জলবায়ু সংকটে এশিয়ার শতকোটি মানুষ

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

আলম শাইন | 2023-08-26 20:46:19

‘জলবায়ু’ শব্দটা ব্যাপক পরিচিত হলেও অনেকেই শব্দটার মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পারেননি। বিষয়টা বোঝেন সবাই; তবে বোঝাতে সক্ষম নন। যেমনটি ‘জীববৈচিত্র্য’ শব্দের অর্থ বোঝেন; বোঝাতে পারেন না।

জলবায়ুর ক্ষেত্রে একটা ছোট্ট হিসাব-নিকাশ আছে অবশ্য। হিসাবটি জানানোর আগে আমরা জেনে নেই জলবায়ুর উপাদানসমূহ। যেমন: বায়ু, বায়ুচাপ, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, মেঘ-বৃষ্টি, তুষারপাত ইত্যাদি জলবায়ুর উপাদান। আর ছোট্ট হিসাবটি হচ্ছে, কোনো নির্দিষ্ট ভৌগলিক অঞ্চলের ৩০-৩৫ বছরের গড় আবহাওয়াই হচ্ছে জলবায়ু। যার পরিবর্তনকে আমরা সাধারণত জলবায়ু সংকট বলে থাকি।

জলবায়ুর প্রভাবের সঙ্গে আমাদের বেঁচে থাকার সম্পর্কটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, চলতি বছরের বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। গেল বছরের তুলনায় এবারের তাপমাত্রাবৃদ্ধি বিশ্ববাসীকে ভাবিয়ে তুলেছে। যেমন: কুয়েতের তাপমাত্রা বিশ্বের ইতিহাসে চলতি বছরের তাপমাত্রা রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। সেখানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা প্রায় ৬৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি উঠেছে। ছায়াযুক্ত স্থানেও ছিল ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা। ফলে সেখানকার মানুষের বেঁচে থাকাটাই কঠিন হয়ে পড়েছে। বিষয়টা ভাবতেই রোম শিহরে উঠেছে আমাদের। আমরা জানতে পেরেছি সেখানকার অত্যধিক তাপমাত্রার ফলে গাড়ির চাকার টায়ার পর্যন্ত গলে গেছে।

শুধু কুয়েতে নয়, আমাদের দেশেও ব্যাপক তাপমাত্রা বিরাজ করছে চলতি বছরে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের শতাধিক লোকের মৃত্যুর খবরও আমরা জানতে পেরেছি। এসব হচ্ছে শুধুমাত্র জলবায়ু সংকটের প্রভাবে। উল্লেখ্য, বন্যা, খরা, ঝড় জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি জলবায়ুর প্রভাবেই ঘটছে।

শুধুমাত্র শিল্পোন্নত দেশের খামখেয়ালিপনার কারণেই এসব ঘটছে। যার খেসারত দিতে হচ্ছে দরিদ্র দেশগুলোকে। তারা একদিকে কার্বন নিঃসরণ বাড়িয়ে দিচ্ছে, অন্যদিকে জলবায়ু সংকটের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহকে অনুদান দিচ্ছে। অনেকটা গোঁড়া কেটে আগায় জল ঢালার সামিল। যার প্রেক্ষিতে বলতে হচ্ছে আমরা অনুদান চাই না, আমরা চাই কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোটায় নেমে আসুক। আমরা চাই আমাদের প্রাণপ্রিয় সুন্দরবন টিকে থাকুক; টিকে থাকুক এশিয়ার গর্ব হিমালয় পর্বতমালা।

সূত্রমতে জানা যায়, হিমালয়ের বরফও গলে যাচ্ছে দ্রুত। দুই হাজার সাল পর্যন্ত হিমালয়ের বরফ শতকরা একভাগ হারে গলেছে। বর্তমানে হিমালয়ের বরফ দ্বিগুণ হারে গলছে! তাতে করে চীন, ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটানসহ এশিয়া অঞ্চলের শতকোটি মানুষ বিশুদ্ধজল সমস্যায় পড়বে। উল্লেখ্য, জার্মানির বন শহরে যখন জলবায়ু সম্মেলন (২০১৯) চলছে ঠিক তখনি সায়েন্স অ্যাডভান্সেস-এ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে।

আমরা জানি, সমগ্র বিশ্বে মোট মজুদ জলের পরিমাণ এক হাজার ট্রিলিয়ন মেট্রিক টন। তন্মধ্যে সমুদ্রে সঞ্চিত লবণাক্ত জলের পরিমাণ ৯৭.২ শতাংশ। যা মোটেই পানযোগ্য নয়। অপরদিকে ২.১৫ শতাংশ জল জমাটবদ্ধ হয়ে আছে বরফাকারে। সেটিও পানযোগ্য নয়। বাকি .৬৫ শতাংশ জল সুপেয় হলেও প্রায় .৩৫ শতাংশ জল রয়েছে ভূ-গর্ভে। যা উত্তোলনের মাধ্যমে আমাদের দৈনন্দিন পানযোগ্য জল চাহিদা পূরণ করতে হয়। এটি আমাদের কাছে বিশুদ্ধ জল হিসেবে পরিচিত। এই জলের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে প্রতিটি মানুষের জন্যে দৈনিক গড়ে ৩ লিটার হারে।

ভূ-গর্ভস্থ জল ছাড়া নদ-নদী, খাল-বিল কিংবা পুকুর-জলাশয়ের জল সুপেয় হলেও তা বিশুদ্ধ নয়। তবে সেটিও আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য্য অংশ। বিশেষকরে গোসলাদি, রান্না-বান্না, জামা-কাপড় ধোয়ার কাজে এ জলের ব্যাপক প্রয়োজন পড়ে। তাতে করে একজন মানুষের সব মিলিয়ে গড়ে ৪৫-৫০ লিটার জলের প্রয়োজন হয়।

অবধারিত সত্য কথাটি হচ্ছে, বিশ্বের মোট আয়তনের তিনভাগ জলরাশি হলেও বিশুদ্ধ জল সংকটে ভুগছেন ৮০টি দেশের প্রায় ১১০ কোটি মানুষ। এছাড়াও প্রতি বছর বিশ্বের প্রায় ১৮ লাখ শিশু প্রাণ হারাচ্ছে শুধুমাত্র দূষিত জল পান করে।

প্রতিদিনের জলপানের চাহিদা মেটাতে কিংবা বিশুদ্ধ জলপান থেকে বঞ্চিত হওয়ার নানাবিধ কারণ রয়েছে। তন্মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, খরা, ভূ-গর্ভস্থ জলস্তর নেমে যাওয়া কিংবা আর্সেনিকের পরিমাণ বেড়ে যাওয়াই প্রধান সমস্যা হিসাবে দেখা দিয়েছে।

জানা যায়, বৈশ্বিক উষ্ণতা আর মাত্র এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলেই বিশ্বের মোট ১৪৫ কোটি মানুষ সুপেয় জল সংকটের মুখোমুখি হবেন। তন্মধ্যে এশিয়া মহাদেশে ১২০ কোটি এবং আফ্রিকা মহাদেশে ২৫ কোটি মানুষ এর আওতায় পড়বেন। এর থেকে বাদ যাবে না বাংলাদেশের মানুষও। এছাড়াও অন্যান্য মহাদেশের তুলনায় এশিয়া অঞ্চলে এর প্রভাব পড়বে খানিকটা বেশি।

তার ওপর আমাদের জন্য মহা অশনি সংকেত হচ্ছে হিমালয়ের বরফ গলার হার দ্বিগুণ বেড়ে যাওয়া। যেখানে ২৫ বছর আগে ৫০ সেন্টিমিটার বরফ গলেছে, সেখানে দ্বিগুণ হারে বরফ গলছে বর্তমানে। হিমবাহ গবেষকদের অভিমত, এই হারে বরফ গলতে থাকলে এশিয়ার কয়েকটি দেশের একশ’ কোটি মানুষ সরাসরি বিশুদ্ধজল সমস্যায় ভুগবে। এই দুর্যোগ থেকে উত্তরণের পথও বাতলে দিয়েছেন গবেষকরা। তারা স্পষ্ট বলেছেন, কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোটায় নামাতে হবে। তাতে করে বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধ হবে। উষ্ণতা রোধ না হলে অবধারিতভাবে গ্রহান্তরিত হতে হবে মানুষকে।

সুতরাং বুঝে নিতে হবে কোনটি আমাদের জন্য সহজতর; গ্রহান্তরিত, নাকি কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোটায় নামানো!

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শিল্পোন্নত দেশের বলিরপাঠা আমরা কেন হতে যাবো! বিষয়টি পর্যালোচনা করার জন্য বিশ্ব বিবেকের কাছে আমাদের আবেদন রইল। আপনারা কার্বন নি:সরণ নামিয়ে এনে আমাদেরকে বাঁচতে দিন; আমরা বাঁচতে চাই। আর মানুষ যদি নাই-ই বাঁচতে পারল, চাঁদ কিংবা মঙ্গল বিজয়ে কী হবে ঠিক বুঝতে পারছি না আমরা! কাজেই বিষয়টি নিয়ে ভাবুন।

আলম শাইন: কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও বন্যপ্রাণী বিশারদ।

আলম শাইন এর আরও যুক্তিতর্ক পড়তে ক্লিক করুন: 'আলম শাইন'

এ সম্পর্কিত আরও খবর