গরমটা এড়াতে পারলে দিল্লির মতো ভালো জায়গা নেই!

, ফিচার

সম্প্রীতি চক্রবর্তী, কলকাতা | 2024-01-17 20:55:58

জয়পুর, আগ্রা ঘুরে দিল্লিতে ফিরে এসেছি। লাল কেল্লা বাদ দিয়ে অনেক কিছুই এখনও দেখা বাকি রাজধানীতে। প্রথমে যাওয়া হলো কুতুব মিনার। শুধুমাত্র একটা স্মৃতিস্তম্ভ আশা করেছিলাম, যেমন কলকাতায় একলা মিনার দাঁড়িয়ে থাকে। গিয়ে বুঝলাম অনেকটাই বড়ো জায়গা এবং দেখার বিবিধ জিনিস। পাথরের কাজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নানা দিকে। সুলতানী যুগের প্রথম দিকের কীর্তি বলে হয়তো মার্বেল বা দামি পাথর (যাকে বলে সেমি precious stone) একেবারেই নেই, মুঘল স্থাপত্যের চেয়ে এগুলোর ধরনশৈলী আলাদা।

তাজমহল বা লাল কেল্লা দেখার পর এই বড়ো মিনার, গম্বুজ গুলোকে খানিক রুক্ষই মনে হয়। অমসৃন, আয়তনে সমান নয়, জায়গায় জায়গায় ক্ষয় ধরেছে, মুঘল মিনারের যে symmetry র ধারণা, তা একেবারেই অনুপস্থিত।

জঙ্গল আর সাজানো বাগান যে ভাবে আলাদা, মুঘল আর সুলতানি স্থাপত্যে অনেকটা সেরম বৈসাদৃশ্য চোখে পড়লো। কোনোরকম হীনভাবে মন্তব্য না করেই বলা, জঙ্গলেরও তো আলাদা মাহাত্ম্য আছে, অনেকের কাছে মেকি শহুরে বাগানের থেকে রুক্ষ স্বাধীন জঙ্গল অনেক কাছের।

কুতুব মিনারের পাশেই সবুজ ঘাসের মাঠ, ছোট প্রাচীরে ঘেরা জায়গা, সেইসব মাটির দেওয়ালে নারী-পুরুষের অবয়ব আঁকা। ভীষণ অবাক করা, কারণ ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি ইসলামি শিল্পকলায় কোনওরকম মানুষের প্রতিকৃতি থাকেনা, এটাই নিয়ম। তাহলে এগুলো কি পরে সংযোজন করা হয়েছে? মুসলমান শাসনের অনেক পরে?

উত্তর যাই হোক না কেনো, সবুজ ঘাসের পাশে, নাতিদীর্ঘ প্রাচীরে এই কারুকার্যগুলো দেখে ভালো লাগা ছাড়া উপায় নেই। পাশেই পাথরের জানলা, মৃদুমন্দ হাওয়া দিচ্ছে, অনেকে সেখানে বসে ফটো তুলছে। হঠাৎ সেদিকে তাকালে ভুলে যেতে হয় এমন একটা শহরে দাঁড়িয়ে রয়েছি যেখানে মেট্রো, uber, মল, পাব সবই উপস্থিত। সোনালি রোদ এসে পড়ছে ঘাসে, মনে হচ্ছে এখুনি ঘোড়া ছুটিয়ে চলে আসতে পারে কোনো সম্রাটের পেয়াদা। কিছু একটা বলবে সে তাঁদেরই ভাষায়, আমি যথারীতি বুঝতে পারবোনা, হয়তো আমি সুদূর পারের কোনো পর্যটক।

এই পর্যটক বলতে গিয়েই পরের কথায় আসি। কুতুব মিনারের পর গেলাম জামালি কামালি নামক একটি পরিত্যক্ত সমাধি-মসজিদে। জামালি একজন ভূ -পর্যটক ছিলেন, সাথে এক সুফিসন্ত ও বটে। মধ্যপ্রাচ্য ঘুরে তিনি আসেন দিল্লিতে, তারপর লোদি সম্রাটের দরবারে সভা কবি নিযুক্ত হন। কামালি ছিলেন জামালির শিষ্য। তিনি পুরুষ না নারী সেই নিয়ে বিস্তর মতভেদ আছে। কেউ বলেন কামালি সুফি পরম্পরায় জামালির শিষ্য এবং তার প্ৰিয় মানুষ। কারুর মতে কামালি আসলে জামালির স্ত্রী। সম্পর্ক যাই থাকুক, এই দুজনের প্রেম সৌহার্দের প্রতীক এই জামালি কামালি সমাধি।

একটা মজার ঘটনা যদিও আছে, এখানে সম্প্রতি ভূতেরা বাসা বেঁধেছে এরম কানাঘুষো শোনা যায়। অনেকের কাছে জামালি কামালি এখন দিল্লির অন্যতম haunted place।

পরের গন্তব্যস্হল হুমায়ুনের সমাধি। তাজমহলের সাথে এখানকার স্থাপত্যের মিল আছে। কেন্দ্রে রয়েছে মূল সমাধিটি আর তার চার পাশে একই রকম দেখতে চারটি গম্বুজ। আবার ও মুঘলদের সিমেট্রির ধারণার এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

এই সমাধিটি দেখার পর চললাম আগ্রাসেনের বাওলি দেখতে। বাওলি অর্থে সিঁড়ি দিয়ে ঘেরা ছোট জলাশয়, অনেকে একে ওয়াটার টেম্পল বলে থাকে। এটি দিল্লির সবচেয়ে পুরোনো স্থাপত্য। কে এর স্রষ্ঠা তা নিয়ে মতভেদ থাকলেও অনেকে বলেন এটি ৩০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে তৈরি হয়েছে, মহাভারতের সময়। রাজা আগ্রাসেন বানিয়েছিলেন এবং তারপর রক্ষণাবেক্ষণ হয়ে আজও এটি একই রকম ভাবে রয়েছে।

এখানে এসে একটু থেমে গিয়ে ভাবা দরকার, এতদিন ধরে দিল্লি ঘুরছি, সব সমাধি মিনার ই কিন্তু ১২০০ শতাব্দীর পর নির্মিত। অর্থাৎ কোনোটাই ৮০০/৯০০ বছরের বেশি পুরোনো নয়। এই বাওলি তে ঢুকে কিন্তু সেই কালানুক্রম ভাঙবে, কারণ এর বয়স নিদেনপক্ষে সাড়ে চার থেকে পাচঁ হাজার বছর। তাহলেই বুঝুন সময়ের তারতম্য। হুমায়ুনের সমাধি দেখে বাওলি তে ঢুকেছি, কিন্তু এক ধাক্কায় পিছিয়ে যেতে হয়েছে চার হাজার বছর।

বাওলির দক্ষিণ পূর্ব কোণে একটি ছোট মসজিদ রয়েছে। বোঝা যায় পরে সুলতানী বা মুঘলযুগে এটি তৈরি করা হয়েছে। কালো পাথরে নির্মিত হিন্দুরাজার ওয়াটার temple এর সাথে একে একেবারেই বেমানান মনে হচ্ছেনা। তবে একটা বিষয় বেখাপ্পা লাগলো, বাওলি টি দিল্লির skyscrapper ঘেরা শহরের একদম মধ্যিখানে অবস্থিত৷। stepwell এর সিঁড়িতে বসে আপনি পিছনে দেখতে পাবেন ৩০ - ৪০ তলা ফ্ল্যাট। তাতে ইতিহাসের সিঁড়ি বেয়ে টাইম ট্রাভেলটি হবে না, গাড়ির হর্ন বা সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত কোনো ছবির গান বাজালে ৫০০০ বছর পিছিয়ে গিয়ে মহাভারতের সময়কে ছোঁয়া অসম্ভব।

দিল্লিদর্শন মোটামুটি শেষ, অনেক কিছু বাদ রয়ে গেলো। চারপাশের পিচ গলা রোদ্দুর বারে বারে পরিশ্রান্ত করে চলেছে, অথচ দিল্লির দ্রষ্টব্য স্থান সবই বন্ধ হয় বিকেল পাচঁটার মধ্যে।

এ এক বিষম টানাপোড়েন, শরীর কাহিল, অথচ দেখার চোখ থামতে চাইছেনা কিছুতেই। শেষে দিল্লি সম্পর্কে কয়েকটা কথা বলে এই পাঁচ পর্বে সম্মিলিত ভ্রমণবৃত্তান্ত শেষ করবো। প্রথনেই বলার, দিল্লিতে যাওয়ার আগে weather forecast দেখে যাওয়া, গরমকাল এড়িয়ে যাওয়া বাঞ্ছনীয়, এমনকী অক্টোবরের প্রথম হপ্তাতেও রৌদ্রতাপে নাভিশ্বাস ওঠে। গরমটা এড়াতে পারলে দিল্লির মতো ভালো জায়গা নেই, খাওয়াদাওয়া অতুলনীয়, প্রচুর হেরিটেজ দোকান চারপাশে। দি পলস এর কফি, করিমস এ বিরিয়ানি, জনপথ বা সরোজিনী তে কেনাকাটি নিয়ে দিল্লির লাড্ডু খেলে আদপে পস্তাবেন না।

সম্প্রীতি চক্রবর্তী, পিএইচডি গবেষক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা।

এ সম্পর্কিত আরও খবর