হাকালুকি হাওরের বৃষ্টিদিন

, ফিচার

মোস্তফা মহসীন  | 2023-08-31 20:09:35

হাওরের হৃদয়কাড়া রূপে চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং বিমোহিত হয়েছিলেন। আমেরিকার সাবেক রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা হাওরকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘উড়াল পঙ্খির দেশ‘ বলে। প্রাচীন গ্রন্থসম্ভারের পসরা খুলে বসলে আপনার মনোজগতে পূর্ববঙ্গ হয়ে যাবে এক ‘উড়াল পঙ্খির দেশ’। উপরে নীল আকাশ আর নীচে অথৈ স্বচ্ছ জলরাশির সরোবর…জলের উপর বয়ে চলেছে ছো্ট, বড়, মাঝারি নানা সাইজ ও মাত্রার নৌকা। জলরাশির মধ্যে নিমজ্জিত না হয়েও জেগে ওঠা হিজল, করচ, কলমিতে জলকেলি করতে করতে আপনি হয়তো পেয়ে যাবেন নয়নকাড়া সবুজ জলজ বনের রাজ্য এক। কোনো এক ভরদুপুরে বিস্মিত হতে হতে আপনি হয়তো ভাববেন; এই বনের রাজাধিরাজ তাহলে কোথায়?

লেখকের ফ্যামিলি

এশিয়ায় সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ হাওর বোধহয় ‘হাকালুকি হাওর’। কেননা পূর্বে পাথারিয়া ও মাধব পাহাড় এবং পশ্চিমে ভাটেরা পাহাড় পরিবেষ্টিত হাকালুকি হাওর মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলার পাঁচটি উপজেলায় বিস্তৃত হয়ে তার রূপের নহর ছুটিয়েছে। বলা হয় কুলাউড়া অঞ্চলে এই হাওর মেলে ধরেছে তার রূপের ১৫ ভাগ শান-শওকত। আমরা এক্ষণে আছি যে অঞ্চলে, এখানে নাকি হাওরের সৃজনশীল রূপ সবচেয়ে বেশি প্রতিভাত। কুলাউড়া এটা শুধু জল, জোছনা, চা বাগানের ছায়াঘেরা শহরই নয় দেশের অন্যতম সীমান্ত শহরও; যার একবাহু জুড়ে ত্রিপুরা প্রদেশ। এখানে শহর ছাড়িয়ে অনতিদূরে গ্রামের লোকেরা লোকগানের পসরা নিয়ে বসেন। তাদের কণ্ঠে হাছন রাজা, রাধারমণ, শাহ আব্দুল করিম সম্প্রীতির বন্ধনে লীন হয়ে অমরত্বের ঠিকানা খুঁজে নেয়।

হাওরের অতিথি পাখি

কেমন যেন অন্যমনস্কতার ভেতর বয়ে যাচ্ছে নিঃশব্দ মর্মর এক। এই ভরা বর্ষায় পরিবার সমেত আমরা বেরিয়েছি….পাহাড় ও ঝরনার সাথে যাকে আমরা আমাদের অধিকতর নিকটতম প্রতিবেশী বলেই জানি; সেই ‘হাকালুকি হাওর’ দর্শনে। যাত্রাসঙ্গী আমার পুত্রও দেখছে চঞ্চল স্বচ্ছ জলের গোলক ধাঁধা, প্রশ্নোত্তর না পেয়ে তার শিশুমনে যখনই ধরা পড়ছে বাউলিয়ানা; মাঝি যেন তখনই ছোটালেন সিলেটী লোকগীতির এক হৃদয়-বিস্ফোরণ: 

হাওরের পদ্মফুল

কারে দেখাব মনের দুঃখ গো আমার বুক চিরিয়া

অন্তরে তুষেরই আগুন জ্বলে রইয়া রইয়া

কারে দেখাব মনের দুঃখ গো আমার বুক চিরিয়া

অন্তরে তুষেরই আগুন জ্বলে রইয়া রইয়া

আমার অন্তরে তুষেরই আগুন জ্বলে রইয়া রইয়া।

দুর্লভ রানিমাছ

হাওরের বালিহাঁস ঠোঁটের আগায় বয়ে বেড়াচ্ছে বিশ্বপ্রাণের স্পর্শরস। শরশর শিশুকঞ্চিপাতা যেন রোদের সাথে বাজিগর সাজে। মনের ভেতর প্লাবন আনতে ছুটছি ভাটিস্রোতে…। হরিৎসন্ধানী চোখে অরণ্যঘ্রাণের আদিম- মৃগয়া। সংস্কৃত শব্দ ‘সাগর’ থেকে ‘হাওর‘ শব্দের উৎপত্তি বলে গণমানুষের ধারণা। কালক্রমে হাওর শব্দের উৎপত্তি হয়েছে এভাবে সাগর-সাওর-হাওর। পুরো সিলেট বিভাগটাই চা বাগান, পাহাড়, মনোলোভা প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের সাথে হাওর অঞ্চল হিসাবেও জনপ্রিয়। সেই অর্থে আমরা সৌভাগ্যবান যে হাওরের ভূমিপুত্র আমরা। সুতরাং চিত্ত মেলে দিয়ে হাওরের রূপে মত্ত হয়ে লুটোপুটি খাবো না; এটা কি হয়! শুধুমাত্র হাকালুকি হাওরই নয়; বঙ্গভূমিতে টাঙুয়ার হাওর, শনির হাওর, টগার হাওর, মাটিয়ান হাওর, দেখার হাওর, হালির হাওর, সানুয়াডাকুয়া হাওর, শৈলচকরা হাওর, বড় হাওর, হৈমান হাওর, কড়চা হাওর, ধলা পাকনা হাওর, আঙ্গরখালি হাওর, নখলা হাওর, চন্দ্রসোনার থাল হাওর, ডিঙ্গাপুতা হাওর…. বাংলার রূপে ডানা মেলেছে আরও কত কত নাম।

শারমিন বলেছিলো কোনো একদিন; ধরো লোকালয়ের শব্দপুঞ্জে যদি কখনো তোমার বিরক্তি আসে, নৈশঃব্দ্যপ্রিয়তাকে আলিঙ্গন করতে এক ভরা বর্ষায় হাওরের শান্ত জলের সাথে প্রশান্ত বৃষ্টির জল একিভূত করে ধুয়ে নিও তোমার বিহ্বল মন! বর্ষাকে অন্তরে স্থায়ী রূপ দিতে তাই আজকের এই নৌ- বিহার।

ওয়াচ টাওয়ার

হাকালুকি হাওরের এই পূর্বদিক থেকে সূর্যাস্তও নাকি দারুণ উপভোগ্য। ডিঙ্গি নৌকার মাঝি ধীরে ধীরে জিরো পয়েন্টের দিকে যাচ্ছেন। জানালেন, এখনই শুরু হবে মাছ এবং নানা জাতের পাখির মেলা। মাছগুলোও লম্ফঝম্প করে ক্রীড়া প্রদর্শন করে হঠাৎ করে নৌকার পাশে বিপরীত দিকে হারিয়ে যাচ্ছে। অতিদূরে দেখা যায়, বিশাল বিশাল মহিষের পাল নিয়ে গ্রামের পথে রাখালেরা ছুটছেন। কোনো কোনো রাখাল মহিষের মুথে তুলে দিচ্ছেন ঘাস। দেশ এবং এশিয়ার বৃহত্তম এই হাওর, যাকে আমরা একই সাথে জানি দেশের অন্যতম বৃহৎ মিঠা পানির জলাভূমি বলেও। এখানে যে জায়গায় জলের গভীরতা একটু বেশি; সেখানে ডানপিঠে ছেলে মেয়েরা ডুবিয়ে ডুবিয়ে দিনান্তের লাফালাফিতে সেকি মত্ত! আরোও খানিকটা সীমিত জলে দেখা গেল ভেসে বেড়াচ্ছে হাঁসের পাল।

হাওরে নৌকায় ফ্যামিলি নিয়ে লেখক

শীত মৌসুমে পরিযায়ী পাখিদের আগমনে হাওর যেন পরিণত হয় স্বর্গোদ্যানে। আর এ সময় অতিথি পাখিদের সাথে মিতালি গড়তে ক্যামেরা ট্রাইপড নিয়ে মানুষের জনঘনত্বও বাড়ে হাওর পারে। তবে বর্ষা মওসুমেও দেখা পেলাম বেশ কিছু অতিথি পাখির।

ছোট-বড় ২৪০ টি বিল ও ছোট-বড় ১০ টি নদীর মেলবন্ধন। হাওরের নীলাকাশে সাদা মেঘের গল্পে ভেসে যায় বিষণ্ন বৃষ্টিরেখা। জলের ভেতর উঁকি দেয় আইড়, চিতল, বাউশ, পাবদা, মাগুর, শিং, কৈসহ আরও নানা প্রজাতির দেশীয় বিলুপ্তি পথের মাছগুলো। চারিধারে জেগে থাকা সবুজ ঘাসের গালিচায় মোড়া কিঞ্চিত উঁচুভূমি বিলের পানিতে প্রতিচ্ছবি ফেলে সৃষ্টি করে অপরূপ দৃশ্যকল্পের। বোরো ধানের ফাঁকা মাঠে সুখের পরশ।

পাখিকুলের সাথে বাউলগানের মুখরতায় তৃপ্তি নিতে নিতে গোধূলিবেলায় আকাশকে পরখ করি। ভাটি বাংলার রূপে আচ্ছন্ন শারমিনের ঘোর কাটতে কিছুটা দেরি হয়। রোদ ঝলমল আকাশের চেয়ে মেঘে ধৌত আকাশটাই কেন জানি তার বেশি পছন্দ!

ভাবছি, ডিনার হিসাবে পূর্বেই প্রস্তুতকৃত ডিমভুনা, খিচুড়ির কথা। এরজন্যই কি সে বাসায় ফিরতে তেমন তাড়না অনুভব করছে না? নদী বাওয়া বাতাস, ঠান্ডা ভিজে মাটি নৌকার মাঝি সবরু খাঁকেও এতক্ষণে রোমাঞ্চিত করে তুলেছে। তিনি বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে কোমরে থাকা ডার্বি সিগারেটের প্যাকেট খুললেন।

রোঁয়া ওঠা নরম ফুল নৌকা থেকে কচি হাতে কুঁড়িয়ে বেশ বিনোদিত আমার পুত্র। আমার শৈশবকে মনে করিয়ে দেয়! মনের মাঝে বেঘোরে ঘুমিয়ে থাকা সেই শিশুটিও যেন কঁকিয়ে ওঠে,হাত-পা নাড়ে। কিছু একটা হারিয়ে ফেলে খুঁজে পাওয়ার উল্লাসে লিখে ফেললাম- আস্ত একটি কবিতা! নাম- ‘হাওরের দাগ‘।

কৈশোরের আকুল আগুন

ছুঁয়েছিল জলমন্ত্র...

যে হাওরে স্রোত বেশি

সে হাওর জুড়ে নাকি; প্রেতিনী-ডাকিনী?

হাসে অন্তরাত্মা

হাওরের কলস্তরে কথকতা...

একেক ঋতুতে একেক যাপন

জ্যোতির্ময় লীলাময়, প্রভু পরম

বলি; হাকালুকি হাওর কি তোমার-আমার

ইচ্ছাজলে সুগঠিত

শীতল-আশ্রম?

ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিদের মুক্তির বাহাস

মানুষের ঠোঁটে ক্রুশবিদ্ধ

অতিথি পাখির মতোই লাফাচ্ছে

হাওরেররানিমাছ’; নয়নাভিরাম!

ভাবতে গেলেই অ্যাবসার্ড

হাওরের ফসলি ভূমিতে না তাকিয়ে

দিগন্তরেখায় খুঁজি

দুষ্কর্মের দাগ।।

এ সম্পর্কিত আরও খবর