গাড়ি যতোই এগোচ্ছে বুঝতে পারছি পিঙ্ক সিটি জয়পুর

, ফিচার

সম্প্রীতি চক্রবর্তী, কলকাতা | 2023-12-21 20:22:41

সকালে তাজমহল দেখে আগ্রা থেকে রওনা দিয়েছি জয়পুরের দিকে। আগ্রা থেকে পায়েঠা কিনে নেওয়া হলো, উত্তরপ্রদেশের বিখ্যাত মিষ্টি, অনেকটা মোরব্বার মতো খেতে, বিভিন্ন স্বাদের বিক্রি হয়ে, আমি বেছে নিলাম আম আর কেশর।

রাজস্থান যাওয়ার পথ অত্যন্ত সুন্দর। আসতে আসতে চারপাশটা বদলে যাচ্ছে। আমরা গাড়িতে রাজস্থানি গান চালিয়েছি, বেশ একটা মেজাজ তৈরি হচ্ছে তাতে।

দুপুর নাগাদ একটা অতি সাধারণ ধাবায় নামলাম। কলকাতার ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা ভাতের হোটেলের মতো, ছোট, ছিমছাম। পনিরের তরকারি আর পরোটা অর্ডার দেওয়া হলো। হাত ধুতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম, একটা বিশাল ভুট্টা খেতের পাশে ধাবাটি। সবুজ ধূ ধূ প্রান্তর, হাওয়া দিচ্ছে ভালো, যতসামান্য লোক উপস্থিত, তারা অন্য ভাষায় কথা বলছে।

এই পরিবেশে নিজের পরিচয় নিয়ে খুব সংশয় হয়। নিজেকে ভুলে কেমন অদৃশ্য হয়ে চারপাশটা সন্তর্পনে দেখে চলেছি। কেউ আমায় চেনেনা, আমি কাউকে চিনিনা, তাও বুঝতে চেষ্টা করছি তাঁদের জীবনের আদব-কায়দা।

ভারতে ঘোরার এই এক সুবিধা, কিছুদূর যেতে না যেতেই বাতাস, গাছপালা, মানুষের ভাষা, জামাকাপড় সব বদলে যায়। খাবার আসতেই সুগন্ধে চারদিক ভরে গেলো। এখানে অতি সাধারণ দোকানেও এতো ভালো খাবার কিভাবে বানায়, উত্তর নেই।

আরও কিছুটা যাওয়ার পর আরাবল্লি পাহাড়ের ছোট ছোট রেঞ্জ দেখতে পেলাম। পাহাড় মানেই আমরা যারা ঠান্ডা বুঝি, তাঁদের কাছে রাজস্থান একটা ম্যাজিকের মতো। ক্ষেত, ছোট টিলার মতো পাহাড় আর মাঝে মাঝে জনবসতি।

সন্ধে হয়ে আসছে, হোটেলে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত আটটা বাজলো। খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে পড়া ছাড়া উপায় নেই, হোটেলটি চমৎকার। সারাদিন রাস্তার ক্লান্তিতে বেশ আরামে রাতের ঘুমটা হলো।

 

সকাল বেলা উঠে কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট। খাওয়ার জায়গায় গিয়ে দেখলাম বুফে রয়েছে। তাতে সব ধরনের কুইসিন পাওয়া যাচ্ছে। পাউরুটি, সসেজ, হরেক রকম ফলের রস, স্যালাড, কচুরি, সব্জি, কফি, চা, ডিম ভেজে দেওয়ার জন্য এক বাবুর্চি আরও কতো কি।

কলকাতায় বুফে খেয়েছি অনেকবার, কিন্তু সক্কাল সক্কাল এতো খাবার দেখে সত্যিই মন ভালো হয়ে যায়। পেট ভরে খেয়ে এবার uber নিলাম আমের (Amber) ফোর্ট যাবো। একজন মহিলা ড্রাইভার এলো, আমার বান্ধবী তাঁকে দেখেই উচ্ছসিত হয়ে গাড়ির সামনে বসতে চাইলো। এতক্ষণ একটা পুরোদস্তুর শহরের মধ্যে ছিলাম, বড়ো বড়ো হোটেল, তাতে কোনো রাজস্থানি ছাপ নেই।

কিন্তু এবার গাড়ি যতোই এগোচ্ছে বুঝতে পারছি এটা পিঙ্ক সিটি জয়পুর। মূল এলাকায় ঢুকে পড়তে চারপাশে সব দোকান গোলাপি দেখতে পেলাম। তাদের মাথার উপর সাদা পাথরে দোকানের নাম লেখা। মনে করুন, আপনি শহরের রাস্তায় হাঁটছেন, আর আশেপাশের সব দোকান অমন সুদৃশ্য, কোনোটায় ক্ষয় নেই, ভীষণ সাজানো গোছানো, কলকাতায় বসে ভাবা যায়না।

আমের (Amber) ফোর্ট এ যেতেই গাড়ি চালকরা জানালো আজ রাজস্থান দিবস, তাই কোনো এন্ট্রি ফি লাগবে না। আমরা রাজস্থানে গেলাম রাজস্থান দিবসে, কাকতলীয় হলেও বেশ আনন্দের ব্যাপার। ওখানে আলাদা জিপ দাঁড়িয়ে, তারা পাহাড়ের উপর নিয়ে যাবে, কেল্লার মূল ফটকে। রাস্তা বেশ খাঁড়া, গাড়ির পিছনে বসেছি, নীচের দিকে তাকাতে সাহস পাচ্ছিনা। কয়েকটা সুসজ্জিত হাতি দেখতে পেলাম। কেল্লা যাওয়ার দুটো পথ, একটায় হাতির পিঠে চড়ে যাওয়া যায়, নতুবা আমাদের মতো জিপে।

আমের (Amber) ফোর্ট এ নামতেই কানে সুর ভেসে এলো। রাজস্থানি পোশাক পরিহিত লোক রাস্তায় বসে রাবণহাট্টা বাজাচ্ছে, ফোক সঙ্গীত সহযোগে। এই রাবণহাট্টা আসলে 'রাবণের হস্তে বীনার' অপভ্রংশ, দশানন ছিলেন সঙ্গীতপ্রিয় মানুষ, শিবের উপাসক, তাঁকে খুশি করতে তিনি এই যন্ত্র বাজাতেন। রাস্তায় এই বাদ্য সহযোগে অপূর্ব গান শুনে কিচ্ছুক্ষণ দাঁড়ালাম, এরকম তো সিনেমায় দেখেছি, নইলে ভিডিও, সামনে হতে দেখে অবিশ্বাস্য লাগছে।

কেল্লায় ঢোকার আগে অনেক দোকান, চুড়ি, রাজস্থানি ঘর সাজাবার জিনিস বিক্রি হচ্ছে। মূল দরজা দিয়ে ঢুকতেই কিছু লোক কারুকার্যময় ছাতা আর রাজস্থানি পাগড়ি নিয়ে এগিয়ে এলো । ওগুলো নিয়ে কুড়ি টাকার বিনিময় ফটো তোলা যাবে। সামনেই রঙিন আল্পনায় সজ্জিত হাতি দাঁড়িয়ে। প্রথমে কেল্লায় না ঢুকে আমরা ভুল করে অন্যদিকে চলে গিয়ে ছিলাম। বড় পাঁচিলের ওপারে শহরটাকে উপর থেকে দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ের গায়ে সিঁড়ি দেওয়া রাস্তা, ওঠে বুঝলাম এদিকে লোক কম আসে, তার মানে ভুল পথে যাচ্ছি।

এবার ঘুরে ঠিক দিকে যাওয়ার চেষ্টা। মূল কেল্লায় প্রবেশ, চারিদিকে ভীষণ সুন্দর আঁকা, হলুদ দেওয়ালে লাল, কমলা ফুল, কোথাও হাতি, কোথাও আবার রাধাকৃষ্ণ। আসার পথে সিল্কের উপর রাজস্থানি পেইন্টিং কিনলাম। বেরিয়ে এবার নাহারগার ফোর্টে যাওয়ার পালা।

নাহারগার মনে হয়, আমের ( Amber) এর থেকে অনেকটাই উঁচু জায়গায়। যেতে যেতে চারিদিকের পরিবেশ বদলে যাচ্ছে, ঠান্ডা হাওয়া শুরু হলো। নেমে বুঝলাম পাহাড়ের আরও উপরে চলে এসেছি। আমার এক দিদি জানালো, এখান থেকেই নাকি সোনার কেল্লায় ডক্টর হাজরাকে ফেলে দিয়েছিল নকল মিস্টার হাজরা। একটা সবুজ রঙা পুকুর পড়লো যাওয়ার পথে, স্টেপওয়েল এর মতো।

নাহারগারে ঢুকে বিভিন্ন কক্ষ ঘুরে দেখলাম। বিভিন্ন স্টোন এর কাজ, ঠিকরে পড়ছে দ্যুতি, একেবারে দিল্লির থেকে অন্য ঘরানা কোনো বাচ্চাও সহজে বলে দিতে পারে। আমের (Amber) ফোর্ট এর থেকে এখানে অনেক কম ভিড়, একটু secluded ও মনে হলো, বেশ সময় নিয়ে দেখলাম, ছবি তোলার ও অবকাশ পাওয়া গেলো।

ফেরার পথে জল মহলে নামলাম, বিশেষ কিছু দেখার নেই সেখানে, শুধু দূরে ঝিলের মাঝে একটি মহল দেখা যাচ্ছে, সেখানে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। মাছেদের খাবার নিয়ে বসে রয়েছে কয়েকজন তামিল মহিলা। জলের কাছে গিয়ে তাদের খেতে দিয়ে এবার চললাম হাওয়া মহলের দিকে। বিশাল এক ফটকের মতো মনে হলো, আবার সেই গোলাপি রঙা। প্রচুর দোকান সামনে, ইতিমধ্যে আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কালো চারিদিক, কিন্তু তবুও রাজস্থানের কেনাকাটা তাতে পন্ড হওয়া সম্ভব নয়। ব্যাগে একটা ছাতা রাখি সবসময়, ওটা খুলেই দোকানে দোকানে জামা, লেদার ব্যাগ, কানের দুল দেখা হলো।

কেনাকাটার পর্ব শেষ করে হোটেলে ফেরা। রাতে খেলাম রাজস্থানি lal mans, অর্থাৎ খুব ঝাল দিয়ে বানানো পাঁঠার মাংস। পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্ট করে দিল্লির দিকে রওনা হবো।

সম্প্রীতি চক্রবর্তী, পিএইচডি গবেষক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা।

এ সম্পর্কিত আরও খবর