'রাতারগুল' জলের ওপর বুনো সবুজের চাঁদোয়া

, ফিচার

মানসুরা চামেলী, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 19:58:10

কড়কড়ে রোদের তাপ কমে আসছে। আশ্বিনের প্রচণ্ড গরম তখন প্রশান্তির গীত ধরেছে। এমন শান্ত বিকেলে প্রায় আধা মাইল দূর থেকে নীল দিগন্তে মিতালি পাতানো সবুজ চাঁদোয়ার হাতছানি! সরু নালার মতো লেক, সেখানে সারি সারি ডিঙ্গি নৌকা ভিড়ানো। বুনোজালের ডাকে সাড়া দিতে যেন আমার জন্য প্রবেশ দ্বারে এ আয়োজন।

সরু নালার মতো লেক, সেখানে সারি সারি ডিঙ্গি নৌকা ভিড়ানো

ডিঙ্গি নৌকায় উঠে ডুব দিলাম ঘন অরণ্যের মায়া সিলেটের সুন্দরবন রাতারগুলে। গোয়াইনঘাট উপজেলায় জলের ওপর প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা এ বন মূলত জলাবন। সোয়াম্প ফরেস্ট। রাতারগুলোর মূল সৌন্দর্য বর্ষার সময়। তখন জলমগ্ন বন মায়াময় পরিবেশ সৃষ্টি করে। এখন বর্ষা শেষ, পানিও কমে গেছে।

ডিঙ্গি নৌকার মাঝি ইব্রাহিম। ইব্রাহিমের হাতে বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দই শুধু ওঠে না, একজন বিজ্ঞ গাইডও তিনি। বলা যায়, একজন পর্যটকের ভাগ্যগুণে এমন গাইড পাওয়া যায়। মনের খোরাক মেটানো তার আলাপচারিতায় দেড়ঘণ্টার রাতারগুল ছন্দময় হয়ে উঠে।

ডিঙ্গি নৌকার মাঝি ইব্রাহিম

জলাধারের দুই পারে মুর্তা গাছ ও বিন্না চাষ করা হয়েছে। রাতারগুলের ভেতর দিয়ে চলছে নৌকা যত গভীরে প্রবেশ ততই রোমাঞ্চ। আঁকাবাঁকা পথের মাঝখানে ও দুই পাশে মুগ্ধতা ছড়ানো সারি সারি সবুজ গাছ-ঝোপঝাড়। নৌকা চলতে চলতে মনে হচ্ছে এই বুঝি শাখা প্রশাখা ছড়ানো কোন গাছে ধাক্কা খেল।

রাতারগুলে হিজল-বনজাম-করচ–বরুণগাছসহ নানা জাতের গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ ছড়িয়ে রয়েছে। রাতারগুলে গাছগুলো একে অপরের সঙ্গে ভালোবাসা মাখামাখি করে বেড়ে উঠেছে। বুনোগাছগুলো যেন মন খুলে তাদের ডাল-পালা ছড়িয়ে দিয়ে একে অপরের খোঁজ নিচ্ছে।

 

জলাধারের দুই পারে মুর্তা গাছ ও বিন্না চাষ করা হয়েছে। 

বনের যত ভেতরে যাওয়া হয়, ততই বেশি নিরব, শান্ত পরিবেশ! খুব আস্তে চলা নৌকার বৈঠার মৃদু শব্দ ছাড়ার কৃত্রিম আর কোনো আওয়াজ নেই। মাঝে মাঝে ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। কোনো কোনো সময় কানে আসছে ঘুঘুর ডাকসহ পাখির গুঞ্জন। ঝিরিঝিরি বাতাসের ছোঁয়ায় পাতার পতপত আওয়াজ। তবে সবকিছু ছাপিয়ে বনের এ শব্দহীন চুপচাপ পরিবেশে গলা উঁচিয়ে কথা বলতে গেলে মনে হবে- যেন বুনো উদ্ভিদগুলো গলাগলি করে বলছে, ‘তুমি রবে নিরবে’! 

বহু কথার মাঝে মাঝি ইব্রাহিম জানালেন, এই জলাবনে দেশি মাছ পাওয়া যায় প্রচুর। গ্রামের লোকজন মাছ শিকার করে থাকেন।

তার প্রমাণ পাওয়া গেলে, দুরন্ত কয়েকজন কিশোরের ডুব দিয়ে মাছ শিকার দেখে।

 

 রাতারগুলের ভেতর দিয়ে চলছে নৌকা যত গভীরে প্রবেশ ততই রোমাঞ্চ

রাতারগুলে বর্ষায় স্বচ্ছ জল থাকলেও সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে শীতে পানি শুকিয়ে কিছুটা ঘোলাটে রূপ নেয়। বর্ষায় ৮ থেকে ১০ ফুট পানিতে ডুবে থাকা গাছগুলোকে এই সময়টাতে দেখে মনে হয়েছে নববধূ সকাল বেলা পুকুরে নেয়ে ফিরেছে।

রাতারগুলো একমাত্র নৌকা করেই যেতে হবে। নৌকায় করে গাছ-লতা-গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদের সবুজ চাঁদোয়ার নিচে ঘুরে বেড়ানো- এ অন্যরকম অনুভূতি! যা মনকে সন্ন্যাসী করে তুলে। বেশি ভালো লাগার আবেশে হৃদয় কোমল হয়ে উঠে। চাকচিক্য ছেড়ে সবুজের মায়া অন্তর ছটফট করে।

রাতারগুলে প্রবেশ ফি না থাকলেও নৌকায় ভ্রমণের এর জন্য গুণতে হবে ৫০০ থেকে হাজার টাকা।

জানা যায়, নৌকা ভ্রমণ নিয়ে এখানে অনেক সময় অনিয়ম হয়। পর্যটকদের কাছ থেকে বেশি অর্থ হাতিয়ে নেওয়া চেষ্টা করা হয়। 

বেশি ভালো লাগার আবেশে হৃদয় কোমল হয়ে উঠে

ইব্রাহিমের কাছে থেকে জানা যায়, ৩৩১ একরের রাতারগুলে ২৫ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। জলের এ বন সাপের আবাস। তবে মানুষের যাতায়াত বাড়ায় সাপের আনাগোনা কমেছে। এছাড়া মেছো বাঘ, বানর, জোঁক দেখতে পাওয়া যায়। পাখির মধ্যে আছে সাদা বক, কানা বক, মাছরাঙ্গা, টিয়া, বুলবুলি, পানকৌড়ি, ঢুপি, ঘুঘু, চিল এবং বাজপাখি। শীতকালে রাতারগুলে আসে বালিহাঁসসহ প্রচুর পরিযায়ী পাখি।

মানুষের যাতায়াত বাড়ায় সাপের আনাগোনা কমেছে।

যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সড়ক, রেল ও আকাশপথ- তিনভাবেই সিলেট যাওয়া যায়। সিলেট থেকে রাতারগুল ২৫-২৮ কিলোমিটার হবে। সিলেট শহর থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করে যেতে হবে। অটোরিকশা রির্জাভ করেও নেওয়া যাবে, শেয়ার করেও যাওয়া যাবে। থাকার জন্য সিলেট শহর ও রাতাগুলের আশেপাশে আবাসিক হোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর