ওল্ড দিল্লিতে ঢুকেই অন্যরকম পরিবেশ

, ফিচার

সম্প্রীতি চক্রবর্তী | 2023-08-31 12:19:42

শেষ বেলায় দিল্লি এসে পৌঁছেছি, পরদিনের শুরুতে প্রথমেই রাজধানীর রাজপথে। বাড়ি থেকে আলু পরোটা খেয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। সাকেত থেকে মেট্রোয় উঠে অবাক হওয়ার জো, এই সময়ও এতো ফাঁকা! দিল্লি মেট্রোতে নাকি কেউ দাঁড়ায় না। এতো ঘন ঘন ট্রেন, ভীষণ মাপের নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে থেকেও সবটা সময় মেনেই হচ্ছে।

তাছাড়া আমার নিতান্ত পছন্দের যে বিষয়, দিল্লিতে উর্দি ধারী লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে রাস্তায়, ট্রাফিক সিগন্যাল এ মাস্ক ছাড়া কাউকে দেখলেই ২০০০ টাকা জরিমানা। আমি করোনা আবহে যেরকম ভাবে থাকার চেষ্টা করি এহেন ব্যাপার তাতে যেন স্বর্গসুখ। কলকাতার ট্রামে বাসে চড়তে এখনো ভরসা পাইনা। কারণ এখানে মাস্ক পড়াটাকে অনেকে দূর্বলতার লক্ষণ ভাবে। দিল্লি সরকার সেই দিক দিয়ে এগিয়ে। তারা তোষণ এর রাজনীতি করেনা। যেটা প্রয়োজনীয় তা করবেই, তাতে লোক বিরক্ত হলে কিছু করার নেই। দিল্লিতে তাই অবাধে ঘুরে বেরিয়েছি অটো, মেট্রোতে।

ওল্ড দিল্লিতে ঢুকেই একটা অন্যরকম পরিবেশ অনুভব করলাম। লোক বেশি, গলি গুলোর দিকে তাকালে পুরোনো দিনের গন্ধ ভেসে আসে, কালো তারে আকাশ পরিপূর্ণ। একটা গলি তে ঢুকলাম। সামনেই অনেক গুলো রুপোর গয়নার দোকান। একটাতে ঢুকে কিছু junk jewellery কিনে ফেললাম, দিল্লি বলে কথা, কেনাকাটার পর্ব থাকবেই।

এবার কিছু খেয়ে লাল কেল্লা। ফোর্টে যাওয়ার পথে রাস্তার ধারে ধারে ছোট ছোট পিলার লক্ষ্য করলাম, লাল কেল্লার মতোই তাঁদের রং। কি সুন্দর সামঞ্জস্য তৈরি হয়েছে সবটা মিলে। গরম ভালই রয়েছে সেপ্টেম্বরের শেষে, তবে মাঝে মাঝে মেঘের ছায়া, এই যা সামান্য স্বস্তি।

রেড ফোর্ট এ ঢুকেই প্রথমে চোখে পড়লো একটা বাজার। এটি নিয়ে গেলো স্বর্গরাজ্য তার্কি তে। আমাকে যদি পৃথিবীর একটা দেশ এ নিয়ে যায় কেউ, বিনামূল্যে, যদি একটাই দেশ বাছতে বলে, আমি তুরস্কের ইস্তানবুল বাছবো। এই বাজারটি একেবারে সিনেমায় দেখা তুর্কির মতো। লাল গম্বুজের দুদিকে খোলা রাস্তা, তার মধ্যে শত শত দোকান। যেন সেই মুঘল আমল থেকেই এরা একই রয়ে গেছে। অনেক দোকানে পুরোনো পুঁথি বিক্রি হচ্ছে, replica ই হবে, সাথে পুরোনো postcard। তাতে মুঘল পেইন্টিং, কোনোটাতে রাধা কৃষ্ণ বা উর্দু, আরবি ফার্সি হরফে লেখা।

বাজার পেরিয়ে গিয়ে পড়লাম কেল্লার একেবারে মূল জায়গায়। দেওয়ানি আম, দেওয়ানি খাস, মনে হচ্ছিলো ভারতে এরকম জায়গা থাকতে পারে? আর একটা জিনিস মাথায় আসা ছাড়া উপায় নেই। কলকাতা ব্রিটিশ কলোনি রূপে গড়ে উঠেছে, ছোটবেলা থেকে এখানেই বড়ো হয়েছি, তবু যত সংস্কার ঔপনিবেশিক সময়ের সবই শুধু শহরের হোয়াইট টাউনে। যত প্রযুক্তি, যানবাহন সবেরই utilitarian দিক আছে বটে। ব্রিজ, রেলগাড়ী ভুলি কি করে! ভিক্টোরিয়া আছে নিশ্চয়ই, কিন্ত দিল্লি দেখে যেভাবে মুগ্ধ হলাম, কলকাতায় প্রথম বেড়াতে এলে colonial architecture সেইভাবে মোহিত করতো?

সাম্রাজ্যবাদ আর ঔপনিবেশিকতার প্রদর্শনে যে ফারাক তা তো জানি। মুঘল যুগে আকবর শাহজাহান স্থাপত্য কীর্তির মধ্যে দিয়ে রাজবংশীয় ক্ষমতার দ্যুতি ছড়াতো। মামুলি প্রজার কাছে ওটা শাসনের প্রতীক স্বরূপ। কিন্তু ব্রিটিশরা আসতে আসতে গঙ্গায় অনেক জল গড়িয়ে গেছে, ওটা utilitarianism এর যুগ, শিল্প বিপ্লবের মহিমায় রঞ্জিত সাহেবরা যতটুকু প্রয়োজন ততটাই করে, তার চুলচেরা হিসাব রাখে, পরতে পরতে। কোচবিহারে রাজা buckingham palace এর অনুকরণে প্রাসাদ বানিয়েছিলেন, কিন্তু ইংলিশ colonizers দের মদতে বা খরচে সেরকম কোনো স্থাপত্যশৈলী তৈরি হয়েছে? ভারতে বা পৃথিবীর আর কোনো উপনিবেশে?

রেড ফোর্টে দাঁড়িয়ে এই কথা গুলোই মাথায় ঘুরছিল। কিন্তু দিল্লির গরম টা সহ্য করা যায়না আর। ভীষণ ক্লান্তি বোধ হয়, কে আবার বলেছিল কলকাতার গরমে কষ্ট হয়, দিল্লিতে না। ডাহা মিথ্যে, ওই গরমে মনে হয় মাথা ঘুরে পরে যাবো, কেউ যেন গরম বালির মধ্যে মাথা সমেত শরীরটা ঢুকিয়ে রেখে দিয়েছে।

এবার ট্যাক্সি ধরলাম, শহরটাকে দেখতে দেখতে ফিরছি। সন্ধেবেলা গেলাম cannaught place, দিল্লির পার্কস্ট্রিট। বন্ধুরা মিলে খায়াদাওয়া, আড্ডা। রাতে অঘোরে ঘুম। এতো পরিশ্রম কলকাতাতে করিনা।


সম্প্রীতি চক্রবর্তী, পিএইচডি গবেষক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা।

এ সম্পর্কিত আরও খবর