সমতাভিত্তিক টেকসই উন্নয়নে প্রয়োজন সুশাসন

, যুক্তিতর্ক

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ | 2023-08-31 21:37:13

বাংলাদেশের উন্নয়নের গতি ও প্রকৃতি নিয়ে প্রথমেই কিছু কথা বলা যায়। সামগ্রিক অর্থনীতির সূচকগুলোর অর্জন ভালো। আমরা প্রবৃদ্ধির ৬-এর বৃত্ত থেকে বেরিয়ে গেছি। এটি ইতিবাচক। সার্বিক উন্নতি সন্তোষজনক। এ জন্য বাংলাদেশ একটা মডেল।

দুর্বল দিকটা হলো, অর্জনের এ ফলগুলো সমাজের নিচের স্তরে অপেক্ষাকৃত খুব কম পৌঁছেছে। ধরুন ধনাঢ্য শ্রেণী, যারা আগে একটা গাড়িতে চড়ত, তারা এখন একাধিক গাড়িতে চড়ছে। গরীব লোক আগে স্যান্ডেল পরত না, তারা স্যান্ডেল পরছে এবং কিছু আয় বেড়েছে। এর বেশি কিছু নয়। অর্থাৎ অর্থনৈতিক বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। যেটা ভালো নিদর্শন নয়। উন্নয়নটা সমতাভিত্তিক হচ্ছে না। সমতাভিত্তিক উন্নয়ন না হলে তা টেকসই হয় না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আমরা রাজনৈতিক স্বাধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তি এ দুটিই চেয়েছিলাম। সেটি পূরণ হচ্ছে কি? এখন আমরা শুধু প্রবৃদ্ধি দেখছি, সুষম বণ্টন দেখছি না।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশসমূহে গত চার দশক ধরে বিভিন্ন কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে উন্নয়নের নামে। ’৬০-এর দিকে প্রথম উন্নয়ন দশকের মূল লক্ষ্য ছিল প্রবৃদ্ধি (growth); দ্বিতীয় দশকে লক্ষ্য ছিল প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সমতা (growth with equity); তারপরের দশকে এলো বিকেন্দ্রীকরণ (decentralization); গণচেতনা (mass awareness) এগুলো; তারপর এখন উদ্দিষ্ট লক্ষ্য হলো অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন (participatory development), পরিবেশের সঙ্গে ভারসাম্যমূলক উন্নয়ন উৎসাহে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার মদদপুষ্ট বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে। বাংলাদেশও এই রকম কৌশলের বাইরে থাকেনি। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি এরকম বিভিন্ন উন্নয়ন (sustainable development), নারী উন্নয়ন এগুলো। এই সমস্ত কৌশলই এসেছে দাতা দেশসমূহের প্রচেষ্টার ফলে তবু গণদারিদ্র‍্য দূর হয়নি বরং অনেক দেশে বেড়েই চলছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের জন্য দারিদ্র্য একটি বিশাল সমস্যা। বস্তুত আপেক্ষিক দারিদ্র‍্য ক্রমেই চরম আকার ধারণ করছে এবং এটা সামাজিক একটা challenge হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক স্থিতিশীলতাও সঙ্গীন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। কোনো কোনো ‘টার্গেট গ্রুপ’ ভিত্তিক প্রকল্প দারিদ্র্য কিছুটা লাঘব করলেও সার্বিকভাবে দারিদ্র্য তেমন কমেনি। বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সিংহভাগ পল্লী অঞ্চলে। অতএব দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং পল্লী উন্নয়ন এই দুটির যোগসূত্র রয়েছে। তবে এটা লক্ষ্য করা যায় যে, ‘উন্নয়ন’ শব্দটির অস্পষ্ট ব্যবহারের ফলে অনেক সময় মূল সমস্যা দারিদ্র্য আড়ালে থেকে যায়।

উন্নয়নকে সুশাসন ও গণতন্ত্র থেকে আলাদা করে দেখা ঠিক নয়। উন্নয়ন ও গণতন্ত্র অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। উদাহরণ দেওয়া হয়, গণতন্ত্র ছাড়াও বিশ্বের কিছু দেশে উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু সে উন্নয়ন টেকসই ও সমতাভিত্তিক নয়। সেখানে শুধু বস্তুনির্ভর প্রবৃদ্ধি ও ভোগবাদের প্রসার হয়েছে। মূল্যবোধ, ব্যক্তি স্বাধীনতা এগুলোর প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ ওই পথে চলুক, আমরা সেটি চাই না।

বাংলাদেশে স্বাধীনতার লক্ষ্য ছিল, রাজনৈতিক স্বাধিকার এবং অর্থনৈতিক মুক্তি। বাংলাদেশের জন্য আন্দোলনটা বহু আগে থেকে শুরু হয়েছিল, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ’৬৯-র গণ-অভ্যুত্থান। বিশেষ করে ছয় দফা আন্দোলনের যে ভিত্তি ছিল, সেটা ছিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অন্যায় আচরণ এবং এখানকার লোকজনকে অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করা থেকে মুক্ত করা। অর্থনীতি মুক্তি অর্জন করার জন্য দরকার ছিল রাজনৈতিক স্বাধীনতা। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করলাম। বিভিন্ন দোলাচল, অনিশ্চয়তা ও চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আমরা এ পর্যায়ে এসেছি। আমাদের দেশে আসলে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নটা শুরু হয়েছে ১৯৯০ থেকে। প্রথম গণতান্ত্রিক সরকার শুরু হলো এবং ১৯৯০-র পর ধারাবাহিকভাবে ভালোভাবেই অর্জনটা ছিল। তার পর আমাদের ফরেন এক্সচেঞ্জ মার্কেট, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, গার্মেন্ট এবং অন্যান্য সেক্টরে উত্তরোত্তর আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এই কন্ট্রিবিউশনটা বিশেষ কোনো একটা সরকারের সময়ে হয়নি। ধারাবাহিকভাবে সব সরকারের সময় হয়েছে। তাই এখানে কৃতিত্ব কিন্তু সবার। একক কোনো সরকার এর কৃতিত্ব দাবি করতে পারবে না। আবার ব্যর্থতার ব্যাপারেও এককভাবে কাউকে দোষ দিতে পারবে না। এদিকে আমি যাচ্ছি না।

আমি এখন আমাদের যে মূল চ্যালেঞ্জগুলো এবং সেখানে আমাদের অর্থনৈতিক চিন্তাধারা, রাজনৈতিক চিন্তাধারার কিছু কথা বলব। মানে রাজনৈতিক যে বিশ্লেষণ বা অর্থনীতির যে বিশ্লেষণ, সে বিষয়ে আমি প্রাসঙ্গিক কথা বলব। প্রথমত, চ্যালেঞ্জগুলো আমাদের অর্থনীতির দিক দিয়ে, যেগুলো রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যায়। প্রথম হলো আমরা যে ধারাবাহিকভাবে প্রবৃদ্ধি অর্জন করছি, সেটা এখন কিছুটা মন্থর, আবার বিনিয়োগও মন্থর হয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, দেখছি যে সরকারের যে নীতিগুলো নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর ধারাবাহিকতা বা নীতিগুলো যে খুব সুষ্ঠু নীতি হয়েছে সেটাও নয়। আবার নীতিগুলো বাস্তবায়ন যারা করবে, আমলা এবং সরকারের যে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ আছে তাদের দক্ষতা ও স্বচ্ছতা প্রশ্নবহুল। সব শেষে সার্বিকভাবে যে উন্নয়নগুলো হয়েছে, বিশেষ করে সূচকের দিকটি বেড়েছে, প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, ব্যক্তিগত আয় বেড়েছে গড় হিসেবে। কিন্তু তার সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছেছে কিনা। যতটুকু উন্নয়ন হয়েছে, তার সুফল কিন্তু বহুলাংশে সাধারণ মানুষ পায় না। কারণ এখন আমরা দেখছি যে, দিন দিন কিন্তু ধনী-দরিদ্র-নিম্নমধ্যবিত্তদের ফারাক বাড়ছে। বঞ্চিতের সংখ্যা বাড়ছে। তবে আপেক্ষিকভাবে কেউ বলতে পারে যে, আগে তো কেউ শার্ট পরত না, প্যান্ট পরতে পারত না, মোবাইল সবার কাছে আছে। সেটা হলো আপেক্ষিকভাবে।

একজন রিকশাঅলার মোবাইল আছে, কিন্তু যে আট থেকে ১০ বছর আগে রিকশায় চড়তে পারত না, তারা এখন হাজার কোটি টাকার মালিক। তাই ফারাকটা কী। একই ধরনের লোক একই কর্মদক্ষতা কিন্তু সে চলে যাচ্ছে কোথায়। বিভিন্ন ফাঁকফোকরে, রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে, এমনকি দুর্নীতির মাধ্যমে। তাই এই অসম উন্নয়নটা অ্যাক্সেপ্টেবল নয়। এই চ্যালেঞ্জগুলো বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ব্যাপার। এ জন্য আমরা দেখছি যে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অস্থিরতা না থাকলেও অশ্চিয়তা আছে। কী হবে না হবে। কী ধরনের সরকার হবে। আর এখন যে রাজনৈতিক অবস্থাটা আছে বা যে কোনো সময় রাজনৈতিক যে গভর্নমেন্ট আসে, সেখানে আমরা কিন্তু গুড গভর্নেন্স দেখতে পাচ্ছি না। সুশাসনের অভাব আছে। সুশাসনের অভাব মানে স্বচ্ছতা নেই, জবাবদিহিতা নেই। কেউ যদি অন্যায় করে তার কোনো শাস্তি হয় না। সব থেকে মারাত্মক হলো রুল অব ল’ নেই। আইন আছে কিন্তু এটার বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে। রাজনীতির মেজর জিনিসটা যে খালি ভোট দিলে হয়ে গেল তা নয়। সুশাসন ছাড়া কিন্তু কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।

অনেকে বলে, কোনো কোনো দেশে তো মার্শাল ল’ছিল। কোনো কোনো দেশে তো ডিক্টেটর ছিল। উন্নয়ন হয়েছে। গণতন্ত্র ছাড়া। কিন্তু গণতন্ত্র ছাড়া যে উন্নয়নটা হয় সেটা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সেখানে ১০ থেকে ২০ বছর পর দেখা গেছে, বেশিরভাগ লোকই দরিদ্র। তাই ওই পথে যাওয়া যাবে না। তার পর রেগুলেটরি বডি যেগুলো আছে, যেমন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। মানুষের বিবেচনায় তো কাজ করে না, যেভাবে গ্যাস-পেট্রলের দাম বাড়ে। বিটিআরসি নানারকমের নীতি দিচ্ছে। এগুলোর কোনো কনটিনিউটি থাকে না। সরকার চেঞ্জ হলে অন্য সরকার এসে পুরো সিস্টেমই পরিবর্তন করে দেয়। যদিও অনেক ভালো নীতি অনেক সময় নেয়। মোটামুটি যদি ধারাবাহিক থাকে, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলো যেমন ভারতেও কিন্তু অর্থনীতিবিষয়ক নীতিগুলো একেবারে চেঞ্জ হয়ে যায় না। মোদি এসে তো বলেননি যে, আমরা ইন্ডাস্ট্রি করব না। আমরা এক্সপোর্ট করব না। আমরা ম্যান পাওয়ার বাড়ব না। আমরা আইটি সেক্টরে কাজ করব না। তিনি বলছেন, আমি করব অন্যভাবে। লোকজন কিছু চেঞ্জ হবে। সেটা অন্য কথা। এটা আমেরিকায়ও করে। কিন্তু আমাদের দেশে দুঃখজনকভাবে এগুলো হয় না।

আর ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ তো একেবারেই হয়নি। লোকাল গভর্নমেন্ট অর্গানাইজেশন বলে কিছুই নেই। ঢাকা থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ঢাকা থেকে করার ফলে যেটা হয়, আমাদের প্রত্যেকটি অঞ্চলের লোকজন কিভাবে বেঁচে থাকে, তাদের চাহিদা আমলে নেওয়া হয় না। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ তাদের ভূমিকা নগণ্য। এখন আবার অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ইউনিয়ন পরিষদ সচিবদের বেতন দেবে তাদের আয় থেকে।

সরকার বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের বেতন দিয়ে দিচ্ছে হাজার কোটি টাকা। আর ইউনিয়ন পরিষদের সচিবদের বেতন দেবেন না। এটা কোনো কথা হলো নাকি। ওদের কি ট্যাক্স পাওয়ার আছে? ওদের কি অথরিটি দেওয়া হয়েছে? গরীব মানুষদের ওপর আর কত ট্যাক্স চাপাবে? ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়লে, এক্সপোর্ট বাড়লে ট্যাক্স বাড়ে। ওদের কি এক্সপোর্টের ওপর ট্যাক্স করার ক্ষমতা আছে? বা আয়ের ওপর ট্যাক্স করার ক্ষমতা আছে? তাই সার্বিকভাবে আমি বলব, আমাদের যে রাজনৈতিক চিন্তাধারা, তা হলো গতানুগতিক। মার্কেট ইকোনমির ওপর, বাজারের ওপর ডিপেন্ড করে আমরা চলব এবং বাজার সবকিছু নির্দিষ্ট করবে। ডিমান্ড অ্যান্ড সাপ্লাই ঠিক করবে। সেভাবে যাবে। আর অর্থনীতিবিদরাও তখন চিন্তা-ভাবনা করছে যে, ঠিক আছে, বাজারের মধ্যে থেকেই আমরা কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি বিবেচনা করব। তার মানে কিছু কিছু জায়গায় ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে একটু মলম দিলাম। কিন্তু পুরো শরীরে যখন নানা সিস্টেমেটিক ডিজিজ হয়। আমার যদি ইমিউন সিস্টেম নষ্ট হয়ে যায়। আমার ব্লাড যদি দূষিত হয়। আমার নাকের মধ্যে ওষুধ দিলে, চোখের মধ্যে ওষুধ দিলে কী লাভ হবে। কোনো লাভ হবে না। এখন আমাদের তো হয়েছে সিস্টেমেটিক ডিজিজ। এক জায়গায় তো নয়। এটা সর্বগ্রাসী। পুরো সিস্টেম নষ্ট হয়ে গেছে। আর সেই সিস্টেম মানে রাজনৈতিক সিস্টেম। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো, বাজারগুলো এবং লোকাল লেভেলে যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে সেগুলো। স্কুলগুলো এবং স্কুল ম্যানেজিং কমিটিগুলোকেও প্রভাবিত করে পলিটিক্যাল মোটিভেশন।

ব্যাংকিং সেক্টর দীর্ঘদিন ধরেই নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে আছে। বর্তমানে এ সেক্টরের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে সুশাসনের অভাব। অভ্যন্তরীণভাবে ব্যাংকিং সেক্টরে সুশাসন বলতে কিছু নেই। দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য যেসব নীতিমালা ও আইন-কানুন আছে, কোম্পানি আইন আছে, আন্তর্জাতিক নর্মস আছে, সেগুলো সঠিকভাবে পরিপালন করা হচ্ছে না। ব্যাংকিং সেক্টরে যেসব নীতিমালা ও আইন আছে, তা আন্তর্জাতিক মানের। কিন্তু এগুলো সঠিকভাবে পরিপালন এবং বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। এর ফলে নানারকম সমস্যা দেখা দিচ্ছে। পরিচালনা বোর্ড থেকে শুরু করে ম্যানেজমেন্ট এবং নিচের দিকে কর্মকর্তা পর্যায়ে কোথাও সুশাসন আনুসৃত হচ্ছে না। সর্বত্রই মারাত্মক ত্রুটি পরিলক্ষিত হচ্ছে। সবমিলিয়ে ব্যাংকিং সেক্টর এখন মোটেও ভালো অবস্থায় নেই। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোয় সমস্যা সবচেয়ে প্রকট। পরিচালনা বোর্ড ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নির্দেশনা দেবে। তারা নীতিগত বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবে। আর ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের কাজ হবে সে নীতিমালা বাস্তবায়ন করা। পরিচালনা বোর্ড এবং ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের কার্যপরিধি আইন দ্বারা নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু প্রায়ই শোনা যায় বা অভিযোগ পাওয়া যায়, পরিচালনা বোর্ড ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের কাজে হস্তক্ষেপ করে। এখন দেখা যায়, ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ড নীতিগত সিদ্ধান্ত প্রদানের ক্ষেত্রে যত না আগ্রহী, তার চেয়ে ব্যাংকের দৈনন্দিন কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করতেই যেন বেশি উৎসাহী। ফলে ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের পক্ষে স্বাধীনভাবে তাদের সৃজনশীলতাকে ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। তারা পরিচালনা বোর্ডের দ্বারা প্রায়ই নির্দেশিত হয়ে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। এটা কোনোভাবেই ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য মঙ্গলজনক নয়।

অবশ্য ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট যে সবসময় দক্ষ হয়, তা নয়। অনেক সময় ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের অদক্ষতা এবং ত্রুটির কারণেও সমস্যার সৃষ্টি হয়। এসব নানা কারণে ব্যাংকিং সেক্টরে দুর্নীতি দেখা দিচ্ছে এবং জবাবদিহিতার ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। পরিচালনা বোর্ড ও ম্যানেজমেন্টের মধ্যে পরস্পর দোষারোপ করার প্রবণতা দেখা যায়। ফলে জবাবদিহিতার বিষয়টি গৌণ হয়ে পড়ে। ব্যাংকিং সেক্টরে মনিটরিং এবং সুপারভিশনও খুব দুর্বল। যারা পরিচালনা বোর্ডে পরিচালক বা চেয়ারম্যান হয়ে আসেন, তাদের নিজস্ব ইন্টারেস্ট থাকে। তাদের নিজস্ব ব্যবসা-বাণিজ্য থাকে। আত্মীয়স্বজনের ব্যবসা-বাণিজ্যে সুবিধা প্রদানের জন্য ব্যাংক ম্যানেজমেন্টকে চাপ দিয়ে থাকেন। নিজস্ব লোকদের ঋণ প্রদান বা চাকরি প্রদানের জন্য তারা ম্যানেজমেন্টের ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকেন। এটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। আগে ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় এমনটি ছিল না। ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যারা নিয়োগ লাভ করেন, তাদের নিযুক্তি অনেকটাই নির্ভর করে পরিচালনা বোর্ডের ওপর। কাজেই তারা ইচ্ছা করলেই পরিচালনা বোর্ডের সদস্য বা চেয়ারম্যানের পরামর্শ বা নির্দেশনা উপেক্ষা করতে পারেন না। একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্যাংকে থাকবেন কিনা, তা অনেকটাই নির্ভর করে পরিচালনা বোর্ডের সদস্যদের সন্তুষ্ট করার ওপর। ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দক্ষতা এবং পারফরম্যান্সের ওপর তার টিকে থাকা-না থাকা তেমন একটা নির্ভর করে না। ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডকে সন্তুষ্ট করতে পারলে তার পক্ষে এমডি হিসেবে টিকে থাকায় কোনো সমস্যা হয় না। এজন্য দেখবেন কোনো কোনো ব্যাংকের এমডিদের বেতন-ভাতা অত্যন্ত উচ্চ। এদের বেতন-ভাতা অনেক বেশি হওয়ার কারণ হচ্ছে তারা পরিচালকদের কথাবার্তা শোনেন; তাদের নির্দেশনা মোতাবেক কাজ করেন। এতে ব্যাংকের স্বার্থ রক্ষা হলো কিনা, সেটা তাদের বিবেচ্য বিষয় নয়। পরিচালনা বোর্ড তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আরোপ করতে চায়। পরিচালনা বোর্ডে অনেকেই থাকেন, যারা সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তারা তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চান। একজন পরিচালক বা চেয়ারম্যানের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতেই পারে; কিন্তু তা যদি ব্যাংকের কাজে ব্যবহার করতে চান তাহলেই সমস্যা দেখা দেয়। ব্যবস্থাপনার মধ্যেও আবার অনেক লোক আছেন, যারা দক্ষ নন বা নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক যদি অদক্ষ বা দুর্বল হন, তাহলে তার প্রভাব সর্বত্রই পড়ে। এতে নিচের দিকের কর্মীরা নানা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। দুর্নীতি-অনিয়ম উপর থেকে নিচের দিকে ধাবিত হয়। কাজেই টপ ম্যানেজমেন্ট যদি কঠোরভাবে সুশাসন নিশ্চিত করেন, তাহলে তার প্রভাব নিচের দিকে পড়বেই। কিন্তু আমাদের এখানে টপ ম্যানেজমেন্টের মধ্যেও সমস্যা রয়ে গেছে। সবমিলিয়ে ব্যাংকিং সেক্টরে এখন সুশাসনের অভাব, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা জেঁকে বসেছে।

এখন আমাদের সময় এসেছে এ বিষয়গুলো বিবেচনা করার। সরকার গণতন্ত্র, সুশাসন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা, গতিশীলতা এনে সুষম ও টেকসই উন্নয়নে সহায়তা করবে, এটাই এখন বিশেষ প্রয়োজন। সরকারের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান যেমন বাংলাদেশ ব্যাংক, সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ করপোরেশন সার্বিকভাবে দায়িত্ব পালন করবে। কিছু কিছু জায়গায় পাবলিক সেক্টরগুলো, করপোরেশনগুলোর মূল্য আছে। যেমন আমি উদাহরণ দিই, বিদ্যুৎ খাত। বিদ্যুৎ খাতে যখন আমাদের ক্রাইসিস হলো, তখন ঘোড়াশাল, আশুগঞ্জের মতো একটা ৫০০, ৬০০ মেগাওয়াটা বিদ্যুৎ প্লান্ট করা যেত সরকারি উদ্যোগে এবং নিয়ন্ত্রণে। এটা করলে ইন্ডিভিজুয়াল কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট যেটা দেখেছি বেসরকারি খাতে সেগুলোর ওপর নির্ভরশীল কম হতো, জনগণ স্বল্পমূল্যে বিদ্যুৎ পেত এবং সরকারি খাত থেকে ভর্তুকির খরচ কমে যেত। পাওয়ার সেক্টরে পাবলিক সেক্টরের ইনভেস্টমেন্ট থাকা উচিত। পৃথিবীর সব দেশেই থাকে। ইনডিপেন্ডেন্ট কিছু কিছু ছোট জায়গায় যেখানে গভর্নমেন্ট একেবারে পৌঁছাতে পারবে না, সেখানে পাওয়ার প্লান্ট কিছু হতে পারে। তবে একেবারে ঢালাওভাবে সব প্রাইভেট সেক্টর করবে না।

মার্কেটিংয়ের বেলায় এগ্রিকালচার মার্কেটিংয়ে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কিন্তু মার্কেট একেবারে ছেড়ে দেওয়া হয় না। যুক্তরাষ্ট্রে ক্যালিফোর্নিয়া অরেঞ্জ উৎপাদন করে। বিরাট একটা প্রতিষ্ঠান আছে। ওরা ওটার কন্ট্রোলে থাকে উৎপাদকের স্বার্থ দেখার জন্য। এটা বাজারে ছেড়ে দেয় না। তার পর কানাডায় হুইট বোর্ড আছে। কানাডার ফার্মাররা যে গম উৎপাদন করে, তাদের স্বার্থে এটা কাজ করে এবং ভোক্তাদের স্বার্থও দেখে। আর এখানে কৃষকদের ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে ফটকাবাজ বা মধ্যস্বত্বভোগী ব্যাপারীদের হাতে। গভর্নমেন্টের তো এখানে কতগুলো রুলস, কতগুলো ফ্যাসিলিটিস থাকবে। এখানে কিন্তু পাবলিক সেক্টর রুল আছে। এখানে পাবলিক সেক্টরের প্রয়োজন। অনেকে বলে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সব বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিতে হবে। আমি কিন্তু এর পক্ষপাতী নই। বরং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় যদি সততা ও স্বচ্ছতা নিয়ে আসে, তবে প্রতিযোগিতামূলক আবহ সৃষ্টি হবে ব্যাংকিং খাতে। আসলে সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী যদি একেবারে নাই থাকে, তখন দেখা যাবে কী অবস্থা। অন্যরা ইচ্ছামতো কাজ করবে। অতএব রাষ্ট্রায়ত্ত সব ব্যাংক ছেড়ে দিলে কিন্তু চলবে না। একটা, দুইটা, তিনটা কিন্তু রাখতে হবে। যেমন সোনালী ব্যাংক প্রাইমারি স্কুলের টিচারদের বেতন দেয়। এখন প্রাইভেট ব্যাংকে দিলে কী করবে। টিচারদের বেতনও হয়তো পৌঁছাবে না সময়মতো। সরকারের টাকাটা নিয়ে রেখে দেবে। আরেকজনকে ধার দেবে। তার পর সরকার ট্রেজারি ফি জমা দিল কিন্তু এক মাস দুই মাস পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকে টাকাটা পাঠালই না। তবে অবশ্য কাজ হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা ও নজরদারি আরও স্বচ্ছ এবং জোরদার করা। দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব থেকে এগুলোকে মুক্ত করতে হবে।

কয়েক বছর আগে ফরাসি অর্থনীতিবিদ নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন। তার নাম জ্যাঁ তি হল। তার মূল বিষয়বস্তু হলো, কী করে বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। মার্কেটকে লোকজনের হাতে ছেড়ে দেওয়া চলবে না। তবে নিয়ন্ত্রণ খুব সোজা কাজ নয়। আদেশ-নির্দেশে কাজ হবে না। মেকানিজম তৈরি করতে হবে। চেক অ্যান্ড ব্যালান্স। কেউ যদি এটা না মানে তাহলে তার তখন কী পরিণতি হবে। ফাইন হবে। ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইসিসের ফলে বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। ইতালি, গ্রিস, স্পেন এখনো এটা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তাই সেই চিন্তাটা করতে হবে। আমার মনে হয়, আমাদের অর্থনীতিবিদরাও সে চিন্তা করছেন। জ্যাঁ তি হল অন্য লেখকের সঙ্গে আর একটি বই লিখেছেন। ‘ব্যালান্সিং দ্য ব্যাংকস’। ব্যাংকগুলো যা ইচ্ছা তাই করবে, লোকজনকে বিপদে ফেলে আমানত নিয়ে ইনভেস্ট করবে। এটার রেগুলেট করা। কেয়ারফুললি করতে হবে। রেগুলেটকারীরা নিয়ন্ত্রণকারী যেন না হয়। বিশেষ করে ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টরে সেখানে নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সংবেদনশীল। যথাযথভাবে এটাকে দেখতে হবে।

গভর্নমেন্ট নিশ্চিত করবে ফুড সিকিউরিটি। গভর্নমেন্ট নিশ্চিত করবে সুশাসন। তার মধ্যে সবাই থাকবে। প্রাইভেট সেক্টরে কাজ করবে। একটা কথা আছে, বাংলাদেশে এখন সুশাসনের অভাব। ইনভেস্টমেন্টের আবহ নেই। পরিবেশ নেই। ইনফ্রাস্ট্রাকচারের প্রবলেম আছে। আমরা দ্রুত এগিয়ে যেতে পারছি না। যত তাড়াতাড়ি আমরা এগিয়ে যেতে পারতাম, সেটা পারছি না। একেবারেই যে স্থির হয়ে আছি সেটা নয়। রানওয়েতে কিছুক্ষণ চলার পর প্লেন টেক অফ করে। আমরা কিন্তু টেক অফ স্টেজে চলে এসেছিলাম। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে, এখনো আমরা রানওয়েতেই আছি। তার মানে চলার গতি কম ও রানওয়েটা দীর্ঘ হচ্ছে। এখনো আমরা টেক অফ করে ওপরে উঠতে পারছি না। টেক অফ হলে আলটিমেটলি গ্রোথ রেটে আমরা ছয়, সাত, আট করে ওপরে উঠে যেতাম। সেটা হলে আমাদের দ্রুত একটা উন্নতি দেখতে পারতাম।

রাজনীতির চর্চা জনগণের স্বার্থে হচ্ছে না। দেশে রাজনৈতিক সহনশীলতা ও সুস্থ রাজনীতি চর্চার অভাব প্রকট। জনগণকে বিভিন্ন বিষয়ে সম্পৃক্ত না করার প্রবণতাও বেশি। এতে জনগণের অনেক সমস্যার সমাধান হয় না। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, সমস্যাগুলোর সমাধান না করে বরং তা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয় এবং এর দায় অন্যের ঘাড়ে চাপানোর প্রবণতা বিদ্যমান। গণতন্ত্র ও উন্নয়ন দুটোই পাশাপাশি চলতে হবে। আপনি শুধু উন্নয়ন নিশ্চিত করলেন, আর গণতন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে গেলেন, তাহলে কিন্তু স্থায়ী, টেকসই, সমতাভিত্তিক ও অর্থবহ সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। আমাদের অঙ্গীকার হবে সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। এতে দিনে দিনে কেবল সমস্যার পাহাড় জমছে, কোনো সমাধান পাওয়া যাচ্ছে না। আরেকটা বিষয়, আইনের শাসন আরো দৃশ্যমান হতে হবে। তাহলে সমাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠিত হবে। এর ফলে আমার বিশ্বাস, আমাদের সব সম্ভাবনা কাজে লাগানো সম্ভব হবে।

এখন প্রয়োজন পলিটিক্যাল ফিজিবিলিটি, রাজনৈতিক সম্ভাব্যতা, যার মানে শুধু ইলেকশন নয়, গণতন্ত্রের চর্চা এবং সুশাসন, আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। সরকারকে জনগণের কথা শুনতে হবে। যেই ডিসিশনগুলো নেবে অর্থনীতির জন্য সবার সঙ্গে আলোচনা করে। অপজিশনের এবং বাইরের লোক সবার সঙ্গে আলোচনা করে। তারপর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যেটা হবে, সবসময় দক্ষতার সঙ্গে করবে। ভালো লোকদের দিয়ে করবে। সেখানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থাকবে না। সেখানে বলে দেবে না আমার লোককে তুমি কন্ট্রাক্টটা দেবে। বলে দেবে তুমি দক্ষতা ও সততার সঙ্গে করো যেন জনগণ উপকার পায়। তবেই দেশ দ্রুত অগ্রগতি, সুষম ও টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবে।

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

এ সম্পর্কিত আরও খবর