আত্মপ্রচারের রাজনৈতিক ঈদ!

, যুক্তিতর্ক

তুষার আবদুল্লাহ | 2023-08-28 12:12:42

গলি থেকে মহাসড়ক। মুঠোফোন-ফেইসবুকে ঈদের শুভেচ্ছা এখন আর হজম করতে পারছি না। পাকস্থলি পেরিয়ে গলা উপচে পড়ছে। শুভেচ্ছা হজমেরওতো অক্ষমতা-সক্ষমতা আছে। গেল ঈদ উল ফিতরের শুভেচ্ছাই জাবর কেটে যাচ্ছিলাম। এর মধ্যে আবার এসে গেল কোরবানির ঈদ। সেই পরিচিত পোষ্টার, ফেস্টুন, ব্যানার এবং ফেইসবুক গ্রাফিক্স। শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী, উত্তরসূরী এবং স্থানীয় পীর নেতার ছবির সঙ্গে নিজের একটা বড় ছবি সেঁটে দিয়ে ঈদ মোবারক জানানো। কোন কোনটিতে নিজে সরাসরি না জানিয়ে খাদেমদের সৌজন্যে ঈদ শুভেচ্ছা জানানোর চলও আছে।

এই শুভেচ্ছা জানানোর দলে মহল্লার উঠতি নেতা যেমন আছেন, তেমনি আছেন রাজনীতির পরিচিত মুখও। আছেন বিদেশ-বিভুঁই ও ব্যবসা- বাণিজ্যের আড়ালে থাকা মানুষজনও। বিভিন্ন পেশার পরিচিত-অপরিচিতরাও হঠাৎ ঈদের শুভেচ্ছা অকাতরে বিলি-বণ্টন শুরু করে দেন ঈদকে সামনে রেখেই। এদের সবাই চান এলাকাবাসী, সরাসরি বললে ভোটাররা তাদের নামটি জানুক। তাদের মুখায়বের সঙ্গে পরিচিত হোক।

ভবিষ্যতে ওয়ার্ড কাউন্সিলর থেকে শুরু করে সংসদ সদস্য পদে প্রার্থী হবার খায়েশ তাদের আছে। প্রার্থীতা না জুটুক, লোকের কাছে নামটা ছড়ালোতো। এতেই পরিতৃপ্তি।

আর যারা মাঠেই আছেন দীর্ঘকাল। কয়েকদফা জনপ্রতিনিধি হয়ে বসে আছেন, তারাও এই শুভেচ্ছা বিতরণ প্রকল্পে রেখেছেন এই চিন্তায় যে ভোটাররা জানুক নতুন মুখ যতোই উকিঁঝুঁকি দেক-তারা বাজার ছাড়েননি।

জাতীয় নির্বাচনের যখন ক্ষণ গণনা চলছে, ঠিক সেই সময়ে ঈদ উল আযহা উদযাপিত হচ্ছে। ভোটমুখি দলগুলোর নেতা–কর্মী বিশেষ করে সম্ভাব্য প্রার্থীরা এখন নির্বাচনী এলাকায়। শীর্ষ দুই রাজনৈতিক দলসহ সকল সংগঠনই তাদের নেতা-কর্মীদের নিজ নিজ এলাকায় চলে যেতে বলেছেন।

সম্ভাব্য প্রার্থীরা স্ব স্ব এলাকায় নিজেদের অবস্থান ও শক্তির প্রমাণ রাখতে এখন নির্বাচনী এলাকায়। পুরনোদের পাশাপাশি আছেন সম্ভাব্য নতুন মুখও। এবার ঈদগায়ে সাধারণ মুসল্লীদের বাড়তি বিড়ম্বনা পোহাতে হলো। আলিঙ্গনের পর আলিঙ্গন। চুম্বক আলিঙ্গন। প্রার্থী ভোটারকে বক্ষদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে যেন রাজিই নন। যতোক্ষণ লেপ্টে রাখা যায়, ততোক্ষণই যেন ভোটের নিশ্চয়তা। মুসল্লিরাও ভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যান, কে যে সম্ভাব্য আর কে যে কার খাদেম?

আবার পুরনোর রক্তচক্ষু আছে, নতুন কাউকে দীর্ঘ সময় বুকে জড়িয়ে রাখলে, তার হিসেবের খাতায় নাম উঠে যেতে পারে। যদি তিনি আবার ক্ষমতায় ফিরে আসেন তবে প্রতিশোধের হিসেব কড়া-গণ্ডায় বুঝে নিতে ভুলবেন না।

শুধু ঈদগাহে আলিঙ্গন করে স্বস্তি পাচ্ছেন না ভোটের কাঙ্গালরা। তারা বাড়ি বাড়ি ছুটছেন। উকিঁ দিচ্ছেন আড্ডায়-পারিবারিক ও বন্ধু সম্মিলনে। আর দৃশ্যমান দান খয়রাতেও ঘাম ঝরাতে হচ্ছে।

কোরবানি ছিল তাদের উদারতা ও ত্যাগ প্রদর্শনের বড় মঞ্চ। কে কতো বড় ও সংখ্যায় কয়টি পশু কোরবানি দিতে পারলো তা দিয়েও নিজেদের সামর্থ ও শক্তির এক প্রকার প্রদর্শন হলো। মাংস সাধারণ গরিব-দুখি ভোটারের কাছে পৌঁছালো কিনা, সেটা অবশ্য শেষ মেষ হয়তো দেখভাল করা সম্ভব হচ্ছে না, সরকারি অন্যান্য বরাদ্দ দেয়ার মতোই। দলের কর্মীরাই হয়তো ঠিক ঠাক মতো বুঝে নিয়েছে সব।

গোস্ত বিতরণ, বুকের আলিঙ্গনের পাশাপাশি পোস্টার-ফেইসবুকের শুভেচ্ছা বিতরণটাও সেকেল হয়ে যাচ্ছে। এই দৃশ্যমান ভোটার প্রেম ব্যালট বাক্সে কোনো প্রাপ্তি যোগ করে বলে মনে হয় না। নগদ প্রাপ্তি লোকের আলোচনায় ও চোখে থাকা। আমাদের ভোট সংস্কৃতিতে ভোটাররাও সেকেলে রয়ে গেছেন। নবীন ভোটার যোগ হলেও তারা উত্তরসূরিদের সংস্কৃতি ধরে রেখেছেন পরম্পরায়। ভোটের আগের মূহুর্তের নগদ প্রাপ্তি যোগ, পূর্বের কোনো স্বার্থপূরণ এবং নির্দিষ্ট প্রতীকের প্রতি আনুগত্যই ব্যালট বাক্সের অঙ্কের ফলাফল এনে দেয়।

ভোটের আগের প্রতিবাদ, সমালোচনা, ক্ষোভের আগুনে জল গড়িয়ে পড়ে ব্যালটবাক্সে। অতএব ভোটার ভুলানো এই কায়দাগুলো আত্মপ্রচার ছাড়া কিছুই নয়। এখানে এক বিন্দু ভোটার প্রেম নেই। থাকবেই বা কেন? ভোটাররা যেহেতু বেহায়ার মতো সেই দল ও প্রতীক কানাই থেকে রয়ে গেছে!

লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি

এ সম্পর্কিত আরও খবর