ছাত্রলীগ এবং উপাচার্য সমাচার

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ফরিদুল আলম | 2023-08-25 06:33:50

২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের লাগাম যেন কোনোভাবেই টেনে ধরা যাচ্ছিল না। একদিকে প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বগুণে দেশের ঈর্শ্বনীয় উন্নয়ন আর এর বিপরীতে ছাত্রলীগের দোর্দণ্ড প্রতাপে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অস্থিরতা, সার্বিক বিচারে আমাদের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে দিনে দিনে গভীর সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

বিভিন্ন সময়ে তাদের লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করা হলেও সরকার বা দলের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা ব্যর্থ হয়েছেন। আমরা আজকাল প্রায়ই দেখি, অনেক সামান্য বিষয়েও খোদ প্রধানমন্ত্রীকে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য হস্তক্ষেপ করতে হয়। সম্প্রতি ছাত্রলীগের বেশ কিছু বিতর্কিত কর্মকাণ্ডেও অবশেষে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হলো।

গত দশ বছরের বেশি সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যত অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে এর প্রায় সবগুলোই ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফলশ্রুতি। আগে এইসব অস্থিরতার জন্য প্রতিপক্ষের ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যকার বিরোধ মূল চালক হিসেবে কাজ করলেও দিনের পর দিন ছাত্রলীগের একক আধিপত্য জোরদার হওয়ার ফলে ক্যাম্পাসগুলোতে এখন প্রতিপক্ষ সেরকমভাবে সক্রিয় নেই বললেই চলে। ফলে সৃষ্টি হয়েছে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, হল দখল ইত্যাকার ঘটনা। কথিত আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে উপাচার্য কারা হবেন এইসব বিষয়েও ছাত্রলীগের চূড়ান্ত সবুজ সংকেত ব্যতীত কার্য সম্পাদন কঠিন হয়ে পড়ে দায়িত্বশীলদের জন্য। আমার মনে আছে, আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত আছি সেখানকার একজন উপাচার্য নিয়োগ পাওয়ার পর তার সম্মানে আয়োজিত এক সম্বর্ধনায় কৃতজ্ঞচিত্তে তার নিয়োগে অন্য অনেকের সাথে ছাত্রলীগের সমর্থনের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেছিলেন।

এখন কথা হচ্ছে, এমন গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর বিষয়গুলোতে যখন ছাত্রলীগ ভূমিকা পালন করে থাকে, যা সরকারের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত, তখন সরকার শত করে চাইলেও কি ছাত্রলীগের এইসব কর্মকে (অপকর্ম) বন্ধ করতে পারবে? এক্ষেত্রে সরকারের দিক থেকে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা প্রয়োজন। তাদের কর্মকাণ্ড আজকাল কেবল ক্যাম্পাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। নিজ নিজ পরিচয় দিয়ে সব ক্ষেত্রে সুবিধা আদায় করে কার্যত তারা সরকারের ভাবমূর্তিকেই ক্ষুণ্ণ করছে। সরকারের ভেতর যদি এই বোধের উদয় ঘটে তবে উপলব্ধিটা এমন হওয়া উচিৎ যে ‘দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল অনেক ভাল।’

গত ১৪ সেপ্টেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হলো। যে কাজটি এতদিন ধরে দল এবং সরকারের ভেতর দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা পারেননি, অর্থাৎ তাদের লাগামহীন দাপটের লাগাম টেনে ধরতে পারেননি, সে কাজে হাত দিতে হলো প্রধানমন্ত্রীকে।

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদককে নিজ নিজ দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য নতুন দুজনকে এই দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। নতুন যারা সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন এটা তাদের জন্য এই মর্মে একটা বার্তা যে তাদের সকল কর্মকাণ্ড এখন থেকে প্রধানমন্ত্রী গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন। তাদের জন্য সম্ভবত প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে এটাও একটা বার্তা যে ছাত্রলীগ সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে তার হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনুক।

সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে সরকার এবং আওয়ামী লীগ প্রধানের কঠোর অবস্থানের নেপথ্যে রয়েছে মূলত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের নামে অর্থ বাটোয়ারার বিষয়টি। এই ঘটনা থেকে দুটি বিষয় আমাদের মধ্যে গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। এর একটি হচ্ছে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে সরকারের তরফ থেকে ১ হাজার ৪শ কোটি টাকারও অধিক উন্নয়ন প্রকল্পের প্রথম ধাপের ৪ শতাধিক কোটি টাকার মধ্য থেকে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দকে দেয়া হয়েছে, আর এই লেনদেন প্রক্রিয়া সম্পাদিত হয়েছে উপাচার্যের স্বামী এবং ছেলের হাত ধরে। ঘটনার পর কেন্দ্রীয় সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক উপাচার্যের সাথে সাক্ষাত করে নিজেদের অংশ (৪ থেকে ৬ শতাংশ) দাবি করেন বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। উপাচার্য তাদের দাবির সাথে একমত না হওয়াতে শুরু হয় পরস্পর বিরোধ, আর এই বিরোধের বলি হতে হলো তাদের দুজনকে।

দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে নিয়ে যে ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে এবং সাম্প্রতিক সময়ের উন্নয়নের নামে টাকা ভাগাভাগির যে বিষয়গুলো উচ্চারিত হচ্ছে এগুলোকে কেবল গুজব বলে উড়িয়ে দেওয়ার অবকাশ নেই।

কেবল ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে উপাচার্যকে দায়মুক্তি দেয়ার কোনো অবকাশ নেই। এ ধরনের ঘটনা গত কয়েক বছর ধরেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আকাশে বাতাসে উচ্চারিত হচ্ছিল যে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিষয়ে তার পরিবারের সদস্যদের সম্পৃক্ত করেছেন এবং তারা অনৈতিকভাবে অনেক সুবিধা নিচ্ছেন। যেহেতু বিষয়গুলো সামনে চলে এসেছে তাই এসব মীমাংসার জন্য সরকারের উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত প্রয়োজন এবং ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেলে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণও সময়ের দাবি। যে কোনোভাবে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে যদি আমরা কলুষমুক্ত রাখতে না পারি তবে সরকারের সকল ইতিবাচক অর্জনই ম্লান হয়ে যাবে।

ছাত্রলীগ নিয়ে সিদ্ধান্ত অবশ্য একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। বলা যায়, পাপের পাল্লা অনেক বেশি ভারী হয়ে গিয়েছিল বলে তাদের এমন অপমানজনক পরিণতি ঘটল। এর আগেও কথিত রয়েছে যে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অর্থের বিনিময়ে কমিটি গঠন, কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে পাল্টা কমিটি গঠন করে আবারও পুরাতন কমিটিকে বহাল করার বিনিময়ে অর্থ দাবি, মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ দেয়া এমনকি অছাত্রদের পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত করা ইত্যাদি বিষয়গুলো দীর্ঘদিন ধরে চলে আসলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ার ফলে দিনে দিনে আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠছিলেন তারা। তাদের অব্যাহতির পর মুখ খুলেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক। তারা জানিয়েছেন, এই দুজন তাদের কমিটি পূণর্বহালের নামে অর্থ দাবি করেছিলেন। এভাবে ছাত্রলীগকে তারা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিলেন, যা থেকে সংগঠনকে সহসা বের করে আনা সম্ভব হলেও কাজটি খুব সহজ নয়।


ফরিদুল আলম: সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর