আপন আলোয় বিজেপি এবং মোদি

, যুক্তিতর্ক

ফরিদুল আলম | 2023-08-24 23:32:23

সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তুতি ছিল আগে থেকেই, যার অংশ হিসেবে গত এক সপ্তাহ সময়ের মধ্যে সারাদেশ থেকে ৪৩ হাজার সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের (সিআরপিএফ) সদস্যদের কাশ্মীরে জরো করা হয়, ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেয়া হয় আগের দিন থেকেই, বিভিন্ন স্পর্শকাতর জায়গায় অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করা হয়।

এর সব কিছু থেকেই বোঝা যায় যে সরকার সারা দেশে এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার কথা মাথায় রেখে অনেকটা গোপনে তাদের পরিকল্পনাকে নতুন আইনে পরিণত করল। তাছাড়া এটা যে বিজেপির অন্যতম এজেন্ডা এবং এর জন্য কেবল মোক্ষম সময়টির জন্য তাদের অপেক্ষা ছিল এর প্রমাণ মেলে গত ৬ জুলাই মৃত্যুর মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের একটি টুইট থেকে। কাশ্মীর নিয়ে সিদ্ধান্তের জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছিলেন এমন একটি সিদ্ধান্তের জন্য তিনি সারা জীবন ধরে অপেক্ষা করছিলেন।সাবেক অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলী এঁকে এক ঐতিহাসিক ভুলের সংশোধন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ উত্তর সময়ে ২৭ অক্টোবর কাশ্মীরের তৎকালীন রাজা হরি সিং এর সাথে ভারত সরকারের সম্পাদিত চুক্তি- যার বলে কাশ্মীরকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ করা হয়, সেখানে তিনটি বিষয় – যোগাযোগ, প্রতিরক্ষা এবং পররাষ্ট্রনীতি – এগুলোর বাইরে বাকী সকল বিষয়ে সিদ্ধান্তের ক্ষমতা দিয়ে জম্মু ও কাশ্মীরকে একটি বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা দিয়ে সংবিধানে ৩৭০ ধারা সংযোজন করা হয়। গত ৫ জুলাই ভারত সরকার কেবল সংবিধানের এই বিশেষ ধারাকেই বাতিল করলো না, এর বাইরে জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ এই দু ভাগে তাদের নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরকে বিভক্ত করে সেখানে সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের শাসন জারি করা হয়।

উল্লেখ্য, ১৯৫০ সালে ভারতের সংবিধান প্রণয়নের সময় জম্মু ও কাশ্মীরকে বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা দেয়া হলেও সেই মর্যাদা স্থায়ী ছিল না; বরং তা ছিল অস্থায়ী সংস্থান বা টেম্পোরারি প্রভিশন। ওই ধারার ৩ নম্বর উপধায়ায় বলা হয়েছে যে রাষ্ট্রপতি ইচ্ছে করলে এই মর্যাদা বাতিল করতে পারবেন। বিজেপি সরকার কৌশলে রাষ্ট্রপতির এই বিশেষ ক্ষমতাকে ব্যবহার করে সেদিন সন্ধ্যায় রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের ভোটে কাশ্মীর পুনর্গঠন সংক্রান্ত বিলটি পাশ করিয়ে নেয়।

সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হয়েছে এটি একটি সাময়িক পদক্ষেপ, সমস্যা মিটে গেলে আবারও কাশ্মীরকে তার পূর্বের মর্যাদা ফিরিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু মোদি সরকার, বিজেপি এমনকি ভারতের রাজনীতিবিদদের আচরণ সেকথা বলে না। অরুণ জেটলি তার প্রতিক্রিয়া থেকে যার ব্যাখ্যা কিছুটা পাওয়া যায়, তিনি বলেছেন যে অস্থায়ী বা ক্ষণস্থায়ী বিধানকে কখনও স্থায়ী বলে ধরা যায় না।

গত লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতেও তারা স্পষ্ট করে বলেছিল যে বিতর্কিত ৩৭০ ধারা তারা বাতিল করবে। সেসময় তাদের এ ধরনের কথাকে মানুষ খুব একটা পাত্তা দেয়নি এটিকে স্পর্শকাতর একটি বিষয় ভেবে।

কংগ্রেস এ বিষয়ে সরাসরি বিজেপির মত করে না বললেও তারা এ নিয়ে একটি সম্মানজনক সমাধানে যাবে বলে বলেছিল। এমতাবস্থায় গত ৫ জুলাইয়ের সিদ্ধান্ত যে কেবল বিজেপি সরকারের দলীয় সিদ্ধান্ত এটা ভেবে নেবার কোন সঙ্গত কারণ নেই; বরং ভারতের রাজনীতিবিদরা সম্মিলিতভাবে যা এতদিন ধরে ভেবে এসেছেন, এরই প্রতিফলন ঘটল বিজেপি সরকারের হাত ধরে।

সরকার যদিও বলছে এটি সাময়িক পদক্ষেপ, ঘটনার ঘনঘটা কিন্তু সেকথা বলে না। আগেই বলেছি এটি সরকারের অন্যতম নির্বাচনী পদক্ষেপ ছিল এবং সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেক নেতাদের প্রতিক্রয়ায় স্পষ্ট যে তারা এমন একটি মোক্ষম সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন।

তাছাড়া ৩৭০ ধারা অবলুপ্তির সাথে সাথে অবলুপ্তি ঘটল সংবিধানের ৩৫ ধারাও, যেখানে বলা হয়েছে কাশ্মীরে বাসিন্দা ব্যতীত অন্যরা সেখানে জমি কিনে স্থায়ী অধিবাসী হতে পারবেন না, কাশ্মীরের চাকরির জন্য তারা যোগ্য বিবেচিত হবেন না ইত্যকার বিষয়।

এখন সেখানে বিজেপি সরকার নিশ্চয়ই চাইবে পরিস্থতি যতটুকু সম্ভব নিজেদের অনুকূলে এনে সেখানে ভারতের অপরাপর জায়গা থেকে সেটেলারদের এনে কাশ্মীরে পূণর্বাসন করতে। বিষয়টা শুনতে খারাপ লাগলেও অনেকটা আমাদের পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ি বাঙালি সংমিশ্রণ কিংবা ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরাইলী অধিবাসীদের বসতি গাড়ার মত।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে কাশ্মীর নিয়ে ভারত সরকারের এই সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এক দুঃসাহসী পদক্ষেপ। এতদিন ধরে ভারতের সরকারের দায়িত্ব থাকা যারা এই কাজটি করতে পারলেন না, নরেন্দ্র মোদি তেমনটাই করে অনেক রাজনীতিবিদদের মনের আসা মিটিয়েছেন সত্য, তবে এর জের কোথায় গিয়ে ঠেকে তা সময়ই বলে দেবে।

কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী মানুষ তথা প্রতিবেশী দুই দেশ চীন এবং পাকিস্তান এটিকে সরাসরিভাবে প্রত্যাখ্যান করে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হিসেবে বর্ণনা করেছে। বিষয়টি নিয়ে ভারত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে অবহিত করেছে। আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এখন পর্যন্ত সেভাবে পাওয়া না গেলেও আগামী মাসে অনুষ্ঠিতব্য জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বৈঠকে এটি যে অন্যতম এক আলোচ্য সুচি হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। 

ভারত সরকারের কথিত বিতর্কিত কাশ্মীর একত্রীকরণ প্রক্রিয়াটি মানবাধিকার, আইনের শাসন, গণতন্ত্র, জনগণের অধিকার এবং মুক্তিকামী মানুষের জন্য একদিকে যেমন হুমকিস্বরূপ, অপরদিকে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব, জঙ্গিবাদ নির্মূল এবং সন্ত্রাস দমনে সরকারের প্রচেষ্টাকে জোরদারে এটি অন্যতম রক্ষাকবচ বলা চলে।

দীর্ঘদিন ধরে সংবিধানের একটি বিশেষ রক্ষাকবচকে ভারত তাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকী হিসেবে বিবেচনা করে এসেছে।। এখন সরাসরিভাবে সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের শাসন কার্যকর করার মধ্য দিয়ে কাশ্মীরের আভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা বিনষ্টকারী পদক্ষেপ দমনে তারা সরাসরি মনযোগী হবার পদক্ষেপ নিয়েছে।

২০১৬ সাল থেকে অস্থিরতায় ভুগতে থাকা কাশ্মীর ভারতের জাতীয় রাজনীতিকে অনেকটা পুড়িয়েছে। গত ফেব্রুয়ারী মাসে পুলাওয়ামায় সন্ত্রাসী হামলা এবং এর প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানের বালাকোটে ভারতের তরফ থেকে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক এই সকল অস্থিরতার পরিণতি। ভারতের আচরণ থেকে এখন স্পষ্ট যে তারা আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রশ্নে কোন প্রকার ছাড় দিতে রাজি নয়।

ফরিদুল আলম: সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর