চরম উন্নয়ন বৈষম্য থেকে রংপুরের মুক্তি কতদূর?

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

ড. তুহিন ওয়াদুদ | 2023-08-31 11:51:09

বাংলাদেশের অর্থনীতি তরতর করে উপরের দিকে উঠছে। দেশে ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে। সেই তুলনায় অঞ্চল বিশেষে রংপুর আছে উন্নয়নের তলানিতে। আজ পর্যন্ত রংপুরের সঙ্গে সারাদেশের অঞ্চলগত উন্নয়ন বৈষম্য দূর করার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। রংপুর বিভাগের আটটি জেলায় সচেতন মানুষ মাত্রই বিষয়টি নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন।

রংপুরের উন্নয়ন না হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ মনে করা হয় রাজনৈতিকভাবে প্রভাব বিস্তার করার মতো নেতার বড় অভাব থাকা। যদিও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ৯ বছর রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রংপুরের পুত্রবধূ। খালেদা জিয়া দুই দফায় ক্ষমতায় ছিলেন। দিনাজপুরের সঙ্গে তাঁরও সম্পর্ক রয়েছে। এসব দিক বিবেচনা করলে ক্ষমতার কেন্দ্রে রংপুরের মানুষ সবসময়ই ছিলেন। তারপরও রাজনৈতিক কিছু কিছু বাস্তবতা রংপুরকে পিছিয়ে দিয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে হত্যা করার পরই বৈষম্য চাঙা হয়ে উঠতে শুরু করে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ৯ বছর ক্ষমতায় থাকাকালীন রংপুরের সাথে তার চরম বিরোধ ছিল। এমনও হয়েছে রংপুরে তিনি কর্মসূচি ঘোষণা করে সেই কর্মসূচিতে যোগ দিতে পারেননি। কারমাইকেল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা করার কথা ছিল। কিন্তু সেই কারমাইকেল কলেজে তিনি প্রবেশই করতে পারেননি। জুতার মালা গেটে ঝুলিয়ে রেখেছিল স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকারীরা।

 

সাবেক এই সেনাপ্রধান রংপুর অঞ্চলে কিছু কিছু পাকা সড়ক করেছিলেন। কিন্তু সেই সড়কপথ ঢাকার সঙ্গে তখনো যুক্ত হয়নি। ফলে সড়ক ব্যবস্থাও রংপুরের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে পারেনি। তার জন্যেও অপেক্ষা করতে হয়েছে বঙ্গবন্ধু সেতু উদ্বোধন হওয়া পর্যন্ত। রংপুরে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নিয়ন বাতির (সোডিয়াম লাইট) ব্যবস্থা করেছিলেন। গরিব অসহায় মানুষ শহরে এসে রাতে দেখতেন নিজের শরীরের রং বদলে গেছে। তাতে তাদের ক্ষুধা-অনটনের যন্ত্রণার রং বদলাত না।

এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা ছাড়ার পর কী এক অজ্ঞাত কারণে রংপুরের সাধারণ মানুষ তাকে ভালোবাসতে শুরু করেন। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে ক্ষমতা ছাড়ার পরই তিনি কারাবন্দি হন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে রংপুরের সবগুলো আসনে জয় পায় জাতীয় পার্টি। ক্ষমতায় তখন বিএনপি সরকার। যেহেতু এ অঞ্চলে বিএনপির সংসদ সদস্য ছিল না, তাই এ অঞ্চলে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হতো না।

১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। সে বছরের নির্বাচনেও এরশাদের দল জাতীয় পার্টি রংপুর বিভাগের অধিকাংশ আসন লাভ করে। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ক্ষমতার পাঁচ বছরে কিছু কিছু উন্নয়ন করলেও সেই উন্নয়নও সমতাভিত্তিক ছিল না। ২০০১ সালের নির্বাচনে আবারও বিএনপি ক্ষমতায় আসে। তখনো এ অঞ্চলে বিএনপির নাজুক অবস্থা। ফলে পূর্বের আচরণের পুনরাবৃত্তি ঘটে। ২০০১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত আবারো উন্নয়ন ব্যাহত হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোট সরকারের সাথে জাতীয় পার্টি থাকলেও তারা প্রভাবক হিসেবে ছিল না। তবে রংপুর অঞ্চলের পালে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগে। এই উন্নয়ন ২০১৯ সাল পর্যন্ত হচ্ছে। কিন্তু সারাদেশে যে উন্নয়ন হচ্ছে, সেই তুলনায় রংপুর বিভাগের উন্নয়ন যৎসামান্য।

দেশের সবচেয়ে গরিব ১০টি জেলার পাঁচটি জেলা রংপুর বিভাগে। অবশিষ্ট তিনটি জেলাও উন্নয়ন সূচকে নিচের দিকে। ২০১৬ সালে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো সর্বশেষ দারিদ্র্য মানচিত্র প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা যায় ২০১১ সালের চেয়ে সারাদেশে গড় দারিদ্র্য কমেছে প্রায় সাত শতাংশ। এতে দেখা যায়, দেশের গড় দারিদ্র্য ৩০ দশমিক পাঁচ শতাংশ থেকে নেমে ২৪ দশমিক তিন শতাংশ হয়েছে। রংপুর বিভাগের গড় দারিদ্র্য ৪২ দশমিক তিন শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৪৭ দশমিক দুই শতাংশ। কুড়িগ্রামের দারিদ্র্যের হার ২০১১ সালে ছিল ৬৩ দশমিক সাত শতাংশ। সেটি ২০১৬ সালে হয়েছে ৭১ দশমিক আট শতাংশ। দিনাজপুরে সেই দারিদ্র্যের হার বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ।

পায়রা চত্বর, রংপুর/ ছবি: সংগৃহীত

 

দেশে যে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো গ্রহণ করা হয়, সেখানে রংপুর বিভাগের জন্য প্রকল্প বাবদ বরাদ্দ খুবই কম। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে সরকার উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দ দিয়েছে এক লাখ ৭৬ হাজার ৬১৯ কোটি টাকা। এই টাকার মাত্র দশমিক ৯৮ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে রংপুর বিভাগের জন্য।

২০১২-২০১৩ অর্থবছর থেকে ২০১৬-২০১৭ অর্থবছর পর্যন্ত চারটি অর্থবছরে রংপুর বিভাগের পাঁচটি গরিব জেলার এক কোটি ২০ লাখ মানুষের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ ছিল মাত্র দুই দশমিক ৯ শতাংশ। ঐ চার বছরে ১২ লাখ মানুষের একটি জেলায় গড় বরাদ্দ ছিল পাঁচ দশমিক ৩৬ শতাংশ টাকা। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে দুই লাখ কোটি টাকারও বেশি। যদি সরকার উন্নয়নবৈষম্য দূর করতে চায় তাহলে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ বেশি রাখতে হবে।

উন্নয়ন বৈষম্য দূরীকরণ সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। অথচ সরকার সেই দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট নয়। দেশ এখন সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আওতায় চলছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে সেই সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় রংপুরকে আলাদা বিভাগ হিসেবে কোথাও স্থানই দেওয়া হয়নি।

সরকার চাইলে এই বৈষম্য খুবই স্বল্প সময়ে দূর করা সম্ভব। রংপুরের বেকারদের জন্য আইটি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মমুখী করে গড়ে তোলা প্রয়োজন। রংপুর বিভাগে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথ খুবই সংকুচিত। বিদেশে কাজের ধরণ অনুযায়ী রংপুর বিভাগের বেকারদের প্রশিক্ষণ ও সহজ পদ্ধতিতে ঋণ দিয়ে তাদের বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

রংপুর অঞ্চল শিল্পকারখানা গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত স্থান। রংপুর বিভাগে যারাই কারখানা প্রতিষ্ঠা করেছে, তারাই লাভবান হয়েছে। আজ সারাবিশ্বে প্রাণ আরএফএল তাদের পণ্য রফতানি করে। তাদের যাত্রা শুরু হয়েছে রংপুর থেকে। আজও রংপুরে তাদের কারখানাগুলো খুবই লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবেই আছে। রংপুরের কারুপণ্য নামের একটি প্রতিষ্ঠান বিদেশে রফতানিতে কয়েক বছর স্বর্ণপদক লাভ করেছে। রংপুরে শিল্প উদ্যোক্তাদের আকৃষ্ট করার জন্য সরকারিভাবে বিশেষ প্রণোদনা দেওয়া প্রয়োজন। রংপুরের সঙ্গে সারাবিশ্বের নৌপথ শক্তিশালী করা প্রয়োজন।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রত্যয় ছিল বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। বর্তমান সরকারের কাছে আমরা প্রত্যাশা করি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগই রংপুরসহ সারদেশের উন্নয়ন বৈষম্য দূরীকরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

ড. তুহিন ওয়াদুদ: সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও পরিচালক রিভারাইন পিপল।

এ সম্পর্কিত আরও খবর