পথের দাবি

, যুক্তিতর্ক

ইকরাম কবীর | 2023-08-29 00:35:41

আদর-স্নেহে বেশি কাজ হয়
প্রথমে দেখেই মনে হয়েছিল, ঘটনা এখানেই থেমে যাবে না। কিছু স্বার্থান্বেষী মহল এখান থেকে ফায়দা লুটতে চেষ্টা করবে। তাই-ই হয়েছে। হরেক রকম পন্থায় তারা চেষ্টা করেছে। যা কোনো সরকার-বিরোধী আন্দোলন ছিল না, তা সরকার-বিরোধী বিক্ষোভে পরিণত করার চেষ্টা করেছে অত্যন্ত ন্যাক্কারজনকভাবে করেছে। এই স্বার্থান্বেষী মহলের একটি সুন্দর আন্দোলন ছিনতাই করার চেষ্টা দেখে আমার মনে হয়েছে, আমাদের ছোট-ছোট ছেলে-মেয়েরা যা চাইছিল ওই মহল তা চাইছিল না। তারা এই শিশুদের ঘাড়ে চেপে অত্যন্ত অদক্ষভাবে সরকারের পতন ঘটাতে চাইছিল।

সরকার অবশ্য তার মতো করে সব সামলে নিয়েছে। সামলাতে না পারলে দেশের আরো অনেক ক্ষয়ক্ষতি হতো বলে আমি মনে করি। শিশুদের চেয়ে যারা একটু বড়, তাদের রাগ ও বিশৃংখলা থামাতে গিয়ে যে বল প্রয়োগ করা হয়েছে তা নিয়ে আরেক দিন কথা বলবো। তবে আজ শিশুরা যখন নিরাপদ সড়কের আন্দোলন করছিল তখন আমাদের মন্ত্রী মহোদয়, যারা তাদের অফিসে বসে শিশুদের উদ্দেশ্যে বলছিলেন- তা নিয়ে কিছু বলত চাই।

শিশুদের দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে এবং তাদের বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে, এ কথা বলে মন্ত্রীরা যারা ভেবেছিলেন শিশুরা সবাই ফিরে যাবে, তারা হয়তো ভুল ভেবেছিলেন। আমাদের কাছে মনে হয়েছে, মন্ত্রীরা যদি ওই শিশুদের মাঝে গিয়ে তাদের বুকে জড়িয়ে ধরে, তাদের সঙ্গে সেলফি তুলে সেই ছবি যদি ফেইসবুকে পোস্ট করতেন; তাহলে তাদের নিয়ে অবলীলায় বাড়ি ফিরে যেতে পারতেন। তারা তা করেননি। হয়তো এ বিষয়টি তাদের মনেও আসেনি। মনে আসলেও হয়তো এখন তারা বলবেন নিরাপত্তার কথা ভেবে তারা সেখানে যাননি।

যদি তারা রাস্তায় শিশুদের পাশে যেতেন, তারা নিশ্চয়ই নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই যেতেন। মনে পড়ে ঢাকার প্রয়াত মেয়র আনিসুল হককে। তিনি বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই শিশুদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে তাদের দাবি মেনে নিয়ে, আদর করে বাড়ি পৌঁছে দিতেন। কিন্তু আমরা শিশুদের উদ্দেশ্যে কথা বলতে গিয়ে এমন ভাষায় বলেছি যেন ঠিক বড়দের সঙ্গে কথা বলছি। সেটি ঠিক হয়নি। শিশু তো শিশুই। তাদের সঙ্গে সব সময় আদরের ভাষায় কথা বলতে হয়, যা হয়তো আমার দেশের সংস্কৃতি নয়। তবে শিখতে ক’দিন? আমরা শিখে ফেলি না কেন?

যা হোক। এ ঘটনা থেকে আমরা অবশ্যই শিক্ষা নিয়েছি। দুঃখের ঘটনায় হাসবো না, শিশুদের সঙ্গে বড়দের মতো আচরণ করবো না, ঘটনার আকস্মিকতায় উদভ্রান্ত হবো না।

মনটা ভালোই হচ্ছে না
একেবারেই হচ্ছে না। আশার আলো দেখবো ভেবেছিলাম। সবার ভেতরে পরিবর্তন দেখবো ভেবেছিলাম। তা একেবারেই হয়নি। বৃহস্পতিবার (৯ আগস্ট) সকালে একটি বিশ্বাসযোগ্য বাংলা অনলাইন পত্রিকার খবরের কিছু অংশ তুলে ধরতে চাই-
‘বেলা ১২টা, স্থান বিজয়নগর নাইটিংগেল মোড়। শহরজুড়ে চলছে ট্রাফিক সপ্তাহ। রাস্তার মোড়ে মোড়ে তার ব্যানার ফেস্টুন। মাইক লাগিয়ে ট্রাফিক আইন সম্পর্কে সচেতন করা হচ্ছে নগরবাসীকে। তার মধ্যেই চলছে ট্রাফিক আইন ভঙ্গের হিড়িক। যে যেখান দিয়ে পারছেন ঢুঁকিয়ে দিচ্ছে গাড়ি। কে বলবে এই শহরে মাত্র এক সপ্তাহ আগে নিরাপদ সড়কের দাবিতে হয়ে গেছে বিশাল আন্দোলন।’

এখানেই শেষ নয়, গেল বুধবার সন্ধ্যায় আরেকটি বিশ্বাসযোগ্য বাংলা অনলাইন পত্রিকা খবর দিয়েছে যে জাবাল-ই-নুর কোম্পানির লক্কর-ঝক্কর গাড়িগুলো ঠিক রাস্তায় নেমে গেছে। নির্বিঘ্নে তাদের গাড়ি চলছে। আরেকটি পত্রিকা বৃহস্পতিবার বলেছে যে সড়কে নৈরাজ্য আগের মতোই চলছে।

পরিবর্তন কবে আসবে জানি না। শিশুদের #WeWantJustice আবেদনের মূল্য আমরা কবে দিতে পারবো জানি না। এটুকু জানি যে পরিবর্তন এক দিনে আসবে না; সময় লাগবে। তবে পরিবর্তনের জন্য যে ‘ইচ্ছা’ সবাইকে দেখাতে হবে তা কেন যেন দেখতে পাচ্ছি না। তবে বুধবার চট্টগ্রাম থেকে খবর পেয়েছিলাম যে সেখানকার গাড়ি ও রিক্সা-চালকেরা শিশুদের শেখানো পন্থায় তাদের বাহনগুলো চালানোর চেষ্টা করছেন। চট্টগ্রামের কথা ভেবে যদি একটু মন ভালো হয়।

ছোটরাই বেশি পারে
আরেকটি খবরে মন খারাপ হলো। মঙ্গলবার শিক্ষকদের একটি কাজের বিরোধিতা করে ভিকারুননিসা নূন কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্রীরা পরীক্ষার খাতায় লিখে এসেছে#we_want_justice। ভিকারুননিসা কলেজের একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির বেশ ক’জন শিক্ষার্থীকে শিক্ষকরা নিয়ে গিয়েছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ‘সড়ক দুর্ঘটনা- আমাদের করণীয়’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে। মেয়েদের অনেকেই যেতে চায়নি কিন্তু কলেজের চাপে গিয়েছিল। প্রায় ৪২১টি স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা নগর ভবনের এই অনুষ্ঠানে গিয়েছিল।

তাদের কয়েকজন জানিয়েছে যে নগর ভবনের সেই অনুষ্ঠানে তাদের শিক্ষকরা ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের সব শাখার শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে নিরাপদ সড়কের দাবি ‘প্রত্যাহারের’ ঘোষণা দেন। কিন্তু শিক্ষার্থীদের মত তারা নেননি। আবার, সেখান থেকে ফিরে আসার সময় ন’জন শিক্ষার্থীকে গভর্নিং বডির সদস্যের কাছে রেখে বাকিদের নিয়ে ফিরে আসেন তারা। ব্যাপারটি জানতে পেরে দশম শ্রেণির প্রায় সাড়ে তিনশ’ ছাত্রী ওই স্লোগান লিখে পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে আসে এবং কলেজ প্রাঙ্গণে সম্মিলিত কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে স্কুল থেকে বের হয়।

এ ঘটনা আমায় ১৯৮৪ সালের একটি কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।
ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের মিলনায়তনে বসে আমরা ৫২ জন ক্যাডেট বসে পরীক্ষা দিচ্ছি। রসায়ন-প্রথম পত্র। আমাদের পরীক্ষায় এক্সটার্নাল পরীক্ষক হিসেবে এসেছেন রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের একজন শিক্ষক। পরীক্ষা চলাকালীন দেখি তিনি আমাদের এক বন্ধুকে ধরে নকল করার অভিযোগ এনে কুড়ি মিনিট একপাশে বসিয়ে রাখলেন। সে যে নকল করেনি তাকে বোঝাতে পারলো না। পরীক্ষক বিশ্বাসই করলেন না। বন্ধু ঝাড়া কুড়ি মিনিট কিছু লিখতে পারলো না। আমরা চটে গেলাম। দুপুরে খাওয়ার সময় সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম যে এর প্রতিবাদ করতে হবে। প্রতিবাদ। আমাদের বন্ধু নকল করেনি। নকলের কোনো সুযোগ সেখানে ছিল না। পরীক্ষার হলে ঢোকার আগেই সবাইকে আপাদমস্তক দেখে ঢোকানো হয়েছিল।

সবাই মিলে ঠিক করলাম দুপুরে খাওয়ার পর, পরের পরীক্ষায় (রসায়ন– দ্বিতীয় পত্র) সবাই যেন সবার বড় আকারের সেট-স্কোয়্যার একটি নির্দিষ্ট সময়ে চোখের সামনে উঁচিয়ে ধরে নকল করার অভিনয় করে। এক ঘন্টা পর পরীক্ষা শুরু হলো। তারও এক ঘন্টা পর আমাদের একজন মুখ দিয়ে একটি শব্দ করার সঙ্গে-সঙ্গেই আমরা সবাই সেট-স্কোয়্যার উঁচিয়ে ধরলাম যেন পরীক্ষক দেখে মনে করেন আমরা নকল করছি। তিনি দেখে উদ্ভ্রান্ত হয়ে গেলেন। কোন দিকে ছুটে যাবেন বুঝে উঠতে পারলেন না। যার কাছেই যান, দেখেন সেট-স্কোয়্যারে কিছু লেখা নেই; কোনো নকল নেই। তিনি এতোটাই বোকা বনেছিলেন যে পরের পরীক্ষাগুলোতে তিনি তার জন্য রাখা চেয়ার ছেড়ে আর নড়েননি। আমরাও তাকে আর ঘাঁটাইনি। শান্তিতে বাকী পরীক্ষাগুলো শেষ হয়েছিল।

আমার ছোটবেলার গল্পটি কেন বললাম জানতে চান? কারণ আমরা– বাংলাদেশের বাঙ্গালীরা (আমি নিজেও)– জানি না কেমন করে ছোটদের সাথে আচরণ করতে হয়। সব সময়ই ভাবি ছোটদের মস্তিস্ক ছোট এবং তাদের বুদ্ধিতে তেমন কোনো কাজ হবে না। মেনে নিচ্ছি, ছোটদের অভিজ্ঞতা কম, তবে মস্তিস্ক কাজ করে না তা মানতে পারছি না। তাদের মস্তিস্ক বড়দের চেয়ে বেশি পরিস্কার। ভিকারুননিসা কলেজের ছাত্রীরা যেমন করে প্রতিবাদ করেছে, তা যদি আমার মতো বায়ান্ন বছরের এক মানুষ করতে চাইতো, তাহলে কি হতো? ঠিক জানি এই বায়ান্ন বছর বয়সে কিছুই মস্তিস্কে আসতো না। মনে-মনে ভাবতাম, ‘লাগিয়ে দিই দু’ঘা।’ কিন্তু মেয়েরা তা করেনি। তারা কোনো ঘা না দিয়েই বুঝিয়ে দিয়েছে যে যা হয়েছে তা তারা মানে না। সেই চুরাশি সালে আমরা যেমন প্রতিবাদ পরীক্ষকের বিরুদ্ধে করেছিলাম- তেমন। আমরা হয়তো এখন পারবো না; তবে তখন পেরেছিলাম।

তাই বলি, ছোটদের কথা শোনার প্রয়োজন আছে। তাদের বুদ্ধি ধার করার অনেক প্রয়োজন আছে। তাদের বুদ্ধি এবং আমাদের অভিজ্ঞতা– এই দুই এর মিলনেই-তো আসবে আমাদের সার্বিক সার্থকতা। তাই নয় কি?

লেখক: গল্পকার ও কলামিস্ট

এ সম্পর্কিত আরও খবর