তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

প্রভাষ আমিন | 2023-08-28 03:59:51

ছাত্রলীগের দুই তারকার পতন ঘটেছে। শোভন-রাব্বানীর বিরুদ্ধে অনেকগুলো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এসেছে। অভিযোগগুলো প্রমাণিত নয়। অনেকেই বলছেন, তারা ষড়যন্ত্রের শিকার। তবে অভিযোগগুলো এতই সুনির্দিষ্ট যে উপেক্ষা করা যায়নি। দেরিতে ঘুম থেকে ওঠা, সিনিয়র নেতাদের বসিয়ে রাখা, মাদকাসক্তি, পয়সা নিয়ে কমিটি করা ইত্যাদি অভিযোগগুলো কিছুটা ঢালাও। তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে থেকে চাঁদা দাবির সুনির্দিষ্ট ঘটনাটিই তাদের পতনের মূল কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. ফারজানা ইসলাম এবং ছাত্রলীগের পদচ্যুত সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী পরস্পরের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এনেছেন, তা গুরুতর। নিছক পদচ্যুতিতে এ গুরুতর অপরাধের নিষ্পত্তি হবে না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। তার প্রথম পর্বের কাজ থেকে ছাত্রলীগকে দুই কোটি দেয়া হয়েছে। উপাচার্যের বাসভবনে তার স্বামী ও ছেলের উপস্থিতিতে এই লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে। গণমাধ্যমে এমন খবর প্রকাশের পর তোলপাড় সৃষ্টি হয়। আরও নানা ইস্যুতে আন্দোলনে উত্তাল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। এর মধ্যেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ আনলে পাল্টে যায় পরিস্থিতি।

অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক সম্পর্কে গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমরা ৩০ মিনিটের মতো কথা বলেছি। বৈঠকে ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন এবং সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে নিয়ে কথা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন- তারা (শোভন-রাব্বানী) তোমাকেও ঝামেলায় ফেলেছে!’ এরপর ছাত্রলীগ নেতৃত্বের ওপর ক্ষুব্ধ হন প্রধানমন্ত্রী। যার ফলশ্রুতিতে পদ হারাতে হয়েছে ছাত্রলীগ নেতৃত্বকে।

অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘ছাত্রলীগের দুই শীর্ষ নেতা গত ৮ আগস্ট তার বাসভবনে এসে চাঁদা দাবি করেছিলেন। নির্মাণ কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে টাকা তুলে দিতে তারা আমাকে চাপ দেয়। প্রত্যাখ্যান করলে তারা আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহারও করে। এক পর্যায়ে রাব্বানী বলে যে, এখনকার দিনে ১-২ শতাংশের আলাপ কোথাও নেই। ৪-৬ শতাংশ ছাড়া কি হয়?...এটি একটি বড় প্রকল্প। আপনি আমাদের সহায়তা করলে, আমরাও আপনাকে সহযোগিতা করবো।‘ তিনি আরও বলেন, ‘আমি তাদেরকে বললাম যে, আমি তবে ভবন বানাবো কী দিয়ে, এসব কথা আমার সামনে আর বলবা না..আমি যখন তাদের চাপে নতি স্বীকার করতে অপারগতা প্রকাশ করলাম, তখন তারা আমার দিকে চেঁচিয়ে উঠলো এবং চলে গেলো।' এর আগে ছাত্রলীগের দুই শীর্ষ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি থাকার সময়ও ছাত্রলীগ নেতারা গিয়ে তাকে চাপ দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।

আর ছাত্রলীগের পদচ্যুত সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‌'আমি এবং শোভন উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করি এবং বলি- ম্যাম, আপনি তাদের টাকা দিয়েছেন। তাহলে আমাদের ন্যায্য পাওনা কই? আমাদের ঈদ বোনাস কই?’ তিনি আরও বলেন, ‘জাবি প্রশাসন আমাদের কোনো টাকা না দিলেও, আমাদের নেতৃত্বের নীচে যারা রয়েছে তাদেরকে টাকা দিয়েছে। এ বিষয়ে উপাচার্য কী বলবেন? তারা আমাদের কিছুই দেয়নি। তারা জাবি ছাত্রলীগকে টাকা দিয়েছে।'

প্রধানমন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করার পর ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে একটি চিঠি লিখে তারা। ছাত্রলীগের প্যাডে গোলাম রাব্বানী স্বাক্ষরিত চিঠিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের অভিযোগ সম্পর্কে বলা হয়, 'জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে অভিযোগ আপনার কাছে ভিন্নভাবে উত্থাপন করা হয়েছে। উপাচার্য ম্যামের স্বামী ও ছেলে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগকে ব্যবহার করে কাজের ডিলিংস করে মোটা অঙ্কের কমিশন বাণিজ্য করেছেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে ঈদুল আজহার পূর্বে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগকে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা দেওয়া হয়। এ খবর জানাজানি হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি শুরু হয় এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে উপাচার্য ম্যাম আমাদের স্মরণ করেন। আমরা দেখা করে আমাদের অজ্ঞাতসারে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগকে টাকা দেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন তোলায় তিনি বিব্রতবোধ করেন। নেত্রী, ওই পরিস্থিতিতে আমরা কিছু কথা বলি, যা সমীচীন হয়নি। এজন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।' এই চিঠিতে বেশ কয়েকটি গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগকে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা চাঁদা দিয়েছেন। উপাচার্যের স্বামী ও সন্তানের বিরুদ্ধেও ছাত্রলীগকে ব্যবহার করা এবং কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ এনেছেন।

তবে উপাচার্য ফারজানা ইসলাম এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ গোলাম রাব্বানীর অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। উপাচার্য টাকা-পয়সা লেনদেনের বিষয়টি অস্বীকার করে পাল্টা চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন। তার দাবি ছাত্রলীগ তার বিরুদ্ধে গল্প ফেঁদেছে। উপাচার্য সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘উপাচার্য বলেন, ‘অর্থ লেনদেনের বিষয়টি বানোয়াট গল্প। টাকা-পয়সা নিয়ে তাদের সঙ্গে আমার কোনো কথা হয়নি। তারা তাদের মতো করে কাজ করে। তারা কার কাছে কমিশন পায় বা পায় না, তা আমি জানি না। এ বিষয়ে তারা আমাকে ইঙ্গিত দিলে আমি বলি, তোমরা টাকা-পয়সা নিয়ে কোনো আলাপ আমার সঙ্গে করবে না। তোমরা যা চাও, তা তোমাদের মতো করো।’ তিনি পুরো ঘটনা তদন্ত করে দেখার জন্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও আচার্যকে অনুরোধ করবেন বলেও সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।

উপাচার্যের এই চাওয়ার সঙ্গে আমিও একমত। ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের এই বাহাসই জাতির জন্য লজ্জাজনক। তবে দুই পক্ষের অভিযোগ শুনে মনে হচ্ছে, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। উপাচার্য ফারজানা ইসলাম করুন বা ছাত্রলীগের পদচ্যুত নেতা শোভন-রাব্বানী করুক; জাহাঙ্গীরনগরের ঘটনায় গুরুতর অপরাধ ঘটেছে। এই অপরাধের সাজা নিছক পদচ্যুতি নয়। ঘুষ চাওয়া যেমন অপরাধ, ঘুষ নেয়া অপরাধ, ঘুষ দেয়াও অপরাধ। তাই দুদকের পরিচালককে ঘুষ দেয়ার অভিযোগ কিন্তু পুলিশের ডিআইজি মিজান কিন্তু এখন কারাগারে। নিছক আচার্য বা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তদন্ত এই অপরাধের জন্য যথেষ্ট নয়। দুর্নীতি দমন কমিশন বা পুলিশি তদন্ত করা হোক। যে বা যারা সত্যিকারের অপরাধী, তাদের খুঁজে বের করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হোক। অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে; তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে…।

প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

এ সম্পর্কিত আরও খবর