এটি মোটেই তামাশার বিষয় নয়

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

মোকাম্মেল হোসেন | 2023-09-01 07:44:50

শরীরে ডায়াবেটিস ঘাঁটি গেড়ে বসার পর ভোরে হাঁটাহাঁটি করা টুনু মিয়ার জীবন খাতার প্রতি পাতায় এক নম্বর সিরিয়াল দখল করেছে। সিরিয়াল অনুযায়ী প্রতিদিনের মতো আজও হাঁটতে বের হয়েছেন টুনু মিয়া। শরতের স্নিগ্ধ সকাল; ভোরের হাওয়া গায়ে মেখে রাস্তার এক পাশ দিয়ে হাঁটছিলেন টুনু মিয়া। মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া একটা পাখির দিকে নজর পড়তেই মুগ্ধ হওয়ার চেষ্টা করলেন তিনি। আচানক তার মুগ্ধতা তিরোহিত হলো। টুনু মিয়া ভাবলেন, বজ্জাত পাখির কাণ্ড এটা। পাখিটা উক্ত বায়ুমণ্ডলে পিচ করে বিষ্ঠা ত্যাগ করে এভাবেই তার মুগ্ধতার প্রতিদান দিয়েছে!

পরে বুকের বামপাশে ফতুয়ার অনেকটা জায়গাজুড়ে লেপ্টে থাকা পদার্থটার দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন, বস্তুটি বিহঙ্গ-বিষ্ঠা নয়। তখন তার নজর গেল সামনের দিকে। দেখলেন, এক লোক থতমত খেয়ে তাকিয়ে আছেন। গম্ভীর কণ্ঠে টুনু মিয়া তাকে বললেন-
: আপনে এইটা কী করলেন!
লোকটা কাচুমাচু হয়ে দু’হাত জোড় করে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বললেন-
: ভুল হইয়া গেছে; বুঝতে পারি নাই।

অনেক কসরত করে নোংরার ছোঁয়া থেকে মুখ-চোখ বাঁচিয়ে টুনু মিয়া গায়ের ফতুয়া খুললেন। ফতুয়াটা ছুঁড়ে ফেলতে পারলে অতি উত্তম হতো। ফেলে দেয়া যাচ্ছে না। নতুন ফতুয়া। একটা ফাজিল লোকের জন্য এতগুলো টাকা ড্রেনে ফেলার কোনো মানে হয় না। মরা ইঁদুরের লেজ ধরার মতো ফতুয়ার কোণা চিমটি দিয়ে ধরে উত্তেজিত কণ্ঠে টুনু মিয়া বললেন-
: বুঝতে পারেন নাই- এই কথাটার মানে কী! থুতু নিক্ষেপ করার পর সেইটা ওপরের দিকে উইঠা যায়, না নিচে পড়ে?
: নিচে পড়ে।
: তাইলে বুঝতে পারি নাই বলছেন কেন?

কোনো কথা না বলে লোকটা নিরীহ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ কটমট করে লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকার পর একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে টুনু মিয়া বাসার দিকে রওনা হলেন। উদাম শরীরে স্বামীকে বাসায় ফিরতে দেখে নূরজারা অবাক হয়ে বললেন-
: আপনের এই বেশ কেন!
: আর কইও না, একটা ফাজিল লোক...

টুনু মিয়া গোসলখানায় ঢুকতে ঢুকতে ঘটনার বর্ণনা দিলেন। নূরজারা হৈ হৈ করে উঠলেন। বললেন-
: জগতে আর মানুষ নাই? বাইছা বাইছা খালি আপনের ঠ্যাংই গর্তে পড়ে; আপনের গায়েই থুতু পড়ে!

টুনু মিয়া কথা বাড়ালেন না। নারী জাতির সঙ্গে তর্ক করা বৃথা। এদের মস্তিষ্কে যে তর্ককোষ আছে, সেটি প্রতিপক্ষের কোনো প্রকার যুক্তি বিবেচনায় নিতে অক্ষম। কাজেই কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তিনি বাঙালির থুতু ফেলার বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে লাগলেন।

যখন-তখন যেখানে সেখানে থুতু ফেলা শুধুমাত্র অপরিচ্ছন্নতা বা দেখতে নোংরা লাগার বিষয় নয়; এর বড় বিপদ হচ্ছে রোগ-বালাইয়ের সংক্রমণ। বাংলাদেশে বায়ুবাহিত রোগের একটি বড় কারণ হচ্ছে যেখানে সেখানে থুতু এবং কফ ফেলা; যার মধ্যে যক্ষ্মা অন্যতম।

এছাড়া যারা ভাইরাসজনিত রোগে ভুগছেন, তাদের থুতু ও শ্লেষ্মার সঙ্গে সেটি বেরিয়ে আসার পর সরাসরি সংস্পর্শে বা বাতাসের মাধ্যমে ছড়াতে পারে।

টুনু মিয়ার মনে হলো, বিষয়টি নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিত। দেশে কত আলতু-ফালতু বিষয় নিয়ে গবেষণা হচ্ছে; অথচ এ রকম একটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় গবেষকরা গবেষণার আওতায় নিচ্ছেন না- ভারি আশ্চর্ষজনক কথা! গোসলখানা থেকে বের হয়েই টুনু মিয়া তার এক গবেষক বন্ধুকে ফোন করলেন-
: হ্যালো হবিবর...
হবিবর ঘুমাচ্ছিলেন। টুনু মিয়ার বক্তব্য শোনার পর তিনি মহাবিরক্ত হলেন। এ কথা বলার জন্য এত সকালে কোনো ভদ্রলোক কাউকে ফোন করেণ? ঘুম জড়ানো গলায় ফিসফাস করে সে বললেন-
: বাঙালি কী জন্য যেখানে সেখানে থুতু নিক্ষেপ করে, এই কথা আমি কেমনে বলব? তারা কী আমার কাছে জিজ্ঞাসা কইরা এই কাজ করে?

টুনু মিয়া ফোনের লাইন কেটে দিয়ে নূরজারাকে একই প্রশ্ন করলেন। নূরজারা অবাক হয়ে বললেন-
: এইটা কী রকম প্রশ্ন!
: অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। চিন্তাভাবনা কইরা উত্তর দেও।

নূরজারা চিন্তা-ভাবনার ধারে কাছেও গেলেন না; বরং ফিকফিক করে হেসে তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেন-
: থুতু কী মুখে লইয়া ঘুইরা বেড়ানোর জিনিস?
: মুখে লইয়া তোমারে ঘুরতে বলছে কে? গিইলা ফেলবা।

থুতু গিলে ফেলার কথা শুনে নূরজারা হাতের তালু দিয়ে নাক-মুখ চেপে ধরে এমনভাবে অক-অক করে উঠলেন, টুনু মিয়ার মনে হলো- এক্ষুণি তিনি বমি করে ফেলবেন। অনেক কষ্টে রাগ দমন করে নূরজারাকে টুনু মিয়া বললেন-
: তুমি হইলা আরেক চিড়িয়া!

স্বামীর প্রতিক্রিয়া দেখে নূরজারা খুব মজা পেলেন। এ মজায় বাড়তি রঙ লাগানোর জন্য তিনি হা করে স্বামীর দিকে এগিয়ে এসে বমি করার ভান করতেই টুনু মিয়া বাউলি কেটে ছেলের কক্ষে ঢুকে পড়লেন। টুনু মিয়ার একমাত্র ছেলে লিমাজ উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছিল। তার মাথার একপাশে খোলা ল্যাপটপ কাত হয়ে পড়ে আছে। টুনু মিয়া ল্যাপটপ সোজা করে ছেলেকে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন। লিমাজ চোখ কচলে বাবার দিকে তাকাতেই টুনু মিয়া তাকে জিজ্ঞেস করলেন-
: লিমাজ মিয়া, এই দেশের মানুষ কী জন্য যেখানে সেখানে থুথু নিক্ষেপ করে; বলতে পারবা?

টুনু মিয়ার কথা শুনে লিমাজের ঝিমানি ভাব কেটে গেল। ভোরবেলা ঘুম থেকে ডেকে তুলে এসব কী ধরনের প্রশ্ন? চোখের পাতা বন্ধ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিতে দিতে সে বলল-
: বাবা, এক কাজ কর।
: কী?
: তুমি একটা থুতু উৎসবের আয়োজন করো। সেই উৎসবে যেসব থুতু নিক্ষেপকারীর আগমন ঘটবে, তাদের কাছ থেকে জেনে নেয়া যাবে- কেন তারা এই কর্মটি করে; হোয়াই দ্য পিপলস থ্রো দেয়ার কফ...

ছেলের বয়ান শুনে টুনু মিয়া ফোঁস করে দম ছাড়লেন। এই জেনারেশনের পোলাপানের এই এক ফ্যাশন। তারা সবকিছু নিয়েই তামাশা করে। এটা মোটেই তামাশার বিষয় নয়।

টুনু মিয়া ফোন হাতে নিয়ে নাস্তা করতে বসলেন। প্রথমেই ফোন করলেন তার এক ডাক্তার আত্মীয়কে। ডাক্তার সাহেব কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন-
: পেটে ক্রিমি থাকলে থুতুর ভাব হতে পারে। তাছাড়া গ্যাস্ট্রিক-আলসার...

এরপর টুনু মিয়া ফোন করলেন তার বাল্যবন্ধু ইমারত সাহেবকে। ইমারত সাহেব ফুর্তিমাখা গলায় বললেন-
: লোকজন তো কেবল হালকার উপর পাতলা থুতু ছুঁইড়া মারে। ঢাকা শহরের মতো নোংরা, দুর্গন্ধযুক্ত পরিবেশে লোকজন যে বমি করতে করতে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করে না; তাতে তাদের অসীম ধৈর্যের পরিচয় পাওয়া যায়।

টুনু মিয়া এরপর যাকে ফোন করলেন, তিনি একজন প্রগতিশীল বিপ্লবমনস্ক মানুষ। টুনু মিয়ার প্রশ্নের উত্তরে উত্তেজিত গলায় তিনি বললেন-
: পেটে ক্ষুধা থাকলে মুখে থুতুর আবির্ভাব ঘটে। ক্ষুধার্ত, সর্বহারা শ্রেণী তাদের থুতু উগড়ে দিয়ে এদেশের বুর্জোয়া ও ধনিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে ঘৃণার উদগিরণ ঘটাচ্ছে। থুতু নিক্ষেপের ঘটনা যত বাড়তে থাকবে; বুঝবেন, এই দেশে বিপ্লব সফল হওয়ার পরিবেশ ততই ঘনাইয়া আসছে। তখন জাস্ট একটা ঝাঁকি। দেখবেন, সব কাইত হইয়া পড়ছে...

কাইত হয়ে পড়ুক অথবা চিৎ হয়ে পড়ুক- বিপ্লব বিষয়ে টুনু মিয়ার আগ্রহ না থাকায় কথা বেশি দূর অগ্রসর হলো না।

পরদিন প্রত্যুষে হাঁটাবন্ধুদের আসরে টুনু মিয়া বিষয়টির অবতারণা করতেই একজন বললেন-
: এর মধ্যে আমি কোনো অস্বাভাবিকতা দেখতেছি না। শিক্ষা-দীক্ষা, উন্নত রীতি-নীতি ও মূল্যবোধ সম্পন্ন জাতি না হইলে এই রকম হওয়াটাই স্বাভাবিক।

পাশ থেকে একজন এ কথার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বললেন-
: আপনের এই বক্তব্য আমি মানতে পারলাম না ভাই সাহেব। সিঙ্গাপুরকে এক সময় জেলেদের গ্রাম বলা হতো। সিঙ্গাপুরীদের শরীরে মাছের আইশটার গন্ধে তাদের ধারে কাছে যাওয়া যাইত না। আর আজ দেখেন, ওদের শহরের রাস্তায় ময়লা-আবর্জনা তো দূরের কথা; টর্চলাইট দিয়া খুঁজলেও এক টুকরা কাগজ পাওয়া যাবে না।

তর্ক জমে উঠল। দলের সবচেয়ে বয়ষ্ক ব্যক্তি আওলাদ সাহেব বললেন-
: সিঙ্গাপুরের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা দিলে চলবে? ওরা উপযুক্ত নেতা পাইছে, তাই এই ধরনের পরিবর্তন সম্ভব হইছে। নেতৃত্বের গুণে ওরা দিন দিন আধুনিক হইতেছে আর আমরা বর্বর হইতেছি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, মন্দির-মসজিদ-মাদরাসা ও হাট-বাজার থেইকা শুরু কইরা এমন কোনো জায়গা নাই, যেখানে আমাদের বর্বরতার ছাপ পড়তেছে না। পরিবারে মা-বাবার আদর্শে যেমন সন্তানরা গড়ে ওঠে, তেমনি নেতৃত্বের গুণ অনুযায়ী দেশ ও জাতি গড়ে ওঠে। সোনার বাংলাদেশে নেতার আসনে অধিষ্ঠিতদের আদর্শ, কথাবার্তা, চালচলন, আচার-আচরণ, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ যেমন, এই জাতির আচরণ ও নৈতিকতাও তেমন হবে- এটাই তো স্বাভাবিক; তাই না?

মোকাম্মেল হোসেন: রম্য লেখক ও সাংবাদিক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর