কালো হইলেই তো ঘানি ঘানি মনে হয়

, যুক্তিতর্ক

এরশাদুল আলম প্রিন্স | 2023-08-25 06:37:49

সরিষার তেল কালো হলেই ঘানি ভাঙানো তেল মনে হয় রাঁধুনী সরিষা তেলের এই বিজ্ঞাপনটিতে শুধু সরিষা তেলেরই নয়, আমাদের প্রতিদিনের ভোগ্যপণ্যেরই একটি বাস্তবচিত্র ফুটে উঠেছে। যেকোনো পণ্যের ভোক্তাকে ধোঁকা দেওয়ার মহড়ায় বাজার আজ সয়লাব। এখানে সরিষার তেল কালো হলে ঘানি ঘানি মনে হয়, মাছের ফুলকি লাল হলে তাজাতাজা মনে হয়—এরকম অসংখ্য সহজাত ধারণাকে পুঁজি করে চলছে এক চরম ধোঁকাবাজির বাণিজ্য।

এখানে কোনটা আসল আর কোনটা নকল, ক্রেতারা তো বটেই, খোদ ভোক্তারাই তা নিয়ে এক ধন্দে। ফলে, আমরা যা কিনছি তা হয়তো বিশ্বাস করেই কিনছি, কিন্তু আস্থা নিয়ে কিনছি না। এসব আমাদের গা-সহা হয়ে গেছে। আমরা সাধারণ ভোক্তারা এনিয়ে আর ভাবিও না। কিনতে হবে তাই কিনছি, খেতে হবে তাই খাচ্ছি। ভালো হলে আলহামদুলিল্লাহ! মন্দ হলে কী আর করা! কপালের দোষ! আমাদের কপালের দোষ আর গেল না।

খাবার আমাদের মৌলিক চাহিদা। মানুষের প্রথম এবং শেষ চাহিদাও খাদ্য। সেই খাদ্য নিয়ে এত বড় বেইমানি কতবড় অনৈতিক ও ঘৃণ্য অপরাধ তা কি আমরা কখনো ভেবে দেখেছি? এর চেয়ে বড় দুর্নীতি, ভ্রষ্টাচার আর কী হতে পারে? এ তো ধীরে ধীরে ‘নরহত্যার’ সমতুল্য। একজন মানুষকে ধীরে ধীরে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করার মতো।

এজন্য উন্নত বিশ্বে ভেজাল খাদ্য প্রস্তুত, বিক্রেতা ও সরবরাহকারীদের জন্য আইন খুবই কঠিন। জেল, জরিমানা, লাইসেন্স বাতিলসহ আরো অনেক ব্যবস্থাই নেওয়া হয়। আমাদের এখানে মাঝে মাঝে যেমন ‘শো ডাউন’ হয়, তেমন না। আমাদের এখানে মাঝে মাঝে মোবাইল কোর্ট সাংবাদিকদের সঙ্গে নিয়ে অভিযান চালায় আর কিছু জরিমানা করে। রাষ্ট্রের কোষাগারে কিছু অর্থকড়ি জমা হয়। কারো জেল জরিমানা হয়েছে এমন কথা শোনা যায় না। ব্যবসা বা লাইসেন্স বাতিল তো অনেক পরের কথা।

আমাদের নিরাপদ খাদ্য আইন নামে একটি আইন আছে। খাদ্য উৎপাদন ও বিপণন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা জড়িত তারা সবাই এই আইনের আওতায়। কিন্তু তাদেরই কালো কালো হাতের ছোঁয়ায় নিরাপদ খাদ্যও আজ অনিরাপদ খাদ্যে পরিণত হয়েছে। নিরাপদ খাদ্য আইনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা আছে, ‘যাহা মানবদেহের জন্য উপকারী আহার্য হিসাবে জীবন ধারণ, পুষ্টি সাধন ও স্বাস্থ্য-রক্ষা করিতে ব্যবহৃত হইয়া থাকে, উহাই খাদ্যের অন্তর্ভুক্ত হইবে।’ প্রশ্ন হচ্ছে আমরা যা খাই তার কতটা আসলেই ‘উপকারী আহার্য?’ এসব খাবার আমাদের ‘পুষ্টি সাধন’-তো দূরের কথা সাধারণ ‘স্বাস্থ্য-রক্ষা’ করতে কতটা সহায়ক সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। আমাদের তেলে ভেজাল, হলুদ-মরিচে ভেজাল, খাসির মাংস জেনে ভেড়ার মাংস, গরুর মাংস জেনে মহিষের মাংস কিনছি ও খাচ্ছি। কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। এ রকম অভিযোগহীন ভোক্তাশ্রেণী দুনিয়ায় আর একটিও নেই। তাই আমাদের জন্য ‘ঘানি ঘানি’ মনে হওয়া তেলই উপাদেয়!

দেশে ‘খাদ্য আইন’ আছে, ‘খাদ্য আদালত’ আছে, ‘নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ’ আছে, ‘খাদ্য পরীক্ষাগার’ আছে, ‘খাদ্য বিশ্লেষক’ আছে, ‘খাদ্য পরিদর্শক’ ও ‘পরিষদ’ আছে, আছে ফৌজদারী কার্যবিধি এমনকি দণ্ডবিধিও। কিন্তু ভেজাল খাদ্যচক্রের হাত থেকে আমাদের নিস্তার নেই। খাবারের দুনিয়ায় এখানে সবই রঙিন! কারণ, সরিষার তেল যেমন কালো হলে ঘানি ঘানি মনে হয়, অন্যান্য খাবারেও রঙ দিয়ে আসল আসল ভাব ফুটিয়ে তোলা হয়। পরিবেশনাই এখানে আসল কথা।

ভেজাল খাবারের সাথে ফ্লেবার যোগ করলেই হয়ে গেল আসল খাবার। আসল সরিষারে তেলের চেয়েও বেশি ঘ্রাণ পাওয়া যায় এসব ‘ঘানি ঘানি’ তেলে। আমাদের আপেল, কমলাসহ অন্যান্য ফল দুই মাস রেখে দিলেও কিছু হবে না। মরা মুরগির এমন সুস্বাদু চিকেন ফ্রাই বিশ্বে বিরল, এমন লাল তরমুজ শুধু বাংলাদেশেই পাওয়া যায়! জেলিযুক্ত এমন সুদৃশ্য চিংড়ি শুধু এখানেই চাষ হয়!

এমনকি জীবনরক্ষাকারী ওষুধেও ভেজাল। মানহীন বা নিম্নমানের ওষুধে বাজার সয়লাব। গণমাধ্যমে মাঝে মাঝে এসব খবর চাউর হয়। একটা কৌতুক : ফার্মেসি দোকানী রোগীকে জিজ্ঞেস করলেন, কেমনে বুঝলেন এইগুলা ভেজাল ওষুধ? রোগী বলল, ভাই খাইলাম জ্বরের ওষুধ আর সাইরা গেল আমার আমাশা! ফার্মেসি দোকানী বলল, তাইলে আরো ২০ টাকা দেন। আমাশার ওষুধের দাম ৫০ টাকা!

কিন্তু দোষ কি শুধু ব্যবসায়ীদের? স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে ও অন্যের বিনা প্ররোচনায় আমরা নিজেরাই কি ধীরে ধীরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিই না? আমাদেরও একটু সচেতন হতে হবে। ভোক্তা অধিকার আইনের অধীনে ভোক্তারা অভিযোগ করতে পারে। আমরা কেন অভিযোগ করি না। এছাড়া আদালতের দরজা তো খোলাই আছে। আমাদেরও এর বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে, সোচ্চার হতে হবে।

শুধু নিরাপদ খাদ্য আইন দিয়েই হবে না। আইনের প্রয়োগ লাগবে। সেজন্য খাদ্য উৎপাদন, আমদানি, প্রক্রিয়াকর‌ণ, মজুত, সরবরাহ, বিপণন ও বিক্রয় সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমের সাথে যারা জড়িত তারা যেনে আইন মেনে সব কাজ করেন তা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ যারা রয়েছেন তাদেরকে আরো কঠোর হতে হবে। দেশকে ভেজালমুক্ত করতে হলে এর বিকল্প নেই।

আমাদের এখানে অবস্থা এমন হয়েছে যে, শিক্ষক ছাত্রকে প্রশ্ন করছে বলতো ভেজাল খাদ্য আর ভেজাল ওষুধের মধ্যে পার্থক্য কী? ছাত্র : স্যার খুবই সোজা, একটায় ফরমালিন থাকে, আরেকটায় থাকে না! ভেজালের এই ঘানি জাতি আর কতকাল টানবে? এই ‘ঘানি ঘানি’ মনে হওয়া অবস্থা থেকে আমরা মুক্তি চাই।

এরশাদুল আলম প্রিন্স
আইনজীবী ও কন্ট্রিবিউটিং এডিটর-বার্তা২৪

এ সম্পর্কিত আরও খবর