কিংবদন্তীদের চোখেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন কিংবদন্তী

, যুক্তিতর্ক

ফখরুল হাসান | 2023-09-01 10:56:19

বিশ্বের বাঘা বাঘা কিংবদন্তী নেতারা জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে বিশ্বনেতার মর্যাদা দিয়েছেন। কারণ তিনি একটি দল বা দেশের নেতা নন। বঙ্গবন্ধু একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। সমগ্র বাঙালি জাতি এবং বিশ্বের নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত মানুষের অবিসংবাদিত নেতা। শেখ মুজিবুর রহমানের প্রশস্ত বুকে ছিল অসীম সাহস এবং পাহাড়ের মতো দৃঢ় প্রত্যয়। শোষণ-বঞ্চনায় দ্বি-খণ্ডিত মানুষের ব্যথায় তাঁর আহত হৃদয় নৈঃশব্দ্যে কেবলই কেঁদে উঠত। জনগণকে সর্বদা আপন ভেবেছেন। অন্যায় ও অপশাসনের বিরুদ্ধে তাঁর কণ্ঠস্বরও এমন ছিল যে মৃত্যুভয়ও তাঁকে কুণ্ঠিত করতে পারেনি। জেল-জুলুম নিপীড়নের মাধ্যমে শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিবকে দমাতে পারেনি। ১৯৭১ সালে অসংখ্য বাঙালির মতোই বেশ কিছু বিদেশি নেতা ও কবি-সাহিত্যিক ছিলেন যারা বিশ্বাস করতেন, শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বেই এই দেশ স্বাধীন হবে। এলেন্স গিন্সবার্গ তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘অনডিউটি ইন বাংলাদেশ’ গ্রন্থে মূল্যায়ন করে এভাবে লিখেছেন : “এমন একজন মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে যে অনগ্রসর বাঙালি জাতিকে মুক্তির আস্বাদ দিবে। তাঁর নাম শেখ মুজিবুর রহমান।”

বঙ্গবন্ধুর ভাষণে একজন শক্তিমান কবির চিন্তাশক্তি, চিত্রকল্প, উপমা, শব্দচয়ন পরিলক্ষিত হয় বলেই তাঁকে রাজনীতির কবি হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। নিউজ উইকে বঙ্গবন্ধুকে আখ্যা দেওয়া হয়, “পয়েট অফ পলিটিক্স।”

বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেশিষ্ট্যপূর্ণ স্থান অধিকার করেছেন। বঙ্গবন্ধু তার অভিভাষণের মাধ্যমে বাংলা ভাষার প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে, বাঙালি জাতি এবং বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য বিরল সম্মান অর্জন করেছেন। মুহাম্মদ ফরিদ হাসান ‘বঙ্গবন্ধু এক ঐশ্বরিক আগুন’ প্রবন্ধে লিখেছেন : “তাঁর সততা, সংগ্রাম, আত্মত্যাগ এবং নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার প্রতিও জনগণ আন্তরিকভাবেই বিশ্বাস করতেন। মূলত মুজিব-চরিত্রে আবেগ, বাগ্মিতা, সাহসিকতা ও ত্যাগের অপূর্ব সম্মিলন ঘটেছে, যার ফলে তিনি পরিণত হয়েছেন মহানায়কে।

কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন ‘৭ মার্চের ভাষণ ও বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক প্রবন্ধের একাংশে লিখেছেন, “বঙ্গবন্ধু উপমহাদেশের একমাত্র রাজনৈতিক নেতা যিনি স্বাধীনতার সঙ্গে একই সমান্তরালে মুক্তির সংগ্রামের কথা উচ্চারণ করেছিলেন।”

ফ্রান্সের বিখ্যাত সাহিত্যিক আঁদ্রে মালরো বলেন, “স্টালিন নয়, হিটলার নয়, মাওসেতুং নয় মাহাত্মা গান্ধী ও শেখ মুজিবুর রহমানকে যদি জগৎ এখনো না বুঝে থাকে, না বুঝে থাকে এঁদের মতের মর্মবাণী, তবে সময় এসেছে এ বিষয়ে দৃষ্টি উন্মোচনের।”

প্রাবন্ধিক আবুল মোমেন একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, “সাতই মার্চের ভাষণের মাধ্যমে একটি জাতির জয় হয়েছে, সেই জাতি একজন অবিসাংবাদিত নেতা পেয়েছে।” এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন তার গেটিসবার্গ ভাষণে গণতন্ত্রকে ‘গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল’ বলে সংজ্ঞায়িত করেছন।

ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট (১৯৭২ সালে এক সাক্ষাৎকারে) বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আপনার শক্তি কোথায়? তিনি অপকটে সে প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘ আমি আমার জনগণকে ভালোবাসি।” সাংবাদিক আবারও জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার দুর্বল দিকটা কী?” বঙ্গবন্ধু সে প্রশ্নের জবাবেও বলেছিলেন, “আমি আমার জনগণকে খুব বেশি ভালোবাসি।” বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন।

বঙ্গবন্ধুকে মূল্যায়ন করে, ইয়াসির আরাফাত বলেছেন, “আপোষহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুম কোমল হৃদয় ছিল মুজিব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।”

সদ্য স্বাধীনতা অর্জিত বাংলাদেশের কণ্ঠমণি-বিশ্ববীর বঙ্গবন্ধু নিষ্পেষিত, সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য জাতিসংঘে ১৯৪৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ৫০টি ইস্যুর কথাসহ বাংলায় সটান বুকে ভাষণ দিয়েছিলেন বিশ্বের রথী-মহারথী নেতাদের সামনে যা আজও শোষিত, অধিকার বঞ্চিত ও বিশ্ব বিবেককে নাড়া দেয়। ১৯৭১ সাল এবং তৎপরবর্তী শেখ মুজিব বিশ্বনেতাদের চোখে হয়ে ওঠেন বিস্ময়। ঘোর লাগা এক ব্যক্তিত্ব।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, হেনরি কিসিঞ্জারের মূল্যায়নটি, “আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মতো তেজী এবং গতিশীল নেতা আগামী ত্রিশ বছরের মধ্যে এশিয়া মহাদেশে আর পাওয়া যাবে না।”

তৎকালীন বিশ্বমিডিয়াও তাকে যথার্থভাবে মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয়েছিল।

“শেখ মুজিবকে চতুর্দশ লুই ইয়ের সাথে তুলনা করা যায়। জনগণ তার কাছে এত প্রিয় ছিল যে লুই ইয়ের মতো তিনি এ দাবি করতেই পারেন আমিই রাষ্ট্র।”—পশ্চিম জার্মানী পত্রিকা।

প্রভাবশালী ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানের মতে, “শেখ মুজিব ছিলেন এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব।”

ফিনান্সিয়াল টাইমস বলেছে, “মুজিব না থাকলে বাংলাদেশ কখনোই জন্ম নিত না।”

“মুজিব হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না, যারা মুজিবকে হত্যা করেছে তারা যে কোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।” — নোবেল বিজয়ী উইলিবান্ট।
“শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে।” — ফিদেল কাস্ট্রো।

“শেখ মুজিব নিহত হবার খবরে আমি মর্মাহত। তিনি একজন মহান নেতা ছিলেন। তার অনন্যসাধারণ সাহসিকতা এশিয়া ও আফ্রিকার জনগণের জন্য প্রেরণাদায়ক ছিল।” — ইন্দিরা গান্ধী।

“বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রথম শহীদ। তাই তিনি অমর।” — সাদ্দাম হোসেন।

“শেখ মুজিবুর রহমান ভিয়েতনামী জনগণকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।” — কেনেথা কাউণ্ডা।

“বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে বাঙলাদেশই শুধু এতিম হয়নি বিশ্ববাসী হারিয়েছে একজন মহান সন্তানকে।” — জেমসলামন্ড, ইংলিশ এম পি।

“তোমরা আমার প্রিয়বন্ধু মুজিবকে হত্যা করলে! আমারই দেওয়া ট্যাংক ব্যাবহার করে! আমি নিজেকেই অভিশাপ দিচ্ছি, কেন আমি তোমাদের ট্যাংক দিয়েছিলাম?”
— আনোয়ার সাদাত (মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্ট)।

“শেখ মুজিব নিহত হলেন তার নিজেরই সেনাবাহিনীর হাতে অথচ তাকে হত্যা করতে পাকিস্তানীরা সংকোচবোধ করেছে।” — বিবিসি-১৫ আগস্ট ১৯৭৫।

ভারতীয় বেতার ‘আকাশ বাণী’ ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট তাদের সংবাদ পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে বলে, “যিশু মারা গেছেন। এখন লক্ষ লক্ষ লোক ক্রস ধারণ করে তাকে স্মরণ করছে। মূলত একদিন মুজিবই হবেন যিশুর মতো।”

একই দিনে লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বলা হয়েছে, “বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।”

গত কয়েক দশকে দক্ষিণ এশিয়ায় অনেক নেতার আবির্ভাব হয়েছিল। তাদের সবার থেকে শেখ মুজিব সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা হিসাবে স্বীকৃত। লেনিন, ফিদেল কাস্ট্রোর মতো বঙ্গবন্ধুও সফল নেতা ছিলেন। ফিদেল ক্যাস্ট্রো বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেছিলেন : “আমি হিমালয় দেখিনি, তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তি ও সাহসে এ মানুষটি হিমালয়ের সমতুল্য।” মানবতাবাদী মনীষী লড ফেনার ব্রকওয়ে আরো একধাপ এগিয়ে দেখেছেন এভাবে : “জর্জ ওয়াশিংটন, মহাত্মা গান্ধী, ডি ভ্যালেরারও চেয়েও শেখ মুজিব এক অর্থে বড় নেতা। শেখ মুজিবের সাহসিকতা ও ব্যক্তিত্ব কেবল দক্ষিণ এশিয়া নয় সারাবিশ্বে বিরল।”

একারণেই তিনি বিশ্বনেতা। সমগ্র বাঙালি জাতির নেতা। তিনি শুধু বঙ্গের বন্ধু নন, সারাবিশ্বেরও বন্ধু।

এ সম্পর্কিত আরও খবর