চোরের লাঠি দেশের বোঝা

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

এরশাদুল আলম প্রিন্স | 2023-09-01 19:34:32

দেশে দুর্নীতি ও লুটপাট নতুন কিছু নয়। আগেও ছিল, এখনও আছে। কার আমলে বেশি, কার আমলে কম, সেটি নিয়ে রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক হতে পারে।

এ জাতীয় রাজনৈতিক বিতর্কে কখনও দুর্নীতির রাশ টেনে ধরা যায়নি, সমস্যারও কোনো সমাধান হয়নি। লাভবান হয়েছে দুর্নীতিবাজরা। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশ, দেশের জনগণ। বদনাম হয়েছে সরকারের।

আমরা জানি, দেশের টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা জানি না, কারা এই পাচারকারী। কারা এই লুটপাটের বরপুত্র। বঙ্গবন্ধুকন্যা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। অনেক ক্লিন ইমেজের নেতা এখন মন্ত্রিসভায়। প্রধানমন্ত্রী সব সময়ই মন্ত্রী ও এমপি সাহেবদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেন। ভালো কাজ করলে পরবর্তী সংসদ বা মন্ত্রিসভায় সুযোগ হয়, না হলে ছিটকে পড়েন। আগের দুই সরকারেরর অনেক উচ্চরব-মন্ত্রীদের আজ আর দেখাও যায় না। অনেককেই এমন দেখেছি, গত সরকারের আমলে যারা বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তুলতেন, গণমাধ্যমে, বিভিন্ন সভা-সমিতিতে তারা বক্তব্য-বিবৃতির ঝড় তুলতেন, কিন্তু এসব নেতারা নিজেদের কাজ করার চেয়ে বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীদের গালাগালের দিকেই বেশি যত্নবান ছিলেন। ভেবেছিলেন, এতেই বুঝি নেত্রী খুশি। কিন্তু আখেরে তাদের অনেকেই সংসদে আর ঢুকতে পারেননি। মন্ত্রী হওয়া তো পরের কথা।

দুর্নীতি নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। চারদিকে বড় বড় দুর্নীতির খবর। ছোটো খাটো দুর্নীতি নিয়ে কথা বলা সময় সুযোগ এখন নেই বললেই চলে। দেশে উন্নয়ন হচ্ছে সন্দেহ নেই। উন্নয়ন সময়ের দাবি। ভাবতে ভালো লাগে, দেশ এতোটাই উন্নত হচ্ছে যে এখানে একটি মেডিকেল কলেজে ৩৭ লাখ টাকার পর্দা কেনা হয়! সাড়ে পাঁচ হাজার টাকার বই কেনা হয় ৮৫ হাজার ৫০০ টাকায়। একে হরিলুট বললেও কম বলা হয়।

আগের দিনে রাজ প্রাসাদে, রঙমহলে দামি পর্দা ও রাজা-মহারাজাদের আরাম আয়েশের জন্য দামি রেশমি-পশমি বালিশের ব্যবস্থা থাকত। সেখানে হেলান দিয়ে রাজা-মহারাজারা দাসি-বাদিদের নিয়ে সুরা পান ও ফূর্তি করে সময় কাটাতেন। সেই বাদশাহী দিন গত হয়েছে বহু আগেই। কিন্তু পুরান পর্দা ও বালিশ নতুন করে ফিরে এসেছে এই বঙ্গভূমিতে। আমরা আরাম করতে পছন্দ করি। ভোগ-বিলাস আমাদের বাপ-দাদাদের পরম্পরা। হালাল-হারাম বড় কথা না, আয়-রোজগার ঠিক না থাকলে মাথা ঠিক থাকে না। তাই, উন্নয়নের জোয়ারে দেশে আজ শাহী হাসপাতাল ও রাজকীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হচ্ছে।

এই দেশে এক দিন মাৎস্যন্যায় ছিল। বড় মাছ ছোটো মাছকে গিলে খেত। দেশের জমিদার পেয়াদারাও গরিব প্রজা ও চাষাভুষাদের সেভাবেই দেখতেন। এখন বৃটিশরাজা নেই, নেই জমিদার, পাইক, পেয়াদা। কিন্তু রুই-কাতলা এখনও পুটি মাছ খায়। এই রুই-কাতলারা দেশের খাস লোক। তাই তারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আমাদের মতো আম-পুটি প্রজাদেরই যতো সমস্যা। দুর্নীতির রুই-কাতলারা এখনও ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আমাদের দুদক রুই-কাতলা ধরতে পারেনি। মাঝে মাঝে দুদক কার্যালয়ে হয়তো কারো কারো হাজিরার ব্যবস্থা করতে পেরেছে। পারবে কী করে? দুদক অফিসেরই কিছু কর্মকর্তার দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে এসেছে। সর্ষের ভেতর ভূত থাকলে, ভূত তাড়াবে কে?

বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির এক লাখ ৪৩ হাজার টন কয়লা সরকারি তদন্ত প্রতিবেদন মোতাবেক হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে বা সিস্টেম লস হয়েছে। এভাবে আমাদের অনেক দুর্নীতিই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। সরকার এই সর্বব্যাপী দুর্নীতি রোধ করবে কী করে? বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘দেশ স্বাধীন করলে সবাই পায় সোনার খনি আর আমি পেয়েছি চোরের খনি! আমার ডানে চোর, বাঁয়ে চোর, সামনে চোর, পিছনে চোর, চোর আর চোর!’ সব খনি ও খনির সম্পদ হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেও বঙ্গবন্ধুর কথিত সেই চোরের খনি আজও হাওয়ায় মিলিয়ে যায়নি। সেই চোরের খনি সাফ করাই আজ বঙ্গবন্ধুকন্যার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। কিন্তু সরকারি বেসরকারি দুর্নীতি রোধ করা যাচ্ছে না। চারদিকে খরচের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। সরকারি খরচ সামাল দিতে সরকার হিমশিম খাচ্ছে। আয়ের খাত বাড়াতে গিয়ে জনগণের ওপর ট্যাক্সের বোঝা বড় হচ্ছে, ওদিকে ব্যয়ের খাতও বাড়ছে, বড় হচ্ছে। দেশ নাকি তীব্র অর্থ সংকটে ভুগছে। অর্থনীতিবিদরা সেরকমই বলছেন।

রাজ কর্মচারীদের খুশি করতে সরকার তাদের বেতন বাড়িয়েছে। গত ১০ বছরে সরকার সবচেয়ে বেশি বাড়িয়েছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা। বাজেটের ২৮ শতাংশই নাকি খরচ হয় বেতন, ভাতা ও পেনশন দিতে। কিন্তু রাজ কর্মচারীদের উৎকোচ প্রবণতা কমেছে কি? স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলছেন, ‘তাহলে বেতন বাড়িয়ে লাভ কী?’ চরিত্র একবার নষ্ট হলে তা পুনরুদ্ধার বড় কঠিন কাজ।

দেশে সোনাদানার দাম পর্দা-বালিশের দামকে ছুঁইছুঁই করছে। আমাদের দেশে চোর ও চুরিবিদ্যা নিয়ে অনেক প্রবাদ আছে। সেগুলো রীতিমতো জনপ্রিয় ও চর্চিত। কিন্তু তারপরও শেষ কথা হলো, চুরি ও দুর্নীতি বন্ধ করতেই হবে। তা না হলে সরকারের অনেক অর্জনই চাপা পড়ে যাবে দুর্নীতির বদনামে। উন্নয়নের পাশাপাশি দুর্নীতি বন্ধে সরকারের জোরদার ভূমিকা সময়ের দাবি। ঘরে চোর ঢুকলে চোরের ঠ্যাং টেনে ধরতে হয়। ঠ্যাং-এর বদলে চোরের লাঠি টেনে ধরলে লাভ নাই। এতে চোর লাঠি রেখে পালায়। আর গৃহস্তের সর্বনাশ। ঘরের চোর ধরতে আজ চোরের ঠ্যাং টেনে ধরতে হবে, লাঠি নয়। না হলে, লাঠি ফেরত নিতে গিয়ে আবার চুরি করবে। উপর্যুপরি এই চৌর্যবৃত্তি গৃহস্তের মহা সর্বনাশের কারণ। এই দুর্নীতি ও চৌর্যবৃত্তি থেকে রাষ্ট্রকে বাঁচাতে হবে।


লেখক: এরশাদুল আলম প্রিন্স, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম।

এ সম্পর্কিত আরও খবর