ঘরের কোণে উপকারী কুনোব্যাঙ

, ফিচার

শাহ্ ইসকান্দার আলী স্বপন, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কিশোরগঞ্জ | 2023-09-01 23:17:59

ঘরের কোণে অপেক্ষাকৃত শুকনো জায়গায় শান্ত হয়ে জড়সড় বসে থাকে কুনোব্যাঙ।

গা ভর্তি আঁচিলের কারুকার্যে সাদা কালোর সংমিশ্রণে হালকা তামাটে শরীর। ডাগর চোখ ও পলায়নপর চেহারায় এ ব্যাঙ দেখে সহজেই বুঝা যায়, এর চেয়ে নিরীহ প্রাণী আর নেই।

বর্ষার ভরা মৌসুমে শহরে কুনোব্যাঙ দেখা না গেলেও গ্রামে প্রচুর সংখ্যায় এদের পাওয়া যাচ্ছে। কিশোরগঞ্জ সদর অষ্টবর্গ শাহ্ বাড়ির ঘরে ঘরে দেখা গেছে এমনই ছোট বড় অসংখ্য

কুনোব্যাঙ। আর এসব কুনোব্যাঙের সাথে দারুন সখ্যতা গড়ে উঠেছে বাড়ির বাসিন্দাদের।

তেমনই একজন অধ্যাপিকা লাইজু আক্তার। পেশাগত কারণে তিনি ঢাকায় অবস্থান করলেও গ্রামে শ্বশুরগৃহে আসেন বছরে দু' তিনবার। বাকী সময় বাড়িটি তালাবন্ধ থাকে। তখন জন্ম নেয় বিভিন্ন প্রকার কীট-পতঙ্গ ও বিষাক্ত পোকামাকড়। কিন্তু তালাবন্ধ বাড়িটির উপকারী কুনোব্যাঙগুলো তখন এসব কীট-পতঙ্গ ও বিষাক্ত পোকামাকড় খেয়ে ঘর নিরাপদ রাখে। দীর্ঘদিন পর তিনি যখন বাড়ি ফিরে ঘরদোর পরিষ্কার শুরু করেন তখন কুনোব্যাঙগুলোও তার সাহায্যকারী হয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে এসব পোকামাকড় ভক্ষণে অংশ নেয়। আর এ জন্যেই কোনও প্রকার খরচ বা পরিচর্যা ছাড়াই গৃহপালিত কুনোব্যাঙগুলো অধ্যাপক লাইজু আক্তারের কাছে উপকারী প্রিয় প্রাণী।

কুনোব্যাঙ Bufonidae গোত্রের অন্তর্গত Bufo গণের এক প্রজাতির অতি পরিচিত একটি ব্যাঙ। এর বৈজ্ঞানিক নাম Duttaphrynus melanostictus। আপাত দৃষ্টিতে কুনোব্যাঙকে ঘরের ভেতর গা ঘিন ঘিন করা অবাঞ্ছিত প্রাণী মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এটি প্রাকৃতিগত ভাবেই আমাদের ঘরে প্রতিপালিত উপকারী প্রাণী। ঘরের ভেতর ক্ষতিকর পোকামাকড়, মশা-মাছি, বিষাক্ত কীটপতঙ্গ খেয়ে এরা আমাদের নিরাপদ রাখে। বিপদ সংকেত দানে কুনোব্যাঙ এর জুড়ি নেই। ঘরে শ্বাপদ প্রাণী ঢুকলে এরা লাফালাফি শুরু করে দেয়। অনাবৃষ্টি হলে এক ধরনের কিট কিট শব্দ উচ্চারণ করে বৃষ্টির পূর্বাভাস দেয়। বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণায় অদ্যাবধি ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দানে সক্ষম না হলেও অনেকেই মনে করেন, কুনোব্যাঙ ভূমিকম্প বা ভূমিধ্বস সম্পর্কে আগাম বার্তা দিতে সক্ষম। কুনোব্যাঙ ভূমিকম্পের ৭ দিন পূর্বে ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে লাফালাফি শুরু করে দেয়। এবং অন্তত পাঁচ দিন আগেই নিজের ঘর ছেড়ে অন্যত্র নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়।

যুক্তরাজ্যের ওপেন ইউনিভার্সিটির প্রাণীবিদ ড. রাসেল গ্রান্টের প্রিয় বিষয় ব্যাঙের আচরণ৷ তিনি ইটালির এক লেকের পাড়ে যেখানে প্রায়শই ভূমিকম্প সংঘটিত হয়, সেখানে এক গবেষণার পর জানালেন ঝড় বা বৃষ্টিতে ব্যাঙ ঘর থেকে বের হয় না। তার গবেষণা শুরুর ২৯ দিনের মাথায় ঐ এলাকায় ৬ দশমিক ৩ মাত্রার ভূমিকম্প সংগঠিত হয়। আগে থেকেই এই গবেষক বেশ কিছু কুনোব্যাঙের গায়ে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন বিশেষ সংকেতযুক্ত যন্ত্র৷ ৬ এপ্রিল ভূমিকম্প সংগঠিত হওয়ার ৬/৭ দিন পূর্ব থেকে কুনোব্যাঙগুলো অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে৷ ৫ দিনের মাথায় এরা নিজেদের বাসস্থান ত্যাগ করে নিরাপদ জায়গায় যেতে শুরু করে। ৩ দিন আগে প্রাণীবিদ ড. রাসেল গ্রান্টের গবেষণাস্থল সান রুফফিনো লেকের সবগুলো কুনোব্যাঙ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য চলে যায় অন্য জায়গায়৷ কেবল যে সাধারণ কুনো ব্যাঙগুলোই ঘর ছাড়লো তা নয়, পোয়াতি ব্যাঙগুলোও ঘর ছাড়লো ৷ এ ঘটনার ৩ দিন পর সংগঠিত হলো ভয়াবহ ভূমিকম্প৷ ইটালির আবরুৎসো অঞ্চলে লাকিলা শহর সংলগ্ন এলাকায় ভয়াবহ এ ভূমিকম্পে মারা গেলো শতাধিক মানুষ৷

কুনোব্যাঙ শীতল রক্তবিশিষ্ট প্রাণী৷ বাইরের  তাপমাত্রার সঙ্গে এর দেহের তাপমাত্রা প্রকৃতিক ভাবেই পরিবর্তিত হয়। শীতকালে কুনোব্যাঙ ঘরের কোণে, আসবাবপত্রের নীচে জড়সড়ভাবে দীর্ঘসময় পড়ে থাকে। শীতকালটা কুনোব্যাঙ কোনও প্রকার খাদ্য গ্রহণ না করেই কাটিয়ে দেয়। এসময় এদের দেহের সঞ্চিত স্নেহপদার্থ প্রয়োজনীয় শক্তি জুগিয়ে এদের বাঁচিয়ে রাখে৷ কুনোব্যাঙের শীতকালীন নিষ্ক্রিয়তাকে শীতনিদ্রা বা হাইবারনেশন বলা হয়৷ কুনোব্যাঙ উভচর শ্রেণীর মেরুদণ্ডী প্রাণী হলেও এর পছন্দের জায়গা শুষ্ক ঘরের কোণ। আর এ জন্যেই এর নাম কুনোব্যাঙ।

বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অধিকাংশ দেশে কুনোব্যাঙ দেখা যায়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর