গত ৫ বছরের কম ব্যবধানে তৃতীয়বারের মত অনুষ্ঠিত হল যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচন। ২০১৬ সালে এক গণভোটে সেদেশের অধিকাংশ মানুষ ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে যুক্তরাজ্যকে বের করে আনার পক্ষে রায় দিয়েছিল, যা ব্রেক্সিট নামে পরিচিত। ইইউ সনদ অনুযায়ী এই আঞ্চলিক সংস্থা থেকে কোন সদস্য বের হয়ে আসার প্রক্রিয়া সম্পাদন করতে দুই বছর সময় লাগে। কিন্তু এই গণভোটের রায়কে বাস্তবায়ন করা যায়নি বহুল আলোচিত যুক্তরাজ্যের সাথে ইইউর বিচ্ছেদ চুক্তি (যা ডিভোর্স বিল নামে পরিচিত) সেদেশের পার্লামেন্ট হাউস অব কমন্সে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে অনুমোদন না পাবার কারণে।
২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে ডেভিড ক্যামেরনের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ইইউ থেকে বিচ্ছেদ প্রশ্নে গণভোট অনুষ্ঠিত হলেও তিনি ব্যক্তিগতভাবে এই বিচ্ছেদের বিরোধী ছিলেন। আর তাই গণভোটের পরপরই নৈতিক অবস্থান থেকে তিনি দল এবং প্রধানমন্ত্রীত্বের পদ থেকে ইস্তফা দানের পর তেরেসা মে এই পদে অভিষিক্ত হন। ব্রেক্সিটের পক্ষে নিজের এবং সংসদে দলের অবস্থান শক্তিশালী করার প্রয়াসে ২০১৭ সালে নতুন করে নির্বাচনের ডাক দিয়ে হতাশ হন।
সেবারের নির্বাচনে তার দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালে আয়ারল্যান্ড ডেমোক্র্যাটিক দলের সাথে জোট বেঁধে সরকার গঠন করতে সক্ষম হলেও পরবর্তীতে একাধিকবার ইইউর সাথে যুক্তরাজ্য বসে বিচ্ছেদের একটি রূপরেখা চূড়ান্ত করলেও তা পার্লামেন্টে বিরোধী দল এবং নিজ দলের একাংশের বিরোধিতায় অনুমোদন করাতে পারেননি তিনি। এই অবস্থায় দলের ভেতর থেকে কঠোর সমালোচনার মুখে তিনিও ইস্তফা দিলে কট্টর ব্রেক্সিটপন্থী হিসেবে পরিচিত বরিস জনসন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান। দায়িত্ব লাভের পূর্বে তিনি সহসাই ব্রেক্সিট অনুমোদন করাতে পারবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিলেও তিনিও একাধিকবার ধাক্কা খেয়ে সর্বশেষ চেষ্টা হিসেবে পার্লামেন্টে দলের সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে আবার সরকার গঠন করার প্রয়াসে সাধারণ নির্বাচনের ডাক দেন।
এবারের নির্বাচনটিকে তাই যুক্তরাজ্য তথা আন্তর্জাতিক পরিসরে দেখা হচ্ছিল ব্রেক্সিট চূড়ান্তভাবে কার্যকর করা না করার একটি ব্যবস্থা হিসেবে। বাংলাদেশ সময় আজ (১৩ ডিসেম্বর) ভোরে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও ইতোমধ্যে যতটুকু ফলাফল এসেছে তা থেকে অনুমান করা যাচ্ছে যে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের বৃহস্পতি এখন তুঙ্গে। এমনিতেই এ যাবৎকালের ইতিহাসে সেদেশের নির্বাচন নিয়ে জনমত জরিপ ভুল প্রমাণিত হবার কোনো রেকর্ড নেই। এবারও এই জরিপের ফলাফলকে সত্য প্রমাণিত করে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ দল হাউস অব কমন্সে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে যাচ্ছে।
এখন পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে তা থেকে অনুমান যায় যে বরিস জনসনের দল হাউস অব কমন্সের ৬৫০টি আসনের মধ্যে ৩৮৬টির অধিক আসন লাভ করতে পারে, আর বিরোধী দল লেবার পার্টির আসন দাঁড়াতে পারে ১৯১টিতে। নিয়মানুযায়ী সরকার গঠনের জন্য ৩২৫টি আসনের দরকার। অবস্থাদৃষ্টে দেখা যাচ্ছে যে নিকট ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ব্যবধানে জয় পেতে যাচ্ছে দলটি।
এর আগে ১৯৮৭ সালে মার্গারেট থ্যাচার তার তৃতীয় মেয়াদে এমন বড় ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন। এই জয়ের মূলত দুটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে; প্রথমত প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি আসন পাওয়াতে এবার ব্রেক্সিট চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে আর প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে বেগ পেতে হবে না, আর দ্বিতীয়ত, দেশটিকে আর মধ্যবর্তী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে না। এর আগে ইইউ থেকে ব্রেক্সিট চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য চূড়ান্তভাবে ২০২০ সালের ৩১ জানুয়ারি সময়সীমা বেধে দেয়া হয়েছে। এর আলোকে এবার সঙ্গত কারণেই আশা করা যায় যে ব্রেক্সিট কার্যকর হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
এই সাধারণ নির্বাচনটি ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ এবং বিরোধী লেবার উভয় দলের জন্য একধরনের অস্তিত্বের লড়াই ছিল। সংসদে বারবার ক্ষমতাসীন দল কর্তৃক আনিত ব্রেক্সিট খসড়া চুক্তি পাশ না করাতে লেবার দল নিজ দলের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দলের একাংশ এবং অপরাপর বিরোধী পক্ষগুলোর ওপর এতদিন ধরে যেভাবে নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিল, এবার এর কেবল আনুষ্ঠানিক অবসান হলো না; বরং রাজনীতিতে লেবার দল অনেকটাই পিছিয়ে পড়ল। দেশের সাধারণ জনগণ যে কতটা ব্রেক্সিটপন্থী এবং প্রকারান্তরে লেবার দলের নীতি বিরোধী এর একটা বড় প্রমাণ ঘটল। নির্বাচনের পুরো ফলাফল আসার আগেই তাই লেবার দলের প্রধান জেরেমি কারবিন দলের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন।
এবারের নির্বাচনটি সবকিছুকে অতিক্রম করে ব্রেক্সিট ইস্যুকে সামনে নিয়ে এলেও এখানে আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে স্কটল্যান্ড ভিত্তিক স্কটিশ ন্যাশনালিষ্ট পার্টির (এসএনপি) দারুণ সাফল্য। এখন পর্যন্ত যা ধারণা করা যাচ্ছে তা হল, ওয়েস্টমিনিস্টারে স্কটল্যান্ডের জন্য সংরক্ষিত ৫৯টি আসনের মধ্যে তারা ৫৫টিতে জয় পেতে পারে। ২০১৭ সালের নির্বাচনে তাদের আসন ছিল ৩৫টি। এসএনপির এই বিজয় আবার যুক্তরাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের রায়ের সাথে কিছুটা বিপরীতধর্মী। দলটি ব্রেক্সিটবিরোধী, অর্থাৎ তারা ব্যাপকভাবে ব্রেক্সিটের বিপক্ষে রায় দিয়েছে। অন্যদিকে নির্বাচনের আগে দলটির নেতা নিকোলা স্টারজিয়ন স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা প্রশ্নে আবারও গণভোট আয়োজনের ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
সুতরাং এই দিকগুলো বিবেচনা করলে আপাতদৃষ্টিতে কনজারভেটিভ দলের বিশাল সাফল্যের বিপরীতে ভবিষ্যতে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার দাবি আবার নতুন মাত্রা লাভ করতে পারে, যা হয়তো ভবিষ্যতে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে ফেলতে পারে। এমনিতেই এর আগে স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোট ৫১-৪৯ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে নাকচ হয়ে গেলেও যতই দিন যাচ্ছে স্কটল্যান্ডের ভেতর জাতীয়তাবাদী চেতনা তত বাড়ছে এবং ধারণা করা হচ্ছে আরেকবার যদি গণভোট অনুষ্ঠিত হয় তাহলে হয়ত স্কটল্যান্ডকে যুক্তরাজ্যের সাথে ধরে রাখা কঠিন হবে।
এবারও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিগত সংসদ সদস্যরা নির্বাচনে তাদের জয়ের ধারা অব্যাহত রেখেছেন। আগেরবারের তিনজনের সাথে এবার যুক্ত হয়েছেন আরও একজন, তিনি আফসানা বেগম। পূর্ব লন্ডনের পপলার আন্ড লাইমহাউস আসন থেকে বিপুল ভটে নির্বাচিত হয়েছেন। এর আগের জন রুশনারা আলী এবার চতুর্থবারের মত এবং রুপা হল এবং টিউলিপ সিদ্দিকী উভয়েই তৃতীয়বারের মত নির্বাচিত হয়েছেন। তারা সকলেই বিরোধী লেবার দল থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। সবকিছু মিলিয়ে যুক্তরাজ্যে একটি স্থিতিশীল সরকার গঠনের মাধ্যমে ব্রেক্সিট ইস্যুর নিষ্পত্তি ঘটবে এটা যেমন সত্য তেমনি এর ফলে অনেকটা ‘একলা চল’ নীতিতে তারা কতটুকু সফল হবে সেটাও দেখার বিষয়।
লেখকঃ সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়