একটি গতানুগতিক জি-৭ সম্মেলন

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ফরিদুল আলম | 2023-08-31 19:23:54

গত ২৪-২৬ আগস্ট ফ্রান্সের সাগরঘেঁষা শহর বিয়ারিটজে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোর ৪৫তম শীর্ষ বৈঠক। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান ও যুক্তরাজ্যের সমন্বয়ে গঠিত এই ফোরামের বৈঠক মানেই বিশ্ব রাজনীতিতে নিকট ভবিষ্যতে কী ঘটতে চলছে সে সম্পর্কে এক ধরণের আগাম আভাস পাওয়া। এবারের সম্মেলনের সবচেয়ে বড় চমক ছিল সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে আকস্মিকভাবে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফের সম্মেলনস্থলে উপস্থিত হওয়া।

যদিও মার্কিন কর্মকর্তারা এতে নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেছেন, তবে ধারণা করা যায় যে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমান্যুয়েল ম্যাখোর মধ্যস্থতায় সাম্প্রতিক সময়ে ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে তা প্রশমনের চেষ্টা করা হচ্ছে। ২০১৫ সালে ইরানের সাথে ৬ জাতির যে পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র গত বছর অনেকটা আকস্মিকভাবে এই চুক্তি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়ার পর থেকে উপসাগরীয় অঞ্চলে যে উত্তেজনা বর্তমান সময়ে বিরাজ করছে তার দায়ভার চুক্তি স্বাক্ষরকারী অপর ৫ শক্তির কেউই নিতে চায় না। তারা সবাই এই চুক্তি বহাল রাখার পক্ষে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাজ্যের একটি তেলের ট্যাংকার উপসাগরীয় অঞ্চলে জব্দ করা নিয়ে ইরানের সাথে যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক অবনতিশীল রয়েছে।

তবে অবস্থাদৃষ্টে যা বোঝা যাচ্ছে জাভেদ জারিফের উপস্থিতি আগামী দিনে ৬ জাতির সাথে স্বাক্ষরিত এই পরমাণু ইস্যু নিয়ে নতুন করে আলোচনার দ্বার উন্মুক্ত করতে যাচ্ছে।

এখানে একটি বিষয় বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয় যে জি৭ভূক্ত দেশগুলো এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ অনেকটা একই সূত্রে গাঁথা। এখান থেকে যে সিদ্ধান্ত আসবে সেটা প্রতিপালনে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অন্ততপক্ষে একধরণের অনানুষ্ঠানিক বাধ্যবাধকতা থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ বিশ্ব রাজনীতির পরিকল্পনা সাজানো এবং বাস্তবায়নে এই সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে খেপিয়ে তোলা তার নিজ স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে বিবেচনায় ফ্রান্স, জার্মানিসহ অপর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে উত্থাপিত জাভেদ জারিফকে সম্মেলনস্থলে হাজির করার প্রস্তাব তাই হয়ত যুক্তরাষ্ট্র অগ্রাহ্য করতে পারেনি।

এই সম্মেলনের পার্শ্ববৈঠকে জি৭ভুক্ত কয়েকজন সরকারও প্রধান এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে জাভেদ জারিফের বৈঠক এবং সম্মেলন পরবর্তী সময়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষ থেকে এই পরমাণু আলোচনায় ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানীর সাথে ভবিষ্যতে বৈঠকে বসতে সম্মতি এই ইঙ্গিতই দেয় যে যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ সম্মতিতে তার মান বাঁচাতে এবার এগিয়ে এসেছে কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ। সুতরাং আমরা অদূর ভবিষ্যতে উত্তর কোরীয় নেতার মত ইরানের প্রেসিডেন্টের সাথেও যদি মার্কিন প্রেসিডেন্টের বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে দেখি তাহলে অবাক হবনা। আর যদি তাই হয় তবে বলতে হবে এবারের জি৭ সম্মেলনের এটাই সবচেয়ে বড় অর্জন।

অপর যে বিষয়গুলো এবার সম্মেলনে প্রাধান্য পেয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যু। বৈশ্বিক নিরাপত্তা রক্ষায় এ বিষয়ে বিশেষ মনোযোগের গুরুত্ব উপলব্ধি করলেও আমরা সবাই জানি যে এই সকল শিল্পোন্নত দেশগুলোর লাগামহীন উন্নয়ন কর্মকান্ডই আজকের পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতার জন্য দায়ী। সেদিক বিবেচনায় নিয়ে তারা এমন কোন সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করতে পারেননি, যা থেকে গোটা বিশ্ববাসী আশ্বস্ত হতে পারে।

বিশ্ববাণিজ্যের ক্ষেত্রে এবারের সম্মেলনের আলোচনায় সদস্য দেশগুলো স্থিতিশীলতা আনয়নের উপর গুরুত্ব আরোপ করলেও সম্মেলনে যোগ দেয়ার আগ মুহূর্তে নতুন করে আরও কিছু সংখ্যক চীনা পণ্যের উপর ডোনাল্ড ট্রাম্প কর্তৃক শুল্ক আরোপ এই স্থিতিশীলতাকে দারুণভাবে ব্যাহত করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

যদিও যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন উভয় পক্ষই জানিয়েছে যে, তাদের মধ্যে চলমান বাণিজ্য আলোচনার মাধ্যমে শিগগীরই নতুন বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে যাচ্ছে। ট্রাম্প সেই সাথে এটাও জানান যে চীনের উপর এ নিয়ে চাপ সৃষ্টি করতেই এবং যুক্তরাষ্ট্রের মেধা চুরি ঠেকাতে তাদের এই সিদ্ধান্ত নেবার কোন বিকল্প ছিল না।

এটা ঠিক যে প্রায় দেড় বছর ধরে চলমান এই বাণিজ্য যুদ্ধে কেবল যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন নয়, কমবেশি শিল্পোন্নত দেশগুলোর সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং বিশ্ববাণিজ্যে এক ধরণের আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে, যা বাড়তে থাকলে সকলের জন্যই ক্ষতি এবং এর মধ্য ধরে নতুন ধারার এক অর্থনৈতিক সংকটের শুরু হতে পারে। সে লক্ষ্যে সদস্য দেশগুলোর পক্ষ থেকে এই বাণিজ্য বিরোধ দ্রুত মিটিয়ে ফেলতে যুক্তরাষ্ট্রের উপর চাপ দেয়া হয়েছে।

তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এখন ট্রাম্পের মত একজন কট্টর লোক, যিনি খুব সহজে এই সমস্যার সমাধান হতে দেবেন না। উল্লেখ্য যে, দ্বিপাক্ষিক এই বাণিজ্যিক বিরোধে চীনের অর্থনীতির ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য ক্ষতি সাধন হলেও যুক্তরাষ্ট্রের এই অতিরিক্ত শুল্কহার তার অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। সুতরাং যদি নতুন করে কোনো চুক্তিতে চীনকে সম্মত হতে হয় তবে অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রের ভাষায় ‘আমি চুরি করেছি’ এমনটা মেনে নিয়েই তা করতে হবে, যা খুব দুরূহ হবে বলে মনে হচ্ছে।

ব্রেক্সিট ইস্যু এবারের সম্মেলনে অন্যতম আলোচ্যসূচি ছিল। আমরা জানি, এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে যুক্তরাজ্যে ডেভিড ক্যামেরুন এবং থেরেসে মে প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর পর বরিস জনসন নতুন করে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিলেন।

ধারণা করা হয় ‘ডিভোর্স বিল’ নামক যে খসড়া চুক্তিটি কয়েক দফায় ব্রিটিশ হাউজ অব কমন্সে নাকচ হয়েছে তাতে বরিস জনসনের প্রচ্ছন্ন হাত রয়েছে। মে কে বিপদে ফেলে নিজে এই পদে আসীন হবার মত পরিকল্পনা করেছিলেন বলে অনেকের ধারণা। সেক্ষেত্রে এই সম্মেলন থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে চাপ দিয়ে ব্রিটিশ স্বার্থের স্বপক্ষে নতুন কোন কিছু সংযোজন করে জনসন পার পাবেন বলে মনে হয় না।

সবকিছু মিলে এবারের সম্মেলন থেকে আগামী দিনে বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন কোনো প্রাপ্তি যোগ হতে যাচ্ছে এমন কোনো আশাবাদের সুযোগ খুবই কম।

ফরিদুল আলম: সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর