১৯৮৩ সালের ডিসেম্বর মাসে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন। স্বাধীনতার পরবর্তী এক দশক বাংলাদেশের রাজনীতি অনেক উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে আমাদের রাজনীতিতে হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্রের রাজনীতির আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়। কিন্তু এ হত্যা, ক্যু আর ষড়যন্ত্র সেখানেই থেমে থাকেনি। রাষ্ট্রপতি জিয়াকেও একই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে। বিরাজনীতিকরণ অথবা রাজনীতিতে অরাজনৈতিক শক্তির অনুপ্রবেশের সেই ধারাবাহিকতাতেই আনুষ্ঠানিক রাজনীতিতে এরশাদের উত্থান।
এরশাদ প্রায়ই বলতেন যে তিনি রক্তাক্ত পথে ক্ষমতায় আসেননি। এ নিয়ে তার এক ধরনের অহংবোধ ছিল। ইতিহাস পাঠে তার এ দাবিকে পুরোপুরি অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু পুরোপুরি স্বীকার করে নেওয়াও কঠিন। কারণ, জিয়া ও মঞ্জুর হত্যা কাণ্ডের পেছনের মূল কুশীলব অন্য কেউ ছিল কিনা, সেটি নির্ণয় না হওয়া পর্যন্ত এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে না।
তবে, আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়, তিনি রক্তপাতহীন পথেই ক্ষমতায় এসেছেন। এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো, সব সামরিক শাসকরাই দাবি করেন যে তারা বাধ্য হয়েই রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিয়েছেন। এরশাদও সে দাবি করেছেন। যদি ধরেও নিই যে তিনি রক্তাক্ত পথে ক্ষমতায় আসেননি, তারপরও তিনি যে জোর জবরদস্তির পথে ক্ষমতায় এসেছেন এ নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। যদি তিনি তার লেখা ‘আমার কর্ম আমার জীবন’ বইয়ের ভূমিকাংশে তার ক্ষমতা গ্রহণের বিষয়টি সচেতনভাবেই এড়িয়ে গিয়েছেন।
কিন্তু বিভিন্ন লেখকদের বর্ণনা থেকে জানা যায়, জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পরে তিনি নিছক বাধ্য হয়েই ক্ষমতায় আসেননি। বরং এ সুযোগটি তিনি কাজে লাগিয়েছেন এবং সে জন্য যা যা করার তা তিনি করেছেন। এ বর্ণনায় পাওয়া যায়, 'জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পরে তিনি তৎকালীন চিফ অফ জেনারেল স্টাফ জেনারেল নূরুদ্দিনকে বললেন, এখন করণীয় কী? সিজিএস একটু ভেবে উত্তর দিলেন সংবিধান অনুযায়ী ভাইস প্রেসিডেন্ট (আবদুস সাত্তার) এ সময় দেশের শাসনভার গ্রহণ করবেন। কিন্তু এমন জবাবের জন্য এরশাদ প্রস্তুত ছিলেন না। এরশাদ বললেন, কিন্তু তিনিতো অসুস্থ, সিএমএইচ বেডে শুয়ে আছেন। পরে তিনি তৎকালীন সংস্থাপন সচিব কেরামত আলীকে ডেকে পাঠালেন। তিনিও একই মতামত দিলেন। পরে এরশাদ কেরামত আলীকে নিয়ে সিএমএইচ-এ যান। সেদিন এম্বুলেন্সে করেই অসুস্থ সাত্তারকে বঙ্গভবনে নিয়ে আসেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট সাত্তারের দেশবাসীর উদ্দেশে একটি ভাষণ রেকর্ড করে পাঠিয়ে দেয়া হলো রেডিও ও টেলিভিশনে প্রচারের জন্য'। এর পরের ঘটনাপ্রবাহ এরশাদই নিয়ন্ত্রণ করেছেন। তিনি 'অপারেশন নিয়ন্ত্রণ কক্ষ'র মাধ্যমেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন।
১৯৮২ সালের ২৪ এপ্রিল এরশাদ রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারকে সরিয়ে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হন। এর তিনদিন পরে তিনি বিচারপতি এএফএম আহসান উদ্দিন চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি করেন এবং যথারীতি সংবিধান স্থগিত করেন। পরে ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর তাকেও সরিয়ে দিয়ে তিনি নিজেই রাষ্ট্রপতি হন। এর আগে সেনাপ্রধান থাকাকালেই তিনি নিজের ক্ষমতাকে নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক দল গঠন করেন। এর পরের ইতিহাস সবারই জানা। রাজনীতিতে অধিষ্ঠিত হতে থাকেন এরশাদ। হয়ে ওঠেন শাসক।
কিন্তু ক্ষমতা চিরদিনের নয়। আজ আছে, কাল নেই। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে ২৬টিরও বেশি মামলা হয়েছে। কিন্তু আফসোস, খুব কম মামলারই তদন্ত ও বিচার হয়েছে। এটি আমাদের রাজনৈতিক দেওলিয়াত্ব। ২৬ মামলার মধ্যে দুটি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হন ও বাকি মামলায় খালাস পান এরশাদ। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই সরকারের আমলেই এ মামলাগুলো থেকে তিনি রেহাই পান। কিন্তু জেনারেল মঞ্জুর হত্যা মামলা ও একটি দুর্নীতির মামলা আজও চলমান। এরশাদ চলে গেছেন, জানি এ মামলাগুলোও হারিয়েছে তার রাজনৈতিক গুরুত্ব।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বিএনপির প্রথম মেয়াদে এরশাদ পুরো সময়টিই কারাগারে কাটিয়েছেন। যে মামলার জন্য তিনি কারাগারে ছিলেন সে মামলার কোনো অগ্রগতি হয়নি। ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ সালেও মামলার তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। এভাবেই সবকিছু অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। হয়তো একদিন এরশাদও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবেন। ইতিহাস কাউকে মনে রাখে না। যে ইতিহাস নির্মাণ করে ইতিহাস শুধু তাকেই মনে রাখে। এরশাদ ইতিহাস নির্মাণ করেছেন কিনা সে প্রশ্নও ইতিহাসের কাছেই থাক।
আমরা আম মানুষ শুধু জানি, সবাইকেই যেতে হয় আজ অথবা কাল। সেদিন এই সিএমএইচ বেডে শুয়ে ছিলেন অসুস্থ আবদুস সাত্তার। তার কাছে ক্ষমতা ছিল না, ক্ষমতা ছিল এরশাদের। ক্ষমতার পালাবদলে সেই সিএমএইচ-এই এরশাদকে যেতে হয়েছে কতবার- কারণে অকারণে। শেষবারের মতো সেখান থেকেই তার মহাযাত্রা। সে যাত্রায় তিনি শুধুই একা। যেমন গিয়েছে সবাই। পেছনে পড়ে থাকে শুধু ইতিহাস।