দাপুটে স্বৈরাচার থেকে রাজনৈতিক ভাঁড়

বিবিধ, যুক্তিতর্ক

প্রভাষ আমিন | 2023-08-26 01:02:41

একজন মানুষের অনেক রূপ থাকে। কিন্তু এরশাদের মত এমন বহুরূপী মানুষ ও রাজনীতিবিদ ইতিহাসে সত্যি বিরল। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন নিষ্ঠুর স্বৈরাচার; কিন্তু ভালোবাসতেন কবিতা ও নারী। এক সময়কার দাপুটে স্বৈরাচার এরশাদ শেষ জীবনে নিজেকে পরিণত করেছিলেন রাজনৈতিক ভাঁড়ে। এরশাদকে বলা হতো চিরকালীন সিএমএলএ। নব্বইয়ের আগে ছিলেন চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটের। আর নব্বইয়ের পরে ক্যান্সেল মাই লাস্ট অ্যানাউন্সমেন্ট। সকাল বিকাল সিদ্ধান্ত বদলের ব্যাপারে এরশাদের কোনো জুড়ি ছিল না।

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই- এই সময়টা আরো অনেকের মত আমিও এরশাদকে নিবিড়ভাবে অনুসরণ করেছি। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপির মনোনয়নে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন বিচারপতি সাত্তার। অনেকে বিশ্বাস করেন জিয়াউর রহমানের হত্যার মাস্টারমাইন্ড ছিলেন এরশাদ। এটা যাতে জানাজানি না হয়, তাই জেনারেল মঞ্জুরকে ঠান্ডা মাথায় খুন করান এরশাদ। মঞ্জুর হত্যা মামলার আসামিও ছিলেন এরশাদ। তারমানে জিয়াউর রহমানকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসার পরিকল্পনাটা তার পুরোনো ও সুদূরপ্রসারী। অথচ জিয়া এরশাদকে সেনা প্রধান করেছিলেন সেফ মনে করে। জিয়া ভেবেছিলেন, এরশাদ নারী আর কবিতা নিয়ে ব্যস্ত থাকবে; তার ক্ষমতার জন্য বিপদ হবে না। কিন্তু জিয়া এরশাদকে চিনতে পারেননি, আসলে কেউই পারেননি। এরশাদ খুব কৌশলে নিজেকে আড়ালে রেখে এক ঢিলে অনেক পাখি মারতে পেরেছিলেন। জিয়া, মঞ্জুর এবং পরে জিয়া হত্যার বিচারের নামে মেধাবী মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের হত্যা করে নিজের পথ পরিস্কার করে রেখেছিলেন এরশাদ। তাই নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি সাত্তার সরকারের বিরুদ্ধে যখন নানা দুর্নীতির অভিযোগ উঠতে থাকে, যখন সাত্তার সরকারের মন্ত্রীর বাসা থেকে সন্ত্রাসী আটক করা হয়; তখনই বোঝা আড়াল থেকে কেউ কলকাঠি নাড়ছেন।

এরশাদ অবশ্য বেশিদিন আড়ালে থাকেননি। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বন্দুকের মুখে সাত্তারকে হটিয়ে দেশের সর্বময় ক্ষমতা দখল করেন এরশাদ। তারপর নয় বছর ছিল গোটা বাংলাদেশ ছিল তার ইচ্ছাধীন। এরশাদই ছিলেন শেষ কথা।

এরশাদ ক্ষমতায় আসেন ১৯৮২ সালের মার্চে। কিন্তু একবছরেরও কম সময়ের আগে ৮৩- এর মধ্য ফেব্রুয়ারিতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফুসে ওঠে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে। এরশাদ সে আন্দোলন দমন করেন নিষ্ঠুর কায়দায়। শহীদ হন জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দীপালি সাহাসহ অনেকেই। পরের বছর ফুলবাড়িয়া ছাত্র মিছিলে ট্রাক তুলে দেয় এরশাদের পুলিশ। শহীদ হন সেলিম-দেলোয়ার। ৮৭এর ১০ নভেম্বর বুকে ‘স্বৈরাচার নীপাত যাক’, পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লিখে রাজপথে নেমেছিলেন যুবলীগ কর্মী নুর হোসেন। এরশাদের পুলিশ নুর হোসেনের বুকে টার্গেট প্র্যাকটিস করে। ৯০ এর ১০ অক্টোবর রাজপথে প্রাণ দেন ছাত্রদল কর্মী জেহাদ। জেহাদের মৃত্যুতেই শুরু হয় স্বৈরাচার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলন।  আর ২৭ নভেম্বর ডা. মিলনের মৃত্যুর মধ্য দিয়েই তা নিশ্চিত পরিণতিতে পৌছায়।

তারপরও এরশাদ দিন দশেক ক্ষমতা আকড়ে ছিলেন বটে, কিন্তু সেটা না থাকার মতই। এরশাদের শাসনের নয় বছরই ছিল আন্দোলন সংগ্রাম, আর বিদ্রোহের কাল। এরশাদের হাত ছিল শহীদদের রক্তে রঞ্জিত। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের ছাত্রনেতা মিন্টু আনোয়ারের বাবাও ছিলেন এরশাদ বিরোধী। একবার এরশাদ এক জনসভায় দুই হাত উচিয়ে বলেছিলেন, এই দেখুন আমার হাত পরিস্কার, আমার হাতে রক্তের কোনো দাগ নেই। এটা শুনে মিন্টু ভাইয়ের বাবা হাতে থাকা পেপারওয়েট ছুড়ে টিভি ভেঙে ফেলেছিলেন।

তবে একটা কথা মানতেই হবে, এরশাদের শাসনের নয় বছর ছিল বাংলাদেশের সৃজনশীলতারও স্বর্ণযুগ। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সংবাদপত্রে, কার্টুনে, গানে, কবিতায় সৃজনশীলতার স্ফুরণ ঘটেছিল যেন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট বা পেশাজীবীরাও ন্যায্য আন্দোলনে রাজপথে ছিলেন। জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠিত হয়েছিলই এরশাদের রাজকীয় কাব্যচর্চার প্রতিবাদে।

পতনের পর বছর পাচেঁক কারাগারে ছিলেন এরশাদ। তারপর যখন মুক্তি পেলেন, তখন তার আরেক রূপ। কোথায় সেই দাপুটে ও নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক। এ যেন এক অস্থির, সর্বদা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা রাজনীতিবিদ। আজ আওয়ামী লীগের জোট করেন তো কাল বিএনপির সাথে। নয় বছর গোটা বাংলাদেশ ছিল এরশাদের যেমন ইচ্ছা লেখার কবিতার খাতা। আর পতনের পর জাতীয় পার্টি হলো সেই খাতা। যা ইচ্ছা, তাই সিদ্ধান্ত নিতেন। সকালে রুহুল আমিন হাওলাদার মহাসচিব তো বিকালে মসিউর রহমান রাঙা। আজ স্ত্রী রওশন এরশাদ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী তো কাল ছোট ভাই জি এম কাদের।

স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের দুই মূল দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে এরশাদের সাথে জোট করতে দেখে আমার সবসময়ই নিজেকে প্রতারিত মনে হয়েছে। কিন্তু একবারই এই সিদ্ধান্তকে আমার যৌক্তিক মনে হয়েছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে এরশাদের ভূমিকার কথা নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে। এরশাদ নির্বাচনে অংশ নিতে চাননি। এমনও হয়েছে, তিনি সাংবাদিকদের কাছে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে আত্মহত্যারও হুমকি দিয়েছিলেন। দাপুটে স্বৈরাচারের এমন অসহায় পরিণতি দেখে তার জন্য আমার করুণাই হয়েছে। শেষ পর্যন্ত এরশাদকে সিএমএইচে আটকে রেখে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টিকে ২০১৪ সালের নির্বাচনে আনা হয়েছিল।

এরপর সিএমএইচ থেকে এরশাদ সরাসরি বঙ্গভবনে যান নতুন সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে। নির্বাচনে যেতে অনিচ্ছুক এরশাদ বঙ্গভবন থেকে বেরিয়েছিলেন মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে। সিএমএইচ থেকে বঙ্গভবনে পৌছতে এরশাদের কিছুটা দেরি হয়েছিল। তিনি যখন পৌছান, তখন কানায় কানায় ভর্তি বঙ্গভবনের হলরুমের সবাই স্বতস্ফুর্তভাবে হেসে উঠেছিল। এরশাদকে হাস্যকরই লাগছিল। এক জীবনে দাপুটে স্বৈরাচার এরশাদকে যেমন দেখেছি, তেমনি দেখেছি হাস্যকর রাজনৈতিক ভাঁড় এরশাদকেও।

তবে এরশাদকে আপনি অপছন্দ করতে পারেন, ঘৃণা করতে পারেন, হাসতে পারেন; কিন্তু আপনি তাকে অস্বীকার করতে পারবেন না। এরশাদ বাংলাদেশের রাজনীতির এমন এক অধ্যায়, যাকে উপেক্ষা করা যাবে না।

প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

এ সম্পর্কিত আরও খবর