খাইতে মজা আছে, পুরাই লোল!

, যুক্তিতর্ক

এরশাদুল আলম প্রিন্স | 2023-08-23 23:45:12

একবিংশ শতাব্দীতে ‘টেকসই উন্নয়ন’, ‘পরিবেশ’ ও ‘কস্ট-এফিসিয়েন্সি’র মতো ধারণাগুলোকে আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। সংবাদ, সংবাদপত্র বা সংবাদমাধ্যমকে যদি আমরা প্রডাক্ট বা পণ্য হিসেবে বিবেচনা করি, সেখানে ‘টেকসই উন্নয়ন’, ‘পরিবেশ’ ও ‘কস্ট এফিসিয়েন্সি’র প্রশ্নটি সামনে আসবেই।

সময় ও সভ্যতার সাথে তাল মেলাতে সংবাদপত্রকে টেকসই (sustainable), পরিবেশ-বান্ধব ও কস্ট-এফিসিয়েন্ট হতে হয়েছে। পৃথিবীর সব দেশের আধুনিক সংবাদপত্রই আজ প্রযুক্তিনির্ভর। সংবাদপত্র আজ আর ছাপাখানায় যেতে চায় না। কম্পিউটার ছাপাখানার চেহারা বদলে দিলো। বলা যায়, কালের পরিক্রমায় সেই কম্পিউটার বা তথ্য-প্রযুক্তিই গতানুগতিক সংবাদপত্রের কাল হয়ে দাঁড়ালো। আজকের সংবাদপত্র উৎপাদন থেকে ভোগ—পুরোই কম্পউটার, ল্যাপটপ, হ্যান্ডহেল নির্ভর। ছাপায় তৈরি সংবাদপত্রের আজ যায় যায় অবস্থা!

আমাদের দেশে সংবাদপত্রের জীবনচক্রে এ শতাব্দীর সূচনাটিকালটি একটি মাইলফলকই বলতে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশের কাছে আমরা পথিকৃৎও বটে। দেশে পুরোপুরি অনলাইন ভিত্তিক গণমাধ্যমের সূচনা হয় তখনই। দেখাদেখি অনেক সংবাদপত্রও তাদের অনলাইন ভার্সন চালু করে। শুরু হয় বাংলাদেশে অনলাইন গণমাধ্যমের অগ্রযাত্রা। দেশে অনলাইন গণমাধ্যমের এই অভিষেকের সাথে মিশে আছে একটি নাম; একটি প্রতিষ্ঠান—আলমগীর হোসেন।

আলমগীর হোসেন অফলাইন গণমাধ্যমের প্রতি ছুঁড়ে দিয়েছিলেন এক চ্যালেঞ্জ। আর ভবিষ্যতকে নিয়ে এসেছেন সমকালে। তারপর আর থেমে যায়নি অনলাইনের জয়যাত্রা। স্মর্তব্য, একই সময় আমরা তথ্য-প্রযুক্তিতেও এগিয়ে যাই। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে মোবাইল সেবা চালু হয়। ফলে, তথ্য-প্রযুক্তি চলে আসে জনগণের হাতের মুঠোয়। অফিস-বাসা সর্বত্রই কাগজের জায়গা দখল করে নেয় কম্পিউটার। আর কম্পিউটারের মাধ্যমে আমরা প্রবেশ করি তথ্য-প্রযুক্তির মুক্ত বিশ্বে। আর আজকের গণমাধ্যমের কাছে প্রতিটি সেকেন্ডই মূল্যবান।

সময়ের সাথে তাল মেলাতে না পারলে গতরাতের ব্রেকিং নিউজটাও আজ সকালে অপ্রাসঙ্গিক, বাসি তো বটেই। কে কার কতটা আগে কী জানতে ও জানাতে পারে—আজকের বিশ্বে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। বছর দশেক আগের এক ঘটনা। কক্সবাজারে গিয়েছি। সন্ধ্যার সময় দেখলাম, সাইকেলে করে এক হকার হোটেলের জন্য অনেকগুলো পত্রিকা নিয়ে এসেছে। অভ্যর্থনা থেকে আমার রুমের পত্রিকাটা নিয়ে পড়তে থাকলাম। সেদিন সেই পত্রিকাই মনে হয়েছিল নতুন—যেখানে থাকত দুই দিন আগের সংবাদও। তখন সান্ত্বনা ছিল—অন্তত দিনের পত্রিকা দিন থাকতে তো হাতে পেয়েছি। কিন্তু আজ সংবাদ সেকেন্ডের ব্যাপার মাত্র।

একসময় বাড়ির বৈঠকখানায় একটি পত্রিকা ঘরের শোভা বর্ধন করত। কিন্তু আজ কোনো বাড়িতে পত্রিকা রাখলে মনে হয় ও বাড়িতে তথ্য-প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগেনি, সেকেলে। এটাই আজকের ধারণা।

একদশক আগেও এখানে বিদেশি পত্রিকা হাতে পাওয়া ছিল কঠিন। ব্রিটিশ কাউন্সিলে গিয়ে সপ্তাহখানেক আগের দি গার্ডিয়ান বা টাইমস পড়েই বিদেশি পত্রিকা দেখা ও পড়ার স্বাদ মেটাতে হয়েছে। দুই-তিন সপ্তাহের পুরনো সাপ্তাহিক টাইমস, আনন্দবাজার ও দেশ পত্রিকা কিনতে হতো নীলক্ষেত থেকে। আজকের দিনে এসবই ইতিহাস। সবই আজ হাতের মুঠোয়—একটি ক্লিক বা প্রেসএওয়ে।

হ্যাঁ, সংবাদপত্র তার সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করে নিয়েছে। অনেক ঐতিহাসিক ও বিখ্যাত সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে গেছে, নয়তো অনলাইনে পদার্পণ করেছে। বাংলাদেশর প্রায় সব সংবাদপত্রই আজ অনলাইনে রূপান্তরিত হয়েছে। দুধ রোজ করে খাওয়ার মতো সংবাদপত্র রোজ করে পড়ার দিন আজ অতীত। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সব পত্রিকাই আজ ডিজিটাল পথের পথিক। আকাশের মতোই উন্মুক্ত আজ সাইবার স্পেস। এখানে যার যত প্রভাব তিনিই রাজা। সাইবার স্পেসে দখলদারিত্ব বজায় রাখতে সবাই আজ মরিয়া। পত্রিকার পাশাপাশি টেলিভিশনও আজ অনলাইনে। তথ্য ও বিনোদনের জগৎ আজ পুরোই উন্মুক্ত। আমরা একই ল্যাপটপে বিবিসি, সিএনএন, আলজাজিরা দেখি, সাথে সাথে খোলা থাকে দেশ-বিদেশের অনেক পত্রিকা, ইউটিউব, ফেসবুক আরো কত কি! নীল-নিষিদ্ধ জগৎও এর বাইরে না। সবই আজ পণ্য। কে কী ভোগ করছে কে কিসের সওদাগর সেটিই বিবেচ্য।

মানুষের পছন্দের জগতে পরিবর্তন এসেছে। আগামীর দিনগুলোতে ‘অনলাইন’ বা ডিজিটাল মিডিয়া ছুঁয়ে যাবে জীবনের সবকিছুই। সেখানে চ্যালেঞ্জটিও অনেক বড়। দায়িত্বশীলতার জায়গাটিকে অনেক বড় করে দেখার সময় এসেছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন অনলাইন পত্রিকা বের হচ্ছে। অনেকেরই সংবাদ প্রকাশ ও প্রচারে কোনোরকম দায়বদ্ধতা দেখা যায় না। তাদের অনেক সংবাদেই সত্য-মিথ্যার কোনো ভেদ নেই। বোমা ফাটানো নিউজ ছাপানোই তাদের কাজ। ক’দিন বোমা ফাটিয়েই লাপাত্তা। আজ আছে কাল নেই অবস্থা আর কি! অনলাইনের বিকাশের পাশাপাশি এ অসুস্থ প্রতিযোগিতার পথ রুদ্ধ করতে হবে। সুস্থ প্রতিযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করা জরুরি। মুক্ত আকাশে দূষিত বায়ু কাম্য হতে পারে না।

রাষ্ট্র, দেশ, সংস্কৃতি, অভ্যাস-রুচি, প্রজন্মের ভবিষ্যত—সবই আজ আগামী দিনের অনলাইনের গতি-বিধির ওপর নির্ভর করবে। সেখানেই অনলাইনের ধারক-বাহকের দায়বদ্ধতা। শুধু ‘সবার আগে সর্বশেষই’ শেষ কথা নয়, এটা সবার আগে সর্বনাশও ডেকে আনতে পারে।

আমাদের যাপিত জীবন আজ অনলাইনে। এখানে কাঠুরিয়া থেকে শুরু করে রাখাল বালক এমনকি বাঘও (রূপকার্থে) অনলাইন বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহাকারী। একটি কৌতুক আছে, এক রাখাল বালক ঘরে বসে ফেসবুকে স্টাটাস দিলো: Hi Gyes, বাঘ, বাঘ, বাঁচাও, বাঁচাও, at Jungle! কাঠুরিয়া তথন জঙ্গলে কাঠ কাটার পর ফেসবুকিং করছিল। ওই রাখালের স্টাটাস দেখে কাঠুরিয়া কমেন্ট করল, “আ’ম এট জঙ্গল, নো বাঘ।” বালক রিপ্লাই দিলো “কাঠুরিয়ারে বাঘের কথা কইয়া বেকুব বানাইছি, লোল, ফিলিং মাইরালা।”

অনেকে তা দেখল। কাঠুরিয়া অপমানিত বোধ করল। কদিন পরে কাঠ কাটতে গিয়ে কাঠুরিয়া আবার নোটিফিকেশন পেল। রাখাল বালক লিখেছে: “বাঘ, বাঘ, বাঁচাও, বাঁচাও, at Jungle!” এবার আর রাখালের ফাঁদে পা দিলো না কাঠুরিয়া। উল্টো কমেন্ট করল: “Moja Loss???” অনেকেই সে কমেন্ট পড়ল, লাইক দিলো। কিন্তু রাখাল আর কোনো রিপ্লাই দেয় না। কিছুক্ষণ পর বাঘের স্টাটাস: “খাইতে মজা আছে, eating রাখাল, পুরাই LoL!!” (সংগৃহীত)।

কতটা প্রাসঙ্গিক জানি না। তবে অনলাইনের দুনিয়ায় সবাই এর ভোক্তা। ভোগ্য পণ্যও অনেক। বনে বাঘ না থাকলেও, ইন্টারনেট মানে এক অন্তর্জাল; এক বিশাল জঙ্গল। সে জঙ্গলে বাঘও আছে, হরিণ, খরগোস, প্রজাপতিও আছে। ঝর্ণা আছে, আছে “নীল” দরিয়া। কে কোথায় সাঁতার কাটবে তা অভিযাত্রীর মর্জি।

এরশাদুল আলম প্রিন্স
আইনজীবী ও কন্ট্রিবিউটিং এডিটর-বার্তা২৪

এ সম্পর্কিত আরও খবর