আমরা এমন কেন?

, যুক্তিতর্ক

ইকরাম কবীর | 2023-08-31 10:41:30

 

অতি-ধনীদের প্রতিধ্বনি শুনি

আমাদের পাড়ায় অনেক অতি-ধনী বসবাস করেন। তাঁড়িগুলো দেখলেই বোঝা যায়। ঈদের দিন সকালে যখন মসজিদের দিকে হেঁটে যাচ্ছি, দেখি তাদের বাড়িগুলোর সামনে রাস্তার ওপরেই কোরবানির পশুগুলো দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। বুঝে গেলাম কি ঘটতে যাচ্ছে। উনারা রাস্তার ওপরই কোরবানি দেবেন। মন খারাপ হলো।

মসজিদে গিয়ে শুনি খুৎবার পর ইমাম সাহেব সবাইকে খুব স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেন যে শহর কর্তৃপক্ষ রাস্তায় কোরবানি করতে মানা করেছে। কোরবানি নিজের বাড়ির ভেতরেই করতে হবে। তিনি এ পাড়ার সোসাইটির অনুরোধের কথাও সবাইকে জানিয়ে দিলেন। মনে হলো যেহেতু ইমাম সাহেব বলছেন, সবাই শুনবেন। শুনলেন। আমাদের পাড়ার ধনী ও মধ্যবিত্তরা শুনলেন, তবে অতি-ধনীরা শুনলেন না। মসজিদ থেকে বাড়ি ফেরার পথে দেখি ঠিকই তাঁরা রাস্তার ওপর কোরবানি শুরু করে দিয়েছেন। মাঝে মাঝে এমন হয় যে আমাদের বাড়ি থেকে কেউ গাড়ি নিয়ে রাস্তা দিয়ে যেতে পারেন না।

শহর কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মানবো না কিন্তু সেই শহরের বুকেই দাপিয়ে বেড়াবো, এমনটি দেখলে কার না মন খারাপ হয়। বিশ্বে নানা দেশে অতি-ধনীরা সমাজে নানা পরিবর্তন এনেছেন, রাস্তা-ঘাট-রেলপথ তৈরী করেছেন। তাঁরা নিজেরা বড়-বড় বাহনে চড়েন। এবং তাঁদের এই বাহন যেন ভালমত চলতে পারে, সে কারণেই সুন্দর রাস্তা বানিয়েছেন, সেই রাস্তায় সবাই যেন আইন মেনে চলেন তা নিশ্চিৎ করেছেন। তা না হলে বড় গাড়ি চড়ে লাভ কি?

আমাদের দেশে ব্যপারটি সম্পূর্ণ উল্টো। অর্থের আঁচে তারা আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চলেন। তাদের ছেলে-মেয়েদের দিকে তাকালে দেখবেন তারা ইতিবাচক অর্থে সামাজিক উদাহরণ হতে পারেন নি। তাদের দৌড় ঐ কয়েকটি সোনা দিয়ে মোড়া রোলেক্স ঘড়ি, সবচেয়ে দামি জাগুয়ার গাড়িতে ঘুরে বেড়ানো আর তিনবেলা পাঁচতারা হোটেলে খাওয়া-দাওয়া করা।

আমি একথাগুলো কোন হিংসা থেকে বলছি না। আমার মনে হয় আমাদের ধনীদের এমন কিছুর সঙ্গে নিজেদের জড়িত করা উচিত যেন দেশের সাধারণ মানুষ তাদের অনুসরণ করতে চান। সেখানেই তো হবে তাদের স্বার্থকতা।

কোন জনের প্রতিনিধি?

জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই শুনে আসছি আমাদের দেশে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়, খাদ্যে ভেজাল দেয়া হয়, জন প্রতিনিধিরা চাল-গম আত্মসাৎ করেন, পাচার করেন ও কালবাজারে বিক্রি করেন। তখন থেকেই খবরের কাগজে এসবের প্রতিবেদন দেখেছি। সাংবাদিকরা সব সময়ই বিষয়গুলো নিয়ে লিখেছেন। তারা এখনও লিখে চলেছেন।

গেল সপ্তাহে একদিন দৈনিক ইত্তেফাকের প্রধান শিরোনাম ছিল “গরিবের চাল লুটপাট!” খবরটিতে বলা হয়েছে, বিভিন্ন স্থানে চাল আত্মসাত করে কালোবাজারে বিক্রি, পাচারের চেষ্টা, ওজনে কম দেয়া, ভুয়া কার্ড তৈরি, স্লিপ বিক্রি ও প্রকৃ্ত গরিবদের না দিয়ে অন্যদের মধ্যে বিতরণের অভিযোগ উঠেছে জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে। যেসব ঘটনার কথা খবরে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোতে বিভিন্ন স্থানের পৌর মেয়ররা জড়িত। দু’একজন পুলিশের হাতে আটকও হয়েছেন।

এখন কথা হচ্ছে, আমাদের দেশের যে ধারা তাতে এই পৌর মেয়রদের অনেকেই এক সময়  দেশের আইন প্রণেতা হবেন। তখন বেঁচে থাকলে আমাদের প্রজন্মের সবাই বুড়ো হয়ে যাবো। এক জীবন চলে যাবে, তবুও গরিবের সম্পদ আত্মসাত করার প্রচলন ফুরিয়ে যাবে না। আত্মসাতের সঠিক অর্থ হচ্ছে ‘চুরি’। এই চুরির দায়ে অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ যদি আমাদের জন প্রতিনিধি হন তাহলে আমাদের নিজদের কাছে কেমন লাগবে। এরা তাহলে কোন জনের প্রতিনিধি?  নাকি তারা শুধু নিজেদেরই প্রতিনিধি?

আমরা এমন কেন?

ঈদের সময় ঢাকা শহরের সব রাস্তা-ই প্রায় ফাঁকা থাকে। তখন ট্র্যাফিক জ্যাম থাকে না। কোথাও যেতে তেমন সময় লাগে না। তেমন তাড়া থাকার কথা নয়। তবুও দেখি চালকেরা ট্র্যাফিক বাতিগুলোর রঙের সাথে চলছেন না। ভাবটা এমন, রাস্তাতো খালি, আমার লাল বাতিতে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে কেন?

এসব দেখলে আমার একটি ঘটনা মনে পড়ে। দিল্লী গিয়েছিলাম। কুটনৈতিক পাড়ায় আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। একদিন রাত দশটায় মনে পড়লো রাতের খাওয়া হয়নি। আমাদের হোটেলেরও ডাইনিং তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে যায়। বাইরে কোথাও গিয়ে খাওয়া সেরে নিতে হবে। দু’একজনের কাছে জানতে চাইলেই আমায় দেখিয়ে দিলেন কোথায় গেলে খাবার পাওয়া যাবে। বেশ কিছুটা হাঁটতে হবে। হাঁটছি। কিছুদূর গিয়ে পৌঁছুলাম এক তিন-রাস্তার মোড়ে। দেখি একাকি একজন মোটরসাইকেল আরোহী তার বাহন নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন লাল বাতির সামনে। রাস্তায় আর কেউ নেই। তিনি ইচ্ছে করলেই চলে যেতে পারেন। কিন্তু বাতি সবুজ না হওয়া পর্যন্ত তিনি গেলেন না। সেদিন আমি বুঝে গিয়েছিলাম ভারতীয়দের এগিয়ে যাওয়ার কারণ। আমরাই বা এমন কেন?! আইনকে আইন মনে করি না কেন?!

লেখক: গল্পকার ও কলামিস্ট

এ সম্পর্কিত আরও খবর