কোন দিকে যাচ্ছে ঈদ পরবর্তী রাজনীতি

, যুক্তিতর্ক

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার (অব.) | 2023-08-28 18:40:17

ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ হয়ে গেলো সবেমাত্র। আত্মশুদ্ধি ও আত্মত্যাগের মহান ব্রত গ্রহণ এবং অনাচার, রিপুর তাড়না, শয়তানের কুমন্ত্রণা ইত্যাদি থেকে দূরে থাকার যে মহৎ শিক্ষা কোরবানির ঈদের মাধ্যমে আমরা পাই তার কোনো প্রভাব আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতিতে আগামী দিনে আদৌ দেখতে পাবো কিনা সেটা এক বিরাট প্রশ্ন। যদি পেতাম তাহলে এতদিনে আমরা ধন্য হয়ে যেতাম।

ধর্ম এক মহান বিষয়। এর মধ্যে রাজনীতি ঢুকে সবকিছু জগাখিচুড়ি হয়ে গেছে। কোনটা ধর্ম আর কোনটা রাজনীতি তা নির্ণয় করা আমার মতো অধমদের জন্য এক মহা কঠিন পরীক্ষা।

ঈদের চাইতে কোরবানির ঈদ একটু অন্যরকম। কোরবানির জন্য উপযুক্ত পশু ক্রয়, কসাই ঠিক করা, জবাই করা, মাংস তৈরি, বন্টন, সংরক্ষণ ও ভক্ষণের সুস্বাদু ব্যবস্থাকরণে অনেক মেধা ও শ্রম ব্যয় করতে হয়। কোন জাতের গরুর মাংস সুস্বাদু হবে, দেখতে অপূর্ব লাগবে, তেল মশলা কোন ব্রান্ডের হলে স্বাদ বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে-ইত্যাদি নিয়ে ঈদের কয়েক দিন আগে থেকেই ঘরে–বাইরে সর্বত্রই সরব আলোচনা চলতে থাকে। এসব নিয়ে ঘরের কর্তা-গিন্নির মধ্যে অম্ন-মধুর তর্কযুদ্ধও বেধে যায় কখনো কখনো। কর্তাব্যক্তি কিছু টাকা-পয়সা বাঁচাবার কলা-কৌশল প্রয়োগ করতে চাইলে গিন্নি হয়তে সেটা বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠবেন, খবরদার আমার সঙ্গে রাজনীতি করবা না।

বাংলাদেশে রাজনীতি এখন ঘরের মধ্যেও ঢুকে গেছে। সবখানেই রাজনীতি। ঈদের সময় সামাজিকতা রক্ষায় যেখানেই গিয়েছি সেখানেই কথা-বার্তার কেন্দ্রে ছিল রাজনীতির বিষয়-আশয়। ঈদের ছুটির পর রাজনীতি কোন দিকে যাচ্ছে, কেমন হতে যাচ্ছে আগামী জাতীয় নির্বাচন, রাজনীতির প্রধান দুই পক্ষের মন্তব্য-বিবৃতির মাধ্যমে কী বেঝা যায় ইত্যাদি ঘিরেই ছিল ঈদের সময়ের আলোচনা।

বাংলাদেশের রাজনীতি কলুষিত হতে হতে এমন একটা পর্যায়ে এসে গেছে, সেখানে নীতি-নৈতিকতা, সত্যবাদিতা, আদর্শ, দর্শন- সবকিছুই মনে হয় ভাঙ্গা খিড়কির ফাঁকা দিয়ে উধাও হয়ে গেছে। তাই বাংলাদেশের মানুষের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ; বড় অংশ বলবো না, রাজনীতির কথা উঠলেই হাতাশা ব্যক্ত করেন। ঢালাওভাবে সবাইকে একই দাঁড়িপাল্লায় ওজন করতে চান। ঘি আর ঘোলের মূল্য সমান বলে চালিয়ে যান। আমি ব্যক্তিগতভাবে ওই পক্ষের নই।

আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের জন্মের যে উজ্জ্বল ইতিহাস আছে, যে মহান ত্যাগের দৃষ্টান্ত রয়েছে, তার একটা সহজাত শক্তি আছে। এই শক্তিই বাংলাদেশকে এবং বাংলাদেশের রাজনীতিকে একদিন অবশ্যই সঠিক জায়গায় নিয়ে যাবে। এর অনেক নমুনাও এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয়া নতুন রাজনৈতিক পক্ষ একাত্তরের পরাজিত শক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করে এবং তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের  দর্শন, আদর্শ, চিন্তা-চেতনা বলতে যাকিছু বোঝায় তার সবকিছু রাষ্ট্রের সকল অঙ্গন থেকে মুছে ফেলার  চেষ্টা করে যাচ্ছে, যা এখনো অব্যাহত আছে। সুতরাং, আগামী জাতীয় নির্বাচনের লড়াই দুইটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পক্ষের মধ্যে হচ্ছে না। সেটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও বিপক্ষের দুইটি শক্তির মধ্যে। তাই আগামী জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে রাষ্ট্র কি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের ওপর বহাল থাকবে নাকি ২০০১-২০০৬ মেয়াদের মতো পশ্চাদপদতা, ধর্মান্ধতা ও জঙ্গিতন্ত্রের জায়গায় ফিরে যাবে।

গত ৯-১০ বছরে রাষ্ট্র পরিচালনা এবং সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহের হাত ধরে রাজনীতির চালকের আসনে এখন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। তাই চালকের আসনে বসে আওয়ামী লীগ কতটা দক্ষতা ও নৈপুন্যের সঙ্গে গাড়ি চালাতে পারবে তার ওপর রাজনীতির অনেক কিছুই নির্ভর করছে। তারা যদি মনে করেন, সামনের রাস্তা সরল ও মসৃণ তাহলে মারাত্মক ভুল করবেন। অতি আত্মবিশ্বাস বড় দুর্ঘটনার কারণ হয়।

মাস খানেক আগে আমেরিকা থেকে ফিরছিলাম। পথে নিউইয়র্ক বিমান বন্দরে অপেক্ষারত অবস্থায় একজন বাঙালি ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় ও কথা হয়। তিনি বহু বছর নিউইয়র্কে বসবাস করছেন ও সেখানে অত্যন্ত সুপ্রতিষ্ঠিত। ভদ্রলোক কথা কথায় বললেন, গত দুই মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার সার্বিকভাবে বাংলাদেশের উন্নয়নে যে অবদান রেখেছে তাতে আগামী দুই-তিন মেয়াদ অনায়াসে তাদের ক্ষমতায় চলে আসা উচিত। কিন্তু দু-চারটা বড় ঘটনা, কিছু মন্ত্রীর বেফাস ও আত্মঘাতি মন্তব্য, একই সঙ্গে মধ্য ও তৃণমূল পর্যায়ের নেতা ও পাতি-নেতাদের বিরূপ আচরণ এবং ছাত্রলীগ, যুবলীগ নামধারীদের কিছু অপকর্ম সব অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে। এই সুযোগে প্রতিপক্ষ লাগামহীন মিথ্যা প্রচারণা, গুজব সৃস্টি এবং প্রপাগান্ডা চালিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার কাজটি অত্যন্ত সফলভাবে করে যাচ্ছে, যার সঠিক জবাব বা পাল্টা প্রপাগান্ডা সরকারি দলের পক্ষ থেকে নেই। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে সবকিছু মানেজ করার মধ্যে ঝুঁকি আছে।

একনাগাড়ে দশ বছর ক্ষমতায় থেকে সঠিক, সত্য তথ্যটি তুলে ধরার মতো সক্ষমতা সরকারি দল তৈরি করতে পারেনি। যারা সরকারের বদান্যতায় মিডিয়ার মালিক হয়েছেন এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন তারাও বিরোধী পক্ষের মিথ্যাচারের গড্ডালিকায় গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। নিজেরা কষ্ট করে সত্য-মিথ্যার তালাশ করছেন না। সত্য আর মিথ্যাকে একই পাল্লায় তুলে নিরপেক্ষতার ভান করছেন। এজন্যই বোধ হয় দলের নেত্রী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, গণভবনে শ্লোগান না দিয়ে গ্রামে-গঞ্জে মানুষের কাছে চলে যান এবং উন্নয়নের কথা মানুষের কাছে তুলে ধরেন।

আওয়ামী লীগের চ্যালেঞ্জ প্রধানত দুটি। প্রথমত, দলীয় কোন্দল মিটানো এবং মানুষের কাছে উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরা। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করা।

অন্যদিকে দেশের দ্বিতীয় প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি আজ বহুমুখী সংকটে জর্জরিত। একটা রাষ্ট্রের জন্মের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করে, সীমাহীন ত্যাগ ও সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধকে ধূলোয় মিশিয়ে দিয়ে রাজনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী আসন লাভ করা যায় না। এর জ্বলন্ত উদাহরণ আজকের বিএনপি। তাদের প্রধান নেত্রী দুর্নীতির মামলায় আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত হয়ে জেলে আছেন। আইনি পথে তাঁর মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ একথা বিএনপির আইনজীবীরাই বলেছেন।

তাদের দ্বিতীয় নেতা বহুবিধ দুষ্কর্মের বোঝা মাথায় নিয়ে বিদেশে পলাতক। আদালতের খাতায় দণ্ডপ্রাপ্ত ফেরারি আসামি। অন্যান্য বড় নেতারা দলীয় পদ টিকিয়ে রাখার জন্য মাঝে মধ্যে টেলিভিশনে বিপ্লবী বক্তব্য দিলেও ক্ষমতায় থাকাকালীন অর্জিত অবৈধ সম্পদ রক্ষায় রাতের অন্ধকারে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-মন্ত্রীদের দ্বারে গিয়ে দয়া-দাক্ষিণ্য ভিক্ষা করছেন। সুতরাং, বিএনপি যতই বলুক, শক্তশালী আন্দোলন করা তাদের পক্ষে আর সম্ভব হবে না। সাধারণ মানুষও তাদের ডাকে সাড়া দিবে না।

দলীয় ক্যাডার, বিশেষ করে জামায়াতি ক্যাডার বাহিনীর ওপর নির্ভর করে ২০১৪ ও ২০১৫ সালের মতো ধ্বংসযজ্ঞের পথ বেছে নিলে তা বিএনপির জন্য আরো বিপদ ডেকে আনবে। তাই যৌক্তিক বিশ্লেষণ বলে, নির্বাচনে যাওয়া ছাড়া বিএনপির জন্য অন্য কোনো বিকল্প নেই।

রাজনীতির মাঠে ঢাল-তলোয়ারহীন বলে অত্যন্ত সুপরিচিত কয়েকজন ব্যক্তি নির্বাচনকে সামনে রেখে অনেক তোড়জোড় শুরু করেছেন। তারা ‘তৃতীয় পক্ষ’ নামে একটি জোট গঠনের চেষ্টায় আছেন। কিন্তু তাদের রাজনৈতিক ক্রেডেন্সিয়ালের ওপর মানুষের বিশ্বাস নেই।

এই গ্রুপের প্রখ্যাত আইনজ্ঞ দেশ-জাতির সংকটে সব সময় পলায়নপর নীতি গ্রহণ করেছেন। একাত্তরে এবং পঁচাত্তর পরবর্তীতে তার ভূমিকা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। পঁচাত্তর পরবর্তীতে তিনি রাষ্ট্রের সকল অঙ্গন থকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা মুছে ফেলার কাজে প্রথম সামরিক স্বৈরশাসকের ডান হাত হিসেবে কাজ করেছেন।

গ্রুপের বাকিরা কেউ গৃহপালিত বিরোধী দল, আবার কেউবা রাজনীতির সাত ঘাটে পানি খাওয়া ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। তারা গণতন্ত্রের কথা অতি উঁচু গলায় বললেও গণতান্ত্রিক রাজনীতির সব মূল্যবোধের বিপরীত মিশন নিয়ে মাঠে নামা ২০০৭-২০০৮ মেয়াদের জরুরি আইনের সরকারকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছেন। ডাবল স্টান্ডার্ড বা দ্বিচারিতা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। ব্যক্তিগত পরিচিতির কারণে টেলিভিশনের পর্দায় ও পত্রিকার খবরে তারা জায়গা পান বলে গরম গরম কথা বলে উত্তাপ ছড়াতে পারবেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করতে পারবেন না। তারা দুই প্রধান পক্ষের বাইরে গিয়ে যতবারই নির্বাচন করেছেন ততবারই জামানত হারিয়েছেন। জনগণের সাথে তাদের কোনো সংযোগ নেই। তাই তাদের সম্পর্কে প্রখ্যাত একজন সাংবাদিক ও কলামিস্ট বলেছেন, শূন্য প্লাস শূন্য ইকুয়েল টু শূন্য।

তবে, জাতীয় নির্বাচন যেহেতু অতি নিকটে তাই রাজনীতির মাঠ সঙ্গত কারণেই আগামীতে উত্তপ্ত থাকবে। সেই উত্তাপ মানুষের জন্য স্বস্তিদায়ক হবে নাকি আবারও জ্বালাও-পোড়াও রূপ নেবে সেটাই হলো আসল কথা।

লেখক: কলামিস্ট এবং ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর