আর ‘চাপ’ দিয়েন না মামা 

, যুক্তিতর্ক

এরশাদুল আলম প্রিন্স, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | 2023-08-26 04:46:26

নিরাপদ সড়কের দাবি আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়। অন্তত তিন দশক ধরে এটি মানুষের একটি সাধারণ দাবিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু তারপরও আমরা ‘নিরাপদ সড়ক’ পাইনি। সম্প্রতি রাজীব-পায়েল-করিম-দিয়ার মর্মান্তিক মৃত্যুতে বিষয়টি আবার সামনে চলে এসেছে।

তথ্য বলছে, সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ও ভয়াবহতা কোনোটিই কমছে না। ২০১৬ সালে নিহত হয়েছে ৬০৫৫ জন, অর্থাৎ দিনে কমপক্ষে ১৬জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। গত বছর (২০১৭ সালে) নিহত হয়েছে ৭৩৯৭ জন। অর্থাৎ প্রতিদিন নিহত হয়েছে কমপক্ষে ২০ জন। মৃত্যুর এই মিছিল কবে থামবে তাও জানা নেই।

সড়ক দুর্ঘটনা পুরোপুরি রোধ করা যায় না এ কথা সত্য। কিন্তু যে সব কারণে আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে সে কারণগুলো চিহ্নিত করে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশেই রোধ করা যায়। এখানে চালকের লাইসেন্স না থাকা একটি কারণ, কিন্তু মূল কারণ বা প্রধান কারণ কখনওই নয়। প্রতিটি দুর্ঘটনার কারণ আলাদা। কিন্তু সামগ্রিকভাবে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ বা সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য সামগ্রিক সড়ক ব্যবস্থাপনা বা পরিবহন ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে হবে। কথায় বলে, একটি দেশ কতটা উন্নত বা সভ্য তা বোঝা যায় রাস্তায় বের হলে। আমাদের সড়ক অবকাঠামো উন্নত হয়েছে কিন্তু সড়ক ব্যবস্থাপনায় উন্নত হতে পেরেছি কি?

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের হিসেব মতে, ঢাকা শহরে সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষ মারা যায় তার অধিকাংশই পথচারী। নিয়ম হচ্ছে, গাড়ি চলবে সড়ক দিয়ে, পথচারী পথ চলবে ফুটপাথ দিয়ে, রাস্তা পার হবে জেব্রা ক্রসিং বা ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, এতো পথচারী নিহত হলো কীভাবে? হয় চলন্ত গাড়ি ফুটপাথে এসে পড়েছে না হয় পথচারী রাস্তা পার হতে গিয়ে চলন্ত গাড়ির সামনে গিয়ে পড়েছে। আর না হয়, চলন্ত গাড়িতে উঠতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। এর প্রতিটি কারণই সড়ক অব্যবস্থাপনা বা আমাদের ঢাকার যোগাযোগ অব্যবস্থাপনার একেকটি নমুনা।

ঢাকায় অসংখ্য বাস স্টপ আছে। কিন্তু এসব বাস স্টপে বাস দাঁড়ানোর কোনো নির্দিষ্ট জায়গা নেই। যেমন, পুরো ফার্মগেট, গুলিস্তান, শাহবাগ, যাত্রাবাড়ি, শাহজাদপুর, নর্দাসহ  সব বাস স্টপের পুরো এলাকাতেই বাস থামে। পুরো এলাকাই বাস স্টপ হওয়ায় বাসগুলোও পুরো এলাকাজুড়েই থামে। ফলে, কোনো বাস পরে এসেও আগে গিয়ে থামায়। এর আরেকটি কারণ হলো, বেশি যাত্রী তোলা। একই রুটের বাসগুলোর মধ্যে বেশি যাত্রী তোলার এই প্রতিযোগিতা চলতে থাকে পুরো রাস্তা জুড়েই। এ কারণে, চালকরা একজন আরেকজনকে তাদের ভাষায় ‘চাপ’ দেয়। কিন্তু কেন এই চাপাচাপি তারও কারণ আছে। মালিকরা চালকদের সঙ্গে চুক্তি করে, দিন শেষে হয়তো ১০ হাজার টাকা দিতে হবে।

এদিকে রাস্তায় প্রচণ্ড জ্যাম। দুই-তিন ট্রিপ দিলেই দিন শেষ। ১০ হাজার টাকা মালিককে দিয়ে চালকের নিজের, হেলপার ও কন্ট্রাক্টরের টাকাও তুলতে হবে। তাই বেশি যাত্রী তোলার জন্যই এ চাপাচাপি ও রাস্তায় হুড়োহুড়ি। যাত্রীদের কাছে বেশি ভাড়া আদায় করার প্রতিযোগিতাও দেখা যায় এই কারণেই। প্রতিটি বাসের প্রতিটি ট্রিপেই কোনো না কোনো যাত্রীর সঙ্গে ভাড়া নিয়ে কথা কাটাকাটি হবেই। এই কথা কাটাকাটি থেকে হাতাহাতি ও নিহত হওয়ার (কয়েক বছর আগে মুন্সিগঞ্জে যাত্রীকে রাস্তায় ফেলে পিটিয়ে হত্যা করে বাসের শ্র্রমিক) ঘটনাও ঘটেছে এখানে। কিন্তু তারপরও অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি।    

ঘুরে ফিরে সেই আইনের কথাই আসে। আসলে আইনের শাসন না থাকলে সেখানে নিয়ম-শৃঙ্খলা বিরাজ করে না। কিন্তু কোনো অঘটন ঘটলে বলা হয় দেশে এ বিষয়ে যথাযথ আইন নেই। আসলে আইনের দোহাই শুধুই অজুহাত। আসল কথা হচ্ছে, আইনের প্রয়োগ। আইন দিয়ে সড়ক নিরাপত্তা, সড়ক শৃঙ্খলা তথা সড়ক ব্যবস্থাপনা বা পরিবহন ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন সম্ভব নয়। একটি গাড়ি নির্দিষ্ট জায়গায় থামবে, আগে যাত্রী নামবে, পড়ে যাত্রীরা সাড়িবদ্ধভাবে উঠবে, যাত্রী ওঠা শেষ হলে সিটে বসলে বাস ছাড়বে ইত্যাদি, ইত্যাদি-এসব কি আইন দিয়ে শেখানো যায়? কিন্তু এসব খুটিনাটি বিষয়ই হচ্ছে পরিবহন ব্যবস্থাপনার মূল দিক।

অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমাদের ব্যবধানের জায়গাটি এখানেই। দুর্ঘটনার কারণও এই অব্যবস্থাপনা। আমরা গাড়ি চালাতে শিখেছি, কিন্তু পথ চলতে শিখিনি। রাস্তা-ঘাটে চলার অনেক সাধারণ নিয়ম কানুনই চালক, যাত্রী ও পথচারী কেউ জানি না, মানিও না। 

ঢাকায় যেসব পাবলিক ট্রান্সপোর্ট চলাচল করে, একটি দেশের রাজধানীতে কীভাবে সে সব গাড়ি চলাচল করে তা এক বিষ্ময়ই বটে। অধিকাংশ গাড়িরই ফিটনেস পাওয়ার কথা না। এসব গাড়ির লুকিং গ্লাস, মিরর, বিভিন্ন লাইটের কোনো হদিস নেই। কিন্তু কর্তৃপক্ষের চোখের সামনে দিয়েই তো এসব গাড়ি চলাচল করছে। জাবালে নুরের মালিক, চালক ও  হেলপারকে গ্রেফতার করা হয়েছে ভালো কথা। কিন্তু যাদের অনুমোদন, ছত্রছায়ায়, পৃষ্ঠপোষকতায় জাবালে নুরের মতো শত শত গাড়ি চলাচল করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা কোথায়? তাদের কি কোনো ব্যর্থতা নেই? বিআরটিএ’র এক কেরানিরও তো কিছু হলো না। কাজেই, গোড়া কেটে আগায় জল ঢাললে সমস্যার সমাধান হবে না। পুরো সিস্টেমে হাত দিতে হবে।

দেশের পুরো ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থার কাছে সরকারও জিম্মি। এই জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হতে না পারলে কোনোদিনই সড়ক ব্যবস্থাপনার মানোন্নয়ন হবে না। সিন্ডিকেট ভাঙতেই হবে। সরকার এখানে রেগুলেটর। কিন্তু সড়ক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছে এই সিন্ডিকেট। ক্ষমতা বদলের সঙ্গে সঙ্গে এই সিন্ডিকেটেরও পরিবর্তন হয়।

এই সিন্ডিকেটের কবল থেকে মুক্ত হতে হলে পুরো পরিবহন ব্যবস্থা সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে হবে। কারণ, বিদ্যমান ব্যবস্থায় সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা প্রায় অসম্ভব। রাজনীতি থেকে পরিবহন সেক্টরকে আলাদা করতে হবে। এ কাজটি সময় সাপেক্ষ, কিন্তু এখনই শুরু করতে হবে। পৃথিবীর সব দেশে সম্ভব হলে এখানেও সম্ভব। প্রয়োজন নীতি ও কৌশল প্রণয়ন। না হলে মালিক-শ্রমিকরা জনগণকে ‘চাপ’ দিচ্ছে, সরকারকেও ‘চাপ’ দিচ্ছে। মামাদের এই চাপাচাপি বন্ধ করতেই হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর