য এটুকুর চেয়ে খুব বেশি বলা যায় না।


বাসে উঠার আগে যেহেতু নিচের দিকে সিলিন্ডার রয়েছে কি না, সেটি পরীক্ষা করা হয়নি, তাই ‘ডিজেল চালিত’ কথাটাই বিশ্বাস শান্তিপূর্ণ। শহরের বাস মালিকদের সঙ্গে সরকার এবং যাত্রীদের সিটিং সার্ভিস বা গেইটলক নিয়ে খুব কথা কাটাকাটি চলছে। কিন্তু এতো ঘনবসতির এই শহরে বাসে এতোগুলো সিট না রেখে বেশি করে দাঁড়ানোর জায়গা রাখলেই ভালো হতো। শুধুমাত্র প্রতিবন্ধী এবং বয়স্কদের জন্য নির্দিষ্ট আসন রাখা প্রয়োজন। এসব ভাবতে ভাবতে বাস যে কখন আঁগারগাও চলে আসলো, খেয়ালই নেই। পাশে এসে বসলেন নীল শার্ট গায়ে দেয়া এক প্রৌঢ় বয়সী ভদ্রলোক। এখান থেকে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় পর্যন্ত এই সড়কে কেউ বাসে দাঁড়ানোর জন্য অপেক্ষা করে না সাধারণত। তাই যানজট এটুকু পথে নাই, ৫ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সামনে চলে এলাম।

জাহাঙ্গীর গেটের সিগন্যালে আর বেশি সময় যানজটে থাকতে হলো না। কিন্তু মহাখালী রেলগেটের সিগন্যালটি পার হতে বেশ সময় লেগে গেলো। আর বাসটি পথের ধারে, মাঝখানে, কোনাকুনিভাবে, সকলভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে শুরু করলো। এর মধ্যেই পাশের আসনের ভদ্রলোকের কথা কানে আসছিল কিছুক্ষণ পর পর। নিজে নিজে কথা বলছেন তিনি। ‘এই জন্যই এই বাসে উঠি না’, ‘এর চাইতে ক্যান্টনমেন্টের ভিতর দিয়ে আসলে ভাল হতো’, ‘এটা নাকি আবার সিটিং বাস!’, এই ধরনের আরো অনেক অভিযোগ। রাত যখন ৮টা ৫০ মিনিট তখন বাস মহাখালী ওয়ারলেস গেটের দিকে যাচ্ছে। তিতুমীর কলেজের সামনের পথটা কিছুটা অন্ধকার। বাসে বসে থাকলে আসলেই শহরটাকে অন্যভাবে দেখা যায়। এই যেমন ডিবিসি টেলিভিশন চ্যানেলের অপর পার্শ্বের সড়কের পাশে কলম্বিয়া মার্কেট আছে। এটা এর আগে আমি জানতাম না। অথচ এই শহরে দুই দশকের বেশি সময় পার করছি। অবশ্য পরে এই শহরে জন্ম নেয়া অনেককেও জিজ্ঞাসা করে দেখলাম তারাও জানে না।


এই বাসে আমি মনে মনে কোনো একজনকে খুঁজছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে তার দেখা পেলাম। দুই ধরনের প্যাকেজ নিয়ে বাসে উঠেছেন তিনি। একটা ব্যাগে সবজি কাটা, চায়ের ছাকুনি, ডিম গোলানোর মেশিন সহ মোট ৫টি ছোট যন্ত্র ১০০ টাকায় বিক্রির জন্য। আরেকটি প্যাকেজ রয়েছে ৮টি বইয়ের মূল্য ১০০ টাকা।

এরই মধ্যে পেছন থেকে সিট পরিবর্তন করে সামনের দিকে বসেছি আমি। সামনের সিটের একজন যাত্রী বইগুলো নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখলেন। বললেন, ছবিগুলো পরিস্কার না বইয়ের। পেছন থেকে আরেক নারী বইগুলো উল্টিয়ে দেখে বললেন, সরকারই তো বই ফ্রি দেয়। তাহলে আর বই কিনবো কেন? নারী যাত্রীর কথাগুলো শুনে আমারই বিরক্ত লাগলো। তবে মধ্যবয়সী বিক্রেতা একটি ইয়র্কার ছুড়লেন।ওই নারী যাত্রীর উদ্দেশ্যে বললেন, এখনই যদি সব ফ্রি খুঁজতে থাকেন, আজীবনই ফ্রি’র পেছনে দৌড়াতে হবে। আর বইগুলো শুধু শিশুদের জন্য নয়, মা বাবারাও পড়তে পারবেন।


আগাঁরগাওয়ের পর আবার এখানেও চেকার উঠলো। মূলত বাসের যাত্রী সংখ্যা কত গুনতে। তবে সম্ভবত এটা সিটিং পরিবহন হওয়াতে বাসে দাঁড়িয়ে লোক নেয়ার নিয়ম নেই। অথচ প্রায় অর্ধেক বাসেই লোক দাঁড়ানো। চেকারের হাতের মুঠিতে ২০ টাকা গুজে দেয়াতেই যাত্রী সংখ্যা কমিয়ে লিখে নিল চেকার। এসব যাত্রী বান্ধব পন্থা এই দেশের যানবাহন সেক্টরের উদ্ভাবনী শক্তিকেই নির্দেশ করে।

গুলশন এক গোল চক্কর পার হয়ে আলিফ পরিবহন যখন মেরুল বাড্ডার পথে তখন দেখলাম পথের দুই পাশে নান্দনিক গুলশান লেক দেখা যাচ্ছে। তবে ধীরে ধীরে কিন্তু পথের উপরে দোকানের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। এই রাজধানীর কোনো প্রধান সড়কই আমার কাছে সরু মনে হয় না। বরং দখল হয়ে আছে হকার আর অবৈধ স্থাপনায়। হকারদের ভ্যান বা টুকরিতে এখন শীতের কাপড়ই বেশি।


ঢাকার যে স্থানে পৌঁছালে আপনার নাকে কাঁচা কাঠের গন্ধ আসবে, সে স্থানটি যে বাড্ডা ছাড়া কিছু নয়, সেটি নিশ্চিত হবেন। এখানে এখনো রাস্তার দু’পাশে বড় জায়গা নিয়ে কয়েকটি স’মিল রয়েছে। শহরের সবচেয়ে ধীর গতির সড়কের একটি এই প্রগতি সরণি। যেখানে ঠেলা গাড়ি থেকে শুরু করে দূর পাল্লার বাস পর্যন্ত চলে। তাই বাসের গতি হয়ে গেলো আরো ধীর।রামপুরা ব্রিজ পাড় হয়ে যখন বাস উত্তর দিকে মোড় নিল, ভাবলাম এবার নেমে যাই। সময় তখন ৯টা বেজে ৫০ মিনিট। প্রায় ২ ঘন্টা ১০ মিনিট বাসে। একবার মনে হলো চালক বা হেলপারকে বলি একটু ফুটপাথের কিনারে বাসটা থামাতে, শরীরটা বেশি ভাল নয়। পরেই মনে আসলো, এটা বললে ধাক্কা দিয়ে নামাতে পারে। বরং পেছন দিকে লক্ষ্য রেখে লাফ দিয়ে ওঠা নামার কৌশল কাজে লাগানোই ভাল।

এ সম্পর্কিত আরও খবর