উন্নয়নকে বড় অর্থে দেখার অভ্যাস

, যুক্তিতর্ক

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা | 2023-08-27 00:21:13

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকারের প্রায় দশ বছরের শাসনামলে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে এবং হচ্ছে। এসব প্রকল্পের বেশিরভাগই যোগাযোগ খাতে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে। ভৌত অবকাঠামোর এই উন্নয়ন দৃশ্যমান। কিন্তু যেটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো এই সময়টিতে মানুষের মাঝে একটা উন্নয়ন স্পৃহা তৈরি হয়েছে, তারা কর্মমূখী হয়েছে যার কারণে তাদের সাড়া না পাওয়ায় বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন সফল হয়নি।

এই সময়ে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, ব্যয় সক্ষমতা বেড়েছে, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হয়েছে। তবে আমরা যদি উন্নয়নকে একটু বড় করে দেখতে চাই, যেখানে উন্নয়ন মানে সার্বিকভাবে জীবনযাত্রার মানের উন্নতি—সেটা আসলে শুধুমাত্র রোজগারের ওপর নির্ভরশীল নয়।

বাংলাদেশ আজ যতটুকু এগিয়েছে তাতে অবশ্যই মানুষের প্রচেষ্টাই বড় কথা। তবে কোনোভাবেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের দৃঢ়তাকে অস্বীকার করা যাবে না। শেখ হাসিনার ভেতর একটা উন্নয়ন জেদ আছে এবং তিনি তা করে দেখিয়েছেন। ২০০৮-এর নির্বাচনের পর থেকেই আমরা দেখেছি বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ খাতে। কারণ এই খাত বিগত জামাত-বিএনপি জোট সরকারের আমলে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল। বিদ্যুৎ খাতে অর্থ গিয়েছে বেশি, কারণ কুইক রেন্টাল প্লান্ট করতে হয়েছে জরুরি ভিত্তিতে। এবং সেই সময়কার প্রেক্ষাপট চিন্তা করলে এর কোনো বিকল্প ছিল না। দেশের শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে কুইক রেন্টালের কুইক সিদ্ধান্তের কারণেই। এখন সরকারের বড় নজর যোগাযোগ অবকাঠামোর বড় প্রকল্পে।

ক্ষমতাসীন দল ও প্রশাসনের লোকজন প্রকল্পগুলোকে কাজ করার সুযোগ হিসেবে দেখে—সরকারের টাকায় মানুষের উন্নয়নের জন্য কাজের সুযোগ হিসেবে নয়। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, তারা এই প্রকল্পগুলোকে দুর্নীতির, পাইয়ে দেওয়ার আখড়া করে তুলেছে।

কিন্তু উন্নয়ন মানে তো শুধু প্রকল্প নয়। গত দশ বছরে বেশ কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তথ্যের অধিকারের আইন হয়েছে, নারীদের জন্য কর্মক্ষেত্র বিকশিত হয়েছে, কৃষিখাতে স্থিতিশীলতা এসেছে।

প্রশ্ন হলো এসব কাজের পাশাপাশি আমরা সর্বজনীন অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকারের প্রতি রাষ্ট্রের বিশেষ দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করতে পেরেছি কি? কৃতিত্বকে খাটো না করে, তার ভালো কাজগুলো অস্বীকার না করেও বলা যায় যে, শেখ হাসিনার সরকার নীতিগতভাবে আর্থিক ও সামাজিক অধিকারের প্রবল সমর্থক হয়ে উঠতে পারেনি। বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতে আজ যে নৈরাজ্য তা বহু বছর এদেশে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী প্রশস্ত করার উদ্যোগুলো প্রশংসীয়। কিন্তু সেখানেও দুর্নীতি একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে রয়েছে। এমনকি অতি দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে দশ টাকা কেজি দরে চাল দেওয়ার মতো একটি অতি ভালো কাজ আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃত্বের দুর্নীতির কারণে উল্টো সরকারের বদনাম হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে, কিন্তু ব্যাপক দুর্নীতির আওয়াজ আছে।

শিক্ষাখাতে প্রতি বছর স্কুল শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে কোটি কোটি নতুন বই তুলে দিচ্ছি, যা অনেক সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশও ভাবতে পারবে না। কিন্তু শিক্ষা খাতে আজ পর্যদুস্ত প্রশ্ন ফাঁসে, জিপিএ-৫ দুর্নীতি আর নানা অনিয়মে। এই অবস্থা থেকে কিভাবে বের হওয়া যাবে, সে বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা এখনো দৃশ্যমান নয়।

কম্পিউটার, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোনের মতো অনেকগুলো প্রযুক্তিনির্ভর খাতে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। কম্পিউটারের ব্যবহার চালু হয়েছে, স্মার্টকার্ড বিলি করা হয়েছে, গ্রামীণ জনপদে আজ প্রযুক্তির ছোঁয়া। আমরা মহাকাশকেও ছুঁতে পেরেছি। কিন্তু কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বড়ভাবে পিছিয়ে আছি।

উন্নয়নকে শুধু আয় বৃদ্ধির চশমা দিয়ে দেখার ভঙ্গিটাই গোলমেলে। এটা একটা পুরনো অভ্যাসের ফল—অর্থনীতির অভ্যাস। রোজগারকেই মানুষের জীবনকুশলতার, ভালো থাকার একমাত্র ভিত্তি হিসেবে দেখার অভ্যাস। জীবনকুশলতা সত্যিই যদি শুধুমাত্র রোজগারের ওপর নির্ভরশীল হয়, তবে, আয়বৃদ্ধিই তার মান বাড়ানোর একমাত্র পথ। ঠিকই। কিন্তু, আমরা যদি উন্নয়নকে একটু বড় করে দেখতে চাই, যেখানে উন্নয়ন মানে সার্বিকভাবে জীবনযাত্রার মানের উন্নতি—সেটা স্পষ্টতই শুধুমাত্র রোজগারের ওপর নির্ভরশীল নয়।

কেবল আয়বৃদ্ধির কথা না ভেবেও জীবনযাত্রার সার্বিক উন্নতির জন্য বহু কাজ করা সম্ভব। যেমন, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা বাড়ানো। প্রশাসন যদি সৎ হয়, তবে সেটা জীবনযাত্রার সার্বিক মান অনেকখানি বাড়ায়। উন্নয়নকে বড় অর্থে ধরলে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা তার একটা মস্ত অংশ। শিক্ষার মান উন্নয়নের একটা বিরাট অংশ। সেই মান শুধুমাত্র আয়বৃদ্ধির ওপর নির্ভর করে না। আমার মনে হয়, উন্নয়নকে বড় অর্থে দেখার অভ্যাস গড়ে তোলা প্রয়োজন। আয়বৃদ্ধি আর চকচকে প্রকল্পের সংকীর্ণ খাঁচা থেকে নিজেদের মুক্ত করা দরকার।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা

এ সম্পর্কিত আরও খবর