ক্যাম্পাস রাজনীতিমুক্ত হবে কি?

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

এরশাদুল আলম প্রিন্স     | 2023-08-27 10:33:02

সতীর্থদের হাতে আবরার ফাহাদ নৃশংসভাবে খুন হওয়ার পর ছাত্ররাজনীতি বন্ধের সেই পুরনো দাবিটি আবার সামনে চলে আসে। সাধারণ ছাত্ররা বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি করেছে। তাদের দশ দফা দাবির ছয় নম্বর দাবিটি হচ্ছে, ১৫ই অক্টোবরের মধ্যে বুয়েটের সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। বাকি নয় দফা দাবির কয়েকটি দফা আবরার হত্যার বিচার ও সুষ্ঠু তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এছাড়া বুয়েটকে একটি আদর্শ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা ও এর সুনাম পুনরুদ্ধারের জন্য বাকি দফাগুলোর বাস্তবায়ন জরুরি। আমি ব্যক্তিগতভাবে ছাত্রদের ১০ দফার দাবির কোনোটিকেই অযৌক্তিক মনে করি না এবং এগুলোর বাস্তবায়নও কঠিন কিছু নয়। সদিচ্ছা থাকলে এগুলোর বাস্তবায়ন সময়ের ব্যাপারমাত্র।

বুয়েট বাংলাদেশের গর্ব। শুধু বাংলাদেশ নয়, একটি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বুয়েটের সুনাম সারা বিশ্বেই আছে। শিক্ষক ও ছাত্ররাজনীতি প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ও মর্যাদা অনেক আগেই শেষ করে দিয়েছে। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন, দেশের সব বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আজ একই দশা।

একটি বিশ্ববিদ্যালয় দেশের আশা-ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল। দেশের সব কিছু নিঃশেষ হয়ে গেলেও দুশ্চিন্তার তেমন কিছু নেই। একটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি ঠিকভাবে চলে, তাহলে ধ্বংসের ‍বুক থেকে দেশ আবার জেগে উঠতে পারে। ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনা শেষ করে, আদর্শ ও দেশপ্রেমিক মানুষ হিসেবে গড়ে উঠে দেশের হাল ধরলেই দেশ আবার মাথা তুলে দাঁড়াবে। তাই সব প্রতিষ্ঠান নষ্ট হয়ে গেলেও, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কার্যকর রাখতে হবে। কিন্তু আজ দেশের অপরাপর সব প্রতিষ্ঠানের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও ধ্বংসোন্মুখ। এ থেকে পরিত্রাণ কোন পথে?

আবরার হত্যাকাণ্ডের পর কথা উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করলেই বিশ্ববিদ্যালয় তার হারানো গৌরব ফিরে পাবে, ছাত্ররা আবার ক্লাসে ফিরে যাবে, নতুন করে আর কোনো সনি বা আবরারের কাহিনী রচিত হবে না।

আমাদের দেশের রাজনীতি মূলত রাজপথের রাজনীতি। রাজপথ যার, রাজনীতি তার। রাজপথ দখলে রাখার জন্য ছাত্র ও যুবকদের কোনো বিকল্প নেই। ন্যায় অন্যায় যা-ই হোক, রাজপথ ছাড়া যাবে না।

ছাত্ররাজনীতি দেশের বিরাজমান রাজনীতিরই অংশ। দেশের মূল রাজনীতির চরিত্র ধারণ করেই চলছে ছাত্ররাজনীতি। মূল রাজনৈতিক দলের চরিত্র ধারণ করে একই পথে চলে অন্যান্য সহযোগী সংগঠনের রাজনীতি। এটাই স্বাভাবিক। বড় ভাইরা রুম বন্ধ করে নেশা করবে আর ছোট ভাইদের বলবে তোমরা ভালো হয়ে চল। আর ছোট ভাইয়েরা বড় ভাইদের কথা মতো ভালো পথে চলবে এটা কল্পনা করাও বোকামি। হুজুরের বয়ান মাহফিলেই ভালো লাগে, রাজনীতির মাঠে একটু ডাইনে-বামে যাওয়া লাগে। রাজনীতি এখন সোজা পথে নাই, ডাইনে বামে মোড় নিয়েছে। ফলে, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, হত্যা, খুন কেন্দ্রীয় রাজনীতির চরিত্র ধারণ করে নীচের দিকেই ধাবিত হয়েছে।

ছাত্রদের দাবি অনুযায়ী বুয়েটে সাংগঠনিক রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, বুয়েট চাইলে রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলে নিজস্ব আইন দিয়ে। সে অনুযায়ী বুয়েট আনুষ্ঠানিক ছাত্ররাজনীতি বা সাংগঠনিক রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতেই পারে। সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়েরই নিজস্ব আইন রয়েছে। এগুলো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। চাইলে সব বিশ্ববিদ্যালয়ই ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করতে পারে। তবে, এটি শুধু বিশ্ববিদ্যালয় চাইলেই হবে না। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা লাগবে। রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্রদের আশ্রয়-প্রশ্রয় না দেওয়ার সংকল্প জরুরি।

আবরার হত্যার পর অনেকেই ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি জানিয়েছে। ছাত্ররাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর এখন অনেকেই আবার এর বিপক্ষে কথা বলছেন। অনেকেই এখন বলছেন, ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার ফলে ছাত্রদের অধিকার খর্ব করা হলো।

প্রশ্ন হলো, ছাত্ররাজনীতি ছাত্রদের কোন অধিকার রক্ষার জন্য বিরাট নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে? ছাত্ররাজনীতি থেকে ছাত্রদের কী প্রাপ্তি হয়েছে সেটি বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। রাজনীতি মানে যদি হয় ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, শিবির করা, ক্ষমতার পালাবদলে একে অন্যের রগ কাটা, চাপাতি দিয়ে কোপানো ও হত্যা করা তাহলে এ ছাত্ররাজনীতি নিয়ে কার কী অর্জন তা সহজেই অনুমেয়। শুধুমাত্র ক্ষমতার রাজনীতিতে ছাত্রদের ব্যবহারই ছাত্ররাজনীতির দৃশ্যমান প্রাপ্তি।

অনেকে এখন বলছে, ছাত্ররাজনীতি বন্ধ নয়, ছাত্ররাজনীতিকে শুদ্ধ করতে হবে। খুবই ভালো কথা। কিন্তু দেশের ক্ষয়িষ্ণু রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ছাত্ররাজনীতিকে কতটা শুদ্ধ করা সম্ভব?

আমরা জানি, দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতি নেই। সে জন্য কি তারা দেশপ্রেমিক নাগরিক হয়ে গড়ে উঠতে পারেনি? নাকি তারা নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে কম সচেতন? তারা রাজনীতি সচেতন নয়, সে কথা বলার সুযোগ নেই। আসলে ছাত্ররাজনীতি পক্ষে-বিপক্ষের আলোচনাটা অনেক ক্ষেত্রেই যতটা না যুক্তি নির্ভর তার চেয়ে বেশি আবেগ তাড়িত।

‍বুয়েট কাগজে কলমে ছাত্ররাজনীতি আপাতত বন্ধ করেছে বটে, কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ না হলে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের সুফল-কুফল কোনোটাই স্পষ্ট হবে না। তাই পরীক্ষামূলকভাবে হয়তো বুয়েটকে আমরা পর্যবেক্ষণ করতে পারি।

ছাত্ররাজনীতি বন্ধের বিপক্ষে যে যুক্তিগুলো দেয়া হয় তা ধোপে টেকে না। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ‘ভ্যাট’ আন্দোলনে তাদের অধিকার ঠিকই আদায় করে নিয়েছে। এমনকি নিরাপদ সড়ক আন্দোলনেও স্কুলের শিশুরা যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছে-যেখানে কোনো রাজনীতি নেই। এজন্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বা স্কুলে ছাত্ররাজনীতি চালু করতে হয়নি।

আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের মানুষ জন্মগতভাবেই রাজনীতি সচেতন। রাজনীতি শেখার জন্য তাদের স্কুল-কলেজে যেতে হয় না। এদেশের অধিকাংশ ছাত্রই ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, শিবির করেনি, কিন্তু তাই বলে একথা বলার সুযোগ নেই যে, এদেশের শিক্ষিত মানুষ (অতীতে যারা ছাত্ররাজনীতি করেনি) কম সচেতন বা রাজনৈতিক সচেতন নয়। বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধে দেশের ছাত্রসমাজের নেতৃত্ব অস্বীকার করা যায় না। একথা অবশ্যই সত্য। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে দেশের অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত কৃষক, রাখাল ও সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষদের অবদানকে আমরা যেন পাশ কাটিয়ে না যাই।

বলা হচ্ছে, ছাত্ররাজনীতি বন্ধ চেয়ে ছাত্ররা নাকি নিজেদের অধিকারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। যে ছাত্ররাজনীতি একজন সাধারণ ছাত্রের একটি নির্দোষ মত ও বাক স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিতে পারে না, সেই ছাত্ররাজনীতি কার অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলে?

তবে শুধু ছাত্ররাজনীতি নয়, বন্ধ করতে হবে শিক্ষক রাজনীতিও। শিক্ষকদের লেজুড়বৃত্তি আজ চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে। আসলে রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস জরুরি। সেটা খুব কঠিন কাজ। তবে ধীরে ধীরে কাজটি শুরু করতে হবে।

 

এরশাদুল আলম প্রিন্স:কন্ট্রিবিউটিং এডিটর

এ সম্পর্কিত আরও খবর