ঢাকা অভিমুখে ছুটছে অ্যাম্বুলেন্স

, ফিচার

আনিসুর বুলবুল | 2023-08-31 15:24:05

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বছিলা ব্রিজ চেকপোস্ট এলাকায় ডিউটি করছিলেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক তেজগাঁও বিভাগের পুলিশ সার্জেন্ট মুহাম্মদ সোহরাব হুসাইন। তিনি বললেন, আজ আবহাওয়া খারাপ থাকার পরও একটু পর পরই সাইরেন বাজিয়ে অ্যাম্বুলেন্সগুলো ঢাকা অভিমুখে ছুটছিল। সবগুলোর ভেতরেই রোগী-স্বজন। সবার মুখেই আতঙ্কের ছাপ।

শুধু রাজধানীর এই বছিলা ব্রিজ চেকপোস্ট নয়, ঢাকার প্রবেশদ্বার গাবতলী, ডেমরা, আব্দুল্লাহপুর ও সাইনবোর্ড এলাকার চেকপোস্টেরও একই অবস্থা। দেশের বিভিন্ন স্থানে থেকে সাইরেন বাজিয়ে রাজধানী অভিমুখে ছুটে আসছে অ্যাম্বুলেন্স। ছুটে আসছেন মুমূর্ষু রোগীরা। এসব রোগীদের বড় অংশ করোনা আক্রান্ত। তবে কিডনি, হার্ট ফেইলিওরসহ অন্যান্য রোগীও ছিলেন।

 

ঢাকায় কোভিড রোগী আসছে বেশি বাইরে থেকে। ছবি: বার্তা২৪

 

আজ শুক্রবার (৩০ জুলাই) সকাল ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত রাজধানীর সাইনবোর্ড চেকপোস্ট এলাকা পার হয়ে ঢাকায় প্রবেশ করেছে ৩০টি অ্যাম্বুলেন্স, বিকেল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত মোহাম্মদপুরের বছিলা চেকপোস্ট পার হয়ে ঢাকায় প্রবেশ করেছে ১২টি অ্যাম্বুলেন্স, দুপুর ২টা থেকে ৫টা পর্যন্ত গাবতলী চেকপোস্ট দিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করেছে প্রায় ২৫টি অ্যাম্বুলেন্স।

সঙ্কটাপন্ন বা গুরুতর রোগীরা জেলা বা বিভাগীয় শহরে চিকিৎসাসেবা না পেয়ে ছুটে আসছেন ঢাকায়। একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স এসে রাজধানীর কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোর সামনে করছে ভিড়। ঢাকার সরকারি কোনো হাসপাতালে আইসিইউ বেড খালি নেই। বাইরে থেকে ঢাকায় এসে রোগীরা ঘুরছেন সেই অ্যাম্বুলেন্সে অ্যাম্বুলেন্সে। হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে। হাসপাতালগুলো রোগীতে ঠাসা। আগের রোগী ছাড়া পেলেই কেবল নতুন রোগী ভর্তি সম্ভব। চিকিৎসকরাও রোগী সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন।

 

শহরে-গ্রামে এখন শুধু অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন। ছবি: বার্তা২৪

 

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, দেশের অর্ধেক জেলায় আইসিইউ নেই। উপজেলা হাসপাতালগুলোতে জনবল সংকটে চিকিৎসা সেবার বেহাল দশা বিরাজ করছে। বিভাগীয় হাসপাতালগুলোতে সক্ষমতার বাইরে চলে গেছে রোগী। অনেক হাসপাতালে অক্সিজেনের সংকট দেখা দিয়েছে। রোগীরা জেলা-উপজেলায় চিকিৎসা সেবা না পেয়ে ঢাকায় ছুটছে। সারাদেশ থেকে এভাবে ঢাকায় রোগী আসা অব্যাহত থাকলে সামনে মহাবিপদ অপেক্ষা করছে।

মোহাম্মদপুরের বছিলা ব্রিজ চেকপোস্ট এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ সার্জেন্ট সোহরাব হুসাইন বলেন, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে এখন অনেক বেশি অ্যাম্বুলেন্সের যাতায়াত চোখে পড়ছে। আজ শুক্রবার আবহাওয়া খারাপ থাকার পরও বসিলা চেকপোস্ট দিয়ে মাত্র দুই ঘণ্টায় ১২টি অ্যাম্বুলেন্স ঢাকায় প্রবেশ করতে দেখা গেছে। 

তিনি বলেন, কিছুক্ষণ আগেও (বিকাল ৫টা) আব্দুল জলিল (৬৮) নামের একজন কোভিড রোগীকে কুর্মিটোলা হাসপাতালের উদ্দেশে যেতে দেখেছি। তাকে নবাবগঞ্জ মুক্তি ক্লিনিক থেকে রেফার্ড করেছে। তার অবস্থা খুব একটা ভালো ছিলো না।

 

রোগী নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে এইসব অ্যাম্বুলেন্স আসে কাঙ্ক্ষিত হাসপাতালে। ছবি: বার্তা২৪

 

এদিকে বার্তা২৪-এর ফটোগ্রাফার মো. হাসান বলেন, মাত্র তিন ঘণ্টায় ৩০টি অ্যাম্বুলেন্স ঢাকায় প্রবেশ করতে দেখেছি। আর কয়েকটি ঢাকা ছেড়ে যেতে দেখেছি। সবগুলোর মধ্যেই রোগী ছিলেন। এদের মধ্যে আল-আমিন (৩৫) কুমিল্লা থেকে ঢাকা মেডিক্যালের উদ্দেশে এসেছেন, কাকলি (২৯) ফেনী থেকে মুগদা হাসপতালের উদ্দেশে আর বকুল (৪৫) সোনারগাঁ থেকে ঢাকা মেডিক্যালের উদ্দেশে এসেছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর মিরপুর, ভাষাণটেক, ধানমন্ডি, আসাদগেট ও শ্যামলীর সড়কে বের হলেই চোখে পড়ছে রোগী অথবা লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সের চলাচল। এসব এলাকায় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সামনেও অ্যাম্বুলেন্সের উপস্থিতি বেড়েছে। এসব এলাকার বাসা থেকেও অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দ শোনা যায়।

উত্তর ভাষাণটেকের বাগানবাড়ি এলাকার বাসিন্দা সেলিনা আফরোজ বলেন, রাস্তার পাশেই বাসা। আগে এতো অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দ কানে আসতো না। এখন এতো এতো শব্দ কানে আসে যে মাঝে মধ্যে আঁতকে উঠতে হয়। গভীর রাতে সাইরেনের শব্দকে মনে হয় অ্যাম্বুলেন্স কান্না করছে।

 

সাইরেন বাজিয়ে ছুটে মুমূর্ষু রোগীরা। ছবি: বার্তা২৪

 

বাংলাদেশ সোসাইটি অব এনেসথেসিওলজিস্টের সভাপতি অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বণিক গণমাধ্যমকে বলেছেন, করোনা রোগীদের আইসিইউ পর্যন্ত যাতে যেতে না হয় সেই উদ্যোগ নিতে হবে। উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা সঠিক সময়ে পেলে করোনা রোগীদের আইসিইউয়ের কোনো প্রয়োজন হয় না। বর্তমানে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যন্ত হাসপাতালগুলো পুরোপুরি সচল থাকলে করোনা রোগীদের উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। তবে জনবল সংকটে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের হাসপাতালে চিকিৎসা সেবার বেহাল দশা বিরাজ করছে। জনবল নিয়োগ নিয়ে এগুলো সচল করতে হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেছেন, মে মাসের মাঝামাঝি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞ কমিটি সীমান্ত জেলাগুলোতে লকডাউনের সুপারিশ করেছিল। কিন্তু সরকার তা আমলে নেয়নি। এরপর ধাপে ধাপে বিস্তার ঘটিয়ে সংক্রমণ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে ঈদের সময় বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়। এতে সংক্রমণের আরও বিস্তার ঘটে। এখন প্রতিদিন গড়ে ১৫ হাজারের ওপরে আক্রান্ত এবং দুইশর বেশি রোগী মৃত্যুবরণ করছেন। হাসপাতালে শয্যা মিলছে না। পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। সুতরাং জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে চিকিৎসাসুবিধা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিতে হবে।

 

জেলা বা বিভাগীয় শহরে চিকিৎসাসেবা না পেয়ে রোগী আসছে ঢাকায়। ছবি: বার্তা২৪

 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, সংক্রমণ যে হারে বাড়ছে তাতে হাসপাতালে রোগীর শয্যা পাওয়া দুস্কর হয়ে পড়বে। প্রতিদিন গড়ে ১৫ হাজার মানুষ আক্রান্ত হলে আগামী ১০ দিনে সংখ্যাটি দেড় লাখ হবে। তাদের মধ্যে ১০ শতাংশ মানুষের হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন পড়লেও শয্যা দেওয়া সম্ভব হবে না। তখন ভারতের মতো অবস্থার সৃষ্টি হবে। রোগী বাড়লে চিকিৎসা না পেয়েই হয়তো মৃত্যুবরণ করতে হবে। কারণ ইতোমধ্যে ৭৫ শতাংশের মতো শয্যা পূরণ হয়ে গেছে। রোগী বাড়তে থাকলে বাকি শয্যাও পূর্ণ হয়ে যাবে। এই মুহূর্তে প্রয়োজন জরুরি ভিত্তিতে স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ করা। সেটি না হলে বিপর্যয় ঘটতে পারে।

দেশে এখন পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২০ হাজার ২৫৫ জন মানুষ। এরমধ্যে পুরুষ ১৩ হাজার ৭৫০ জন এবং মহিলা ৬ হাজার ৫০৫ জন। যা অদ্যবধি শতকরা হিসেবে যথাক্রমে ৬৭.৮৮ শতাংশ ও ৩২.১২ শতাংশ। করোনা আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন ঢাকা বিভাগে ৯ হাজার ৩৪৯ জন। এরপর চট্টগ্রামে ৩ হাজার ৭৫৩ জন, খুলনায় ২ হাজার ৬৯০ জন, রাজশাহীতে ১ হাজার ৫৬১ জন, রংপুরে ১ হাজার জন, সিলেটে ৭৩৬ জন, বরিশালে ৬৩৫ জন এবং ময়মনসিংহে ৫৩১ জন।

এছাড়া দেশে এখন পর্যন্ত করোনা সংক্রমিত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ২৬ হাজার ২৫৩ জন। এরমধ্যে ঢাকা বিভাগের বাসিন্দাই ৭ লাখ ৪২ হাজার ৩৭৬ জন। এরপর চট্টগ্রামে ১ লাখ ৭৩ হাজার ১৩৪ জন, খুলনায় ৯১ হাজার ৪০০ জন, রাজশাহীতে ৮১ হাজার ৪৩৯ জন, রংপুরে ৪৩ হাজার ৯ জন, সিলেটে ৩৭ হাজার ৮২৮ জন, বরিশালে ৩২ হাজার ১২৫ জন এবং ময়মনসিংহে ২৪ হাজার ৯৪২ জন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর