ডেঙ্গু মোকাবেলা: আতঙ্ক নয় সতর্ক হোন

, যুক্তিতর্ক

নাজমুল হুদা | 2023-08-28 05:22:19

এনএসওয়ান (NS1) পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে পেয়েই চোখ বুলিয়ে দেখলাম ‘পজিটিভ’লেখা! এই ‘পজিটিভ’ বার্তার মানে হল ডেঙ্গু জ্বর! ক’দিন ধরেই তীব্র জ্বরে ভুগছিল আমার স্ত্রী। রক্তের কনিকাগুলোর পরিমাণও পরীক্ষা করালাম। যাক, প্লাটিলেট (রক্তের অনুচক্রিকা যা মূলত রক্তে জমাট বাধাতে সাহায্য করে) এর পরিমাণ অন্তত বিপদ সীমার (ন্যুনতম দেড় লক্ষ) উপরে। কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। তবে আতঙ্ক কাটলো না।

এভাবে কয়েকদিন কাটলো। তারপর আবার দু’দফায় প্লাটিলেট টেস্ট করালাম। ফলাফল নিম্নগামী। প্রতিবারই প্লাটিলেট এর পরিমাণ কম দেখাচ্ছে। জ্বর কিছুটা কমলেও শরীরে তীব্র ব্যথা, অসস্তিভাব ও খাওয়ার অরুচি বেড়েই চলছে। তরল জাতীয় খাবারতো চলছেই তারপরও প্লাটিলেটের ক্রমহ্রাস আতঙ্ক আরো বাড়িয়ে দিল। অত:পর হাসপাতালে যাত্রা ছাড়া আর কোন বিকল্প ভেবে পেলাম না। প্রথমে ভর্তিযুদ্ধ! ‘ঠাই নাই, ঠাই নাই’ অবস্থা সবখানে।

এরপর শুরু হল ডেঙ্গুযুদ্ধের দ্বিতীয় ইনিংস। ক্ষণে ক্ষণে রক্তচাপ মাপা, নিয়মিত প্লাটিলেট টেস্ট, স্যালাইনসহ পানীয় প্রবাহ সচল রাখা, রক্তের জন্য খোঁজখবর, অন্যদের বিপদসীমার বাইরে রাখার চেষ্টা এরকম হরেক কাজের ব্যস্ততায় তিনদিন তিনরাত কেটে গেল। বিপদ পুরোপুরি না কাটলেও হাসাপাতাল থেকে মুক্ত করে বাসায় এনে বাকী সুস্থতার জন্য অপেক্ষা ছাড়া আর কিই বা করার আছে।

ডেঙ্গু মোকাবেলার প্রাথমিক অভিজ্ঞতার পারিবারিক গল্পটি দিয়ে লেখা শুরু করলাম কারণ সবার ক্ষেত্রেই ঘটনা পরম্পরা কমবেশি একরকম। শুরুতে তীব্র জ্বর (১০২-১০৩ ডিগ্রী)। এরপর জ্বর ছেড়ে অন্যান্য সমস্যার সূত্রপাত। ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে দেয়ার পর কয়েক ঘন্টা বাদে আবারো আসতে পারে। কারো ক্ষেত্রে একটানা জ্বর থাকতে পারে। শরীরে ব্যথা, মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা এবং চামড়ায় লালচে দাগ হতে পারে। তবে এগুলো না থাকলেও ডেঙ্গু হতে পারে। এই রোগের এ, বি এবং সি তিনটি ধরণ রয়েছে- অধিকাংশ ডেঙ্গু রোগী ‘এ’ ক্যাটাগরির। তাদের শুধু জ্বর হয় ও প্রচন্ড ব্যথা থাকে। তাদের হাসপাতালে ভর্তি হবার কোন প্রয়োজন পড়েনা।

 ‘বি’ ক্যাটাগরির ডেঙ্গু রোগীরা মোটামুটি স্বাভাবিক থাকে, তবে শরীরে কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন- পেটে ব্যথা হতে পারে, প্রচুর বমি হতে পারে কিংবা খাওয়ার অরুচি থাকতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, দুইদিন জ্বরের পর প্রচন্ড দুর্বল হয়ে যায় ও শরীর, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়।

এক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি হওয়াই ভালো। ‘সি’ ক্যাটাগরির ডেঙ্গু জ্বর সবচেয়ে খারাপ। কিছু-কিছু ক্ষেত্রে বিশেষায়িত হাসপাতালের নিবিঢ় পরিচর্যা কেন্দ্র অর্থাৎ আইসিইউ-তে নেয়ার প্রয়োজন হতে পারে। ডেঙ্গু ভাইরাসের ৪টি সেরোটাইপের (ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩, ডেন-৪) মধ্যে যেটির দ্বারা আক্রান্ত হওয়ায় একবার এই রোগ হয়, সেটির বিরুদ্ধে মানব দেহে এন্টিবডি তৈরি হওয়ায় পরবর্তীতে তা দ্বারা আর আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।

তবে সেই ব্যক্তি নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে অপর ৩টি সেরোটাইপের কোনটি দ্বারা আবারও আক্রান্ত হতে পারেন। দ্বিতীয় বার আক্রান্ত হলে রোগটি জটিল আকার ধারন করতে পারে। তাই এ সময় তার জন্য বিশেষ সাবধানতা অবলম্বেেনর প্রয়োজন হয়। একজন ডেঙ্গু রোগীর উপসর্গ প্রকাশ পাওয়ার পর সাধারণত ৪ থেকে ৫ দিন এবং করো ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১২ দিন পর্যন্ত তার কাছ থেকে এডিস মশার মাধ্যমে অন্যত্র রোগ সংক্রমিত হতে পারে। আতঙ্কটা একারণেই বেশি। তবে সতর্ক থাকলে বিপদ এড়ানো সহজ হয়। অমুকে কী বলেছে, তমুক জায়গায় কী লেখা হয়েছে, এসব নিয়ে আতঙ্কিত হবেন না। ওভার ট্রিটমেন্ট বা অতিচিকিৎসা বিপদ ডেকে আনতে পারে। সতর্ক ও সচেতন থাকুন ।

তবে আমরা আগ বাড়িয়ে অনেক কিছু করতে চাই। যা বাড়তি বিড়ম্বনা সৃষ্টি করে। সুচিকিৎসা ব্যাহত করে। যেমন অহেতুক বারবার প্লাটিলেট কাউন্ট দেখা, প্রেশার মাপা, নিজ থেকেই স্যালাইন দিতে চাওয়া, রক্ত দেওয়ার জন্য ব্যস্ত হওয়া। আমিও অবশ্য শুরতে তাই করেছি। এমনকি নিজে হাতে রক্ত বহন করে প্যাথোলজিতে পৌছে দিয়েছি। প্যাথোলজিস্টদের বলে তৎক্ষণাত কম্পিউটার থেকে প্লাটিলেট কাউন্ট  দেখে নিতাম।

রোগীর আধিক্যে হাসাপাতালের বেসামাল অবস্থায় বাধ্য হয়েই এরকম অহেতুক অতিরিক্ত দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে। এতে তথ্য জানলেও পেরেশনি কমতো না। কারণ ততোক্ষণে প্লাটিলেট আরো কমে যাচ্ছিলো! এরকম পরিস্থিতিতে কি করণীয়? ধৈর্য্য ধরে নিয়মমাফিক বিশ্রাম, খাওয়া দাওয়া আর ওষুধ বলতে প্যারাসিটামল বা বমি নিরোধক ট্যাবলেট ছাড়া বেশি কিছু করার নেই। প্রথম থেকে ঠিকমতো চিকিৎসা করালে এবং সঠিক পরিমাপে তরল পদার্থ দিতে পারলে ডেঙ্গু মারাত্মক আকার ধারণ করে না। খুব কম ক্ষেত্রেই প্লাটিলেট ট্রান্সফিউশন দিতে হয়।

বিশেষ করে ২০ হাজারের নিচে প্লাটিলেটের সংখ্যা নেমে আসলে। এসময় কোনো প্রকার আঘাত ছাড়াই রক্তক্ষরণ হতে পারে। কোনো কারণে রক্তে প্লাটিলেট কমে গেলে জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনার মাধ্যমেই প্লাটিলেট সংখ্যা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। কিছু খাবার আছে যেগুলো প্লাটিলেট বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। বিশেষ করে জ্বরের শুরু থেকেই বাড়িতে প্রচুর তরল পান ।

প্রতিদিন আড়াই থেকে তিন লিটার। তরল মানে সাদা পানি, স্যালাইন, ডাবের পানি, ফলের রস, লেবুর শরবত ইত্যাদি। পেঁপে পাতার রস কিংবা পাকা পেঁপের জুস, মিষ্টি কুমড়া ডালিম রক্তে প্লাটিলেটের পরিমাণ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। পরিমিত খাবার ও পর্যাপ্ত বিশ্রামের পাশাপাশি কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। যেমন প্রস্রাব পর্যাপ্ত হচ্ছে কি না, রক্তচাপ কমে যায়, রক্তবমি হয় কি না।

এসময় কালো মল, প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যেতে পারে, ত্বকের নিচে রক্ত জমে, প্রস্রাব কমে যায়, যকৃৎ বড় হয়ে যায়। জ্বর কমে যাওয়ার পর অর্থাৎ রোগের ষষ্ঠ, সপ্তম বা অষ্টম দিনে সিভিয়ার ডেঙ্গু দেখা দেয়। এ সময় এ ছাড়া বুকে –পেটে পানি জমে, ফুসফুসে পানি জমে শ্বাসকষ্ট হয়।

রক্তচাপ অনেক কমে যাওয়ায় অস্থিরতা, অসংলগ্ন কথাবার্তা, একাধিক অঙ্গ অকার্যকর হয়ে পড়তে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে রোগীকে যদি রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হয় তাহলে যিনি রক্ত দিবেন তিনি যেন একেবারে খালি পেটে না থাকেন। চার ঘণ্টার বেশি খালি পেটে থাকলে তাকে অবশ্যই কিছু খেয়ে নিতে হবে। রক্ত জমাট না বাঁধার কোনো ওষুধ (অ্যাসপিরিন, ক্লপিডগ্রিল ইত্যাদি) কেউ সেবন করলে তিনি কমপক্ষে ৪৮ ঘণ্টা রক্তদান থেকে বিরত থাকবেন। তারপর রক্ত দিতে পারেন।

কারো যদি প্লাটিলেট লাগে, তবে তার রক্তদাতাকে দুই ঘণ্টার মধ্যে ভারী খাদ্য গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ এতে প্লাটিলেটের কার্যকারিতা কমে যেতে পারে। ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’ মহামারী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত বেশ কয়েকেটি দেশে ‘ডেংভ্যাক্সিয়া’ [Dengvaxia® (CYD-TDV) developed by Sanofi Pasteur] নামক ভ্যাক্সিনের অনুমোদন দিয়েছে। এই ভ্যাক্সিনটির তিনটি ডোজ ৯ থেকে ৪৫ বছর ব্যক্তিদের মাঝে ছয় মাস অন্তর প্রয়োগ করতে হয়। তবে এটি ব্যবহারের বেশ কিছু বিধি নিষেধ রয়েছে।

বাংলাদেশে এটি এখনো প্রয়োগ করার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

তবে আমাদের নিজেদের সতর্কতা সবচেয়ে বেশি জরুরি। রোগীকে যেন মশা কামড়াতে না পারে। অন্তত রোগ সংক্রমণের কয়েকটি দিন তিনি যেন সব সময় মশারির মধ্যে অবস্থান করেন সে ব্যাপারে নিজেকে ও স্বজনদেরকে সচেতন থাকতে হবে।

নাজমুল হুদা : ফার্মাসিস্ট ও উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

এ সম্পর্কিত আরও খবর